অনেক প্রতীক্ষার এক টেস্ট

রিকি পন্টিং তখন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক ছাড়া সে দলের সবাই এখন অবসরে। ফতুল্লা, ২০০৬। প্রথম ইনিংসে একজন গিলক্রিস্ট আর দ্বিতীয় ইনিংসে একজন রিকি পন্টিংয়ের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। হ্যাঁ, আজ থেকে নয় বছর আগে টেস্টে বাংলাদেশ চোখ রাঙিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। ‘প্রায় অসম্ভব’ সাধন করা হয়নি হাবিবুল বাশারের দলের। সেই টেস্টে ফতুল্লায় বাংলাদেশের হয়ে যাঁরা খেলেছিলেন, তাঁদের কেউই নেই বর্তমান টেস্ট স্কোয়াডে। মাশরাফি-শাহাদাত ছাড়া কয়েকজন গেছেন অবসরে, বাকিরা দলেই ডাক পান না এখন। ফতুল্লায় সেটাই বাংলাদেশের একমাত্র টেস্ট।
রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকাররা তখন ভারতীয় দলে। ২০১০, মিরপুর। প্রথম ইনিংসে ভারতের রানচাপায় পড়া বাংলাদেশের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার হয়ে এসেছিল তামিম ইকবালের দ্বিতীয় ইনিংসের সার্ধশতক। প্রথম ইনিংসে আট নম্বরে নেমে মাহমুদউল্লাহ্ চার রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করেছিলেন। সেটাই ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বশেষ টেস্ট মোকাবেলা।
২০০৬ এর ফতুল্লা, আর ২০১০ এর মিরপুরে যে ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়েছিল, ২০১৫-তে এসে তা সচল হচ্ছে আবার। মঞ্চ সেই ফতুল্লায়। খান সাহেব ওসমানী স্টেডিয়ামে টেস্ট ফিরছে নয় বছর পর, আর বাংলাদেশ পাঁচ বছর পর খেলতে যাচ্ছে ভারতের সঙ্গে টেস্ট।
এ পর্যন্ত সাতটি টেস্টে মুখোমুখি হয়েছে দু'দল। বাংলাদেশ হেরেছে ছয়টিতেই। তিনবার ইনিংস ব্যবধানে, একবার দশ উইকেটে, একবার নয় উইকেটে, একবার ১১৩ রানে। ব্যক্তিগত অর্জন ছাড়া দলগত সুখস্মৃতি তাই নেই প্রায়। একটি যে ড্র হয়েছে, তাও বৃষ্টির কল্যাণে।
বাংলাদেশের সুখস্মৃতি নেই, আছে ভারতের। বিদেশের মাটিতে ভারত শেষ টেস্ট সিরিজ জিতেছিল এই বাংলাদেশেই, সেই ২০১০ সালে (২-০)! বিরাট কোহলির নেতৃত্বাধীন দলটি তারুণ্যনির্ভর। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এই সিরিজেই ‘কামব্যাক’ করা হরভজন সিং। বাংলাদেশের জন্য একটা চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দিতে পারেন এই অফস্পিনার।
সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা? তার ওপর আবার চোটের কারণে ছিটকে গেছেন মাহমুদুল্লাহ। যদিও বিশ্বকাপের পর হারিয়ে খুঁজছিলেন, তবে ভারতের বিপক্ষে টেস্টই হতে পারতো তাঁর ফর্মে ফেরার দারুণ এক সুযোগ। তাঁর জায়গায় এসেছেন নাসির হোসেন, তবে তাঁকে রিয়াদের জায়গায় টপ অর্ডারে খেলানোর সম্ভাবনা খুবই কম। তামিম-ইমরুল পাকিস্তান সিরিজে ভাল করেছেন, তাঁদেরকেও বয়ে আনতে হবে সে ফর্ম।
তবে আরেকটা চোটে ছোটখাট এক ইতিহাস হতে যাচ্ছে ফতুল্লায়। মুশফিক কিপিং করতে পারবেন না, তাঁর উইকেটকিপিং নিয়ে এত এত আলোচনা হয়েছে যে, লিটনের উপর না একটু বাড়তি চাপই জেঁকে বসে! হ্যাঁ, অভিষেক হচ্ছে লিটন দাসের। লিটনকে নেয়া হচ্ছে মূলত উইকেটকিপার হিসেবেই, সেক্ষেত্রে তাঁকে ব্যাটিং করতে হবে লোয়ার মিডল অর্ডারে।
নাসিরকে খেলানো হলে তিনি হয়তো ব্যাটিং করবেন লিটনের আশেপাশেই। তবে লিটনকে যদি ‘ব্যাটসম্যান যিনি উইকেটকিপিংও পারেন’ এমন ভাবে খেলানো হয়, তাহলে শুভাগত, সৌম্যকে আবার একসঙ্গে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশের নির্বাচকরা অনেক কাজই করতে পারেন, যা আগে ভাবেননা কেউই!
তবে রুবেল হোসেনের ফিরে আসাটা ‘প্লাস পয়েন্ট’। পেসশুন্য আধারে রুবেল যদি একটু আশার সলতে তুলে ধরেন!
আর নির্বাচকরা যদি আশার আলো কিছুটা দেখাতে পারেন জুবাইর হোসেনকেও। পাকিস্তান সফরে উপেক্ষিত লেগ-স্পিনার নিশ্চয়ই মুখিয়ে আছেন কিছু করে দেখানোর। তাঁকে নামিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময় তো এটাই!
জুবাইর-রুবেলদের চ্যালেঞ্জ নিতে নিশ্চয়ই প্রস্তুত কোহলি পূজারারাও। ভারতীয় দলের প্রায় সবাই আসছেন আইপিএল খেলে। এসেই টেস্টের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, কাজটা চ্যালেঞ্জিং অবশ্যই। তবে একজন এক্ষেত্রে সতীর্থদের চেয়ে এগিয়ে; চেতেশ্বর পূজারা। ইয়র্কশায়ারের হয়ে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপ খেলে আসা এই ব্যাটসম্যান কতটা ‘পরিণত’ হলেন, তার প্রমাণ তিনি নিশ্চয়ই দিতে চাইবেন ফতুল্লা টেস্টেই!
কোহলির নেতৃত্বে নতুন এক শুরুই হবে ভারতের। প্রমাণের সুযোগের অপেক্ষায় এই দলের অনেকেই। বাংলাদেশেরও আছে প্রমাণের তাড়না। সীমিত ওভারে নিয়মিত ‘বড়’ শিকার করা গেলেও, টেস্টের জাল বরাবরই ছিঁড়ে যায় যেন! এজন্য যে ‘সেরা’ সমন্বয়, উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরী, তা না বললেও চলে। সবই তো কাগুজে কথা। তবে দিনশেষে এসবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
দলের ম্যানেজারের পদ নিয়ে খালেদ মাহমুদ সুজনের সাম্প্রতিক ‘নাটক’ এই প্রশ্নগুলোই সামনে আনে।
ফতুল্লা কি অপেক্ষা করে আছে এসব প্রশ্নের খুব শক্ত উত্তর নিয়ে? নয় বছর আগের সেই ইতিহাস না গড়ার আক্ষেপ কি মিটবে এবার?
নাকি রচিত হবে সেই একই চিত্রনাট্য। ছেঁড়া জালের বিষাদকাব্য।
মুশফিকের কিপিং ছাড়ার মতো আরও অনেক ইতিহাস তৈরী হোক ফতুল্লায়।