• " />

     

    কীর্তিময় ক্লাব কাহিনী - ১ঃ "বাসবি বেবস" ও একটি ট্র্যাজেডির গল্প

    কীর্তিময় ক্লাব কাহিনী - ১ঃ "বাসবি বেবস" ও একটি ট্র্যাজেডির গল্প    

    ১৯৪৪ সাল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হচ্ছে হচ্ছে অবস্থা। লিভারপুল এফসি তাদের একজন প্রাক্তন সেন্টার ব্যাককে সহকারী ম্যানেজার পদে যোগদান করার জন্য বলল। সেই ভদ্রলোক যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সামরিক ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। ফুটবল জ্ঞান প্রখর, প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলেন। তার ফুটবল স্টাইল, ফরমেশন কোনটাই মার্সিসাইডের এই ক্লাবের বোর্ডের প্রভাবশালী লোকজনের সাথে মিলবে না। আর তিনি সহকারী কোচ হিসেবে থাকতে চান না।

     

    যেই সময়ের কথা বলছি তখন প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের আরেক বিখ্যাত ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর্থিক দৈন্যদশায় ভুগছে। প্রয়োজন একজন ম্যানেজারের যিনি কম পারিশ্রমিকে কাজ করে দলকে সাফল্য এনে দিতে পারেন। তারা সেই একই মানুষটাকে প্রস্তাব দিলেন। তিনি রাজি হলেন সাথে সাথে কিছু শর্ত জুড়ে দিলেন, তিনি সরাসরি ট্রেনিং পরিচালনা করবেন, ম্যাচের দিন খেলোয়াড়দের নিয়ে যাবেন, যে কোন খেলোয়াড়কে বেচতে পারবেন বা কিনতে পারবেন, এ ব্যাপারে বোর্ড নাক গলাতে পারবে না, তাকে কমপক্ষে ৫ বছর সময় দিতে হবে শক্তিশালী দল তৈরি করার জন্য। এমন সব আবদার সেই সময়ে চিন্তাও করা যেত না! অন্য কোন উপায় না পেয়ে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ সালে সেই লোককে ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করলেন। ভদ্রলোকের নাম ম্যাট বাসবি।

     

    উপায়হীন ইউনাইটেড দল এই সিদ্ধান্তের সুফল দুই যুগ ধরে কেবল পেয়েই যাবে, তা যদি লিভারপুল কেবল জানতো!

     

    অদ্ভুত নিদর্শন। খেলোয়াড় হিসেবে প্রায় পুরোটা ক্যারিয়ার খেলেছেন ইউনাইটেডের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটি এবং লিভারপুলের হয়ে। সিটির হয়ে জিতেছেন এফএ কাপ। সেন্টার ব্যাক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। একদম পেছন থেকে খেলা পর্যবেক্ষণ করা, নেতৃত্ব দান তখন থেকেই শুরু।

     

    ফিরে আসা যাক ১৯৪৫ সালে। যোগদান করেই ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিয়নের সাবেক খেলোয়াড় জ্যাক মারফিকে প্রধান কোচের দায়িত্ব নিতে বললেন। মারফি এই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ১৯৪৬ সালে ক্লাবে যোগ দিলেন।

     

    দুই প্রখর ফুটবলীয়ও জ্ঞানের অধিকারী মানুষ ক্লাবটিকে বদলে দিতে শুরু করলেন। ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে ইউনাইটেড লিভারপুলের পেছনে থেকে লীগ শেষ করল। ১৯৪৮, ’৪৯, ’৫১ সালেও রানার আপ হয় ইউনাইটেড। এর মাঝখানে জিতে নেয় ১৯৪৮ সালের এফএ কাপ। ১৯৫২ সালে ৪১ বছর পর লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় বাসবির দল।

     

    কিন্তু ঐ সময়ে দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের বয়স ত্রিশোর্ধ্ব হয়ে গিয়েছিল। তাই পারফর্মেন্সেও ভাটা পড়ছিল ধীরে ধীরে। বাসবি এর আগে কখনো ম্যানেজার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও নিলেন এক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তিনি বেশি বয়সের খেলোয়াড়দেরকে ছেড়ে দিয়ে ১৬-১৮ বছর বয়সী ক্লাবের যুব একাডেমীর তরুণদের প্রধান দলে প্রবেশ করালেন। ডিফেন্ডার বিল ফোকস (১৯ বছর) মার্ক জোন্স (১৮ বছর) জ্যাকি ব্লাঙ্কফ্লাওয়ার (১৮ বছর); উইঙ্গার আলবার্ট স্কানলোন (১৬ বছর) ডেভিড পেইগ (১৬ বছর); ফরোয়ার্ড লিয়াম হুইলান (১৬ বছর) এর মতো ক্লাবের নিজস্ব যুবদলের খেলোয়াড়দের প্রধান দলে অন্তর্ভুক্ত করলেন।

     

    এখানে, একজন খেলোয়াড়ের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। তার নাম ডানকান এডওয়ার্ডস। সেই যুগের সবচেয়ে দুর্দান্ত ইংলিশ খেলোয়াড়। ১৫ বছর বয়সে ইউনাইটেড মূল দলে যোগ দেন। ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলে রেকর্ড করেছিলেন এডওয়ার্ডস (৪০ বছর এই রেকর্ড বহাল তবিয়তে ছিল)। এর পাশাপাশি বাসবি সাইন করালেন আরও কিছু তরুণ খেলোয়াড়কে। উইঙ্গার জনি বেরি (২৫ বছর), ফরোয়ার্ড টমি টেইলর (১৯ বছর), গোলকিপার হ্যারি গ্রেগ (১৯ বছর)।

     

    তারুণ্যে ভরপুর দলটি বাসবির পরিচালনায় চলা শুরু করল নতুন করে। ভাল খেলেও সাফল্য আসার জন্য অপেক্ষা করতে হল কয়েক বছর। এই সময়ের মধ্যেই দলটির আদুরে ডাক নাম হয়ে গেল বাসবি বেবস বা বাসবির ছানাপোনা। কারণ, দলটির গড় বয়স ছিল ২২। মাঠে নামা বেশিরভাগ খেলোয়াড় বয়সে ছিলেন তরুণ, মাঠে তাদের উদ্দীপক খেলা নজর কাড়ে পুরো ইউরোপের। ম্যানচেস্টার ইভিনিং নিউজ–র সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক নিকলিন ১৯৫২ সালে প্রথম এই নামে দলটিকে সম্বোধন করেন।




     

    বাসবির নতুন তারারা ১৯৫৬ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চমক দেখাতে শুরু করে। শিরোপা ধরে রাখে পরের বছরেও। এফএ কাপের ফাইনালে অ্যাস্টন ভিলার কাছে হেরে রানার আপ হয় ১৯৫৭ সালে। এই দলটি এতোটাই সফল ছিল যে ঐ সময়ে ৫ বছরে ইউনাইটেডের মেজর সাইনিং ছিল মাত্র দুটো; ফরোয়ার্ড টমি টেইলর, গোলকিপার হ্যারি গ্রেগ।

     

    ম্যানেজার হিসেবে সফলতা তাকে ১৯৫৬ সালে ইউরোপিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানেজার হিসেবে যোগদানের সুযোগ করে দেয়। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘মাদ্রিদ মে বি প্যারাডাইজ, বাট ম্যানচেস্টার ইজ মাই হেভেন’’

     

    বাসবির দলটি ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম শুরু করে হ্যাটট্রিক লীগ শিরোপার পাশাপাশি এফএ কাপ এবং ইউরোপিয়ান কাপ জেতার লক্ষ্যে।

     

    তারপর এগিয়ে আসে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮। এমন একটা দুপুর যা নাড়িয়ে দেবে পুরো ফুটবল বিশ্বকে। সার্বিয়ান ক্লাব রেড স্টার বেলগ্রেডের সাথে ইউরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ ৩-৩ গোলে ড্র করে সেমি ফাইনালে ওঠে তরুণ দলটি। খুশিমনে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ৬০৯ অ্যাম্বাসেডর বিমানে করে ম্যানচেস্টারের পথে রওনা দেয় তারা। পথিমধ্যে জ্বালানি নেওয়ার জন্য মিউনিখে যাত্রা বিরতি নেয়। জ্বালানি নেওয়ার পর কুয়াশার কারণে দু'বার টেক অফের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন প্লেনের পাইলট ক্যাপ্টেন জেমস থেইন এবং কেনেথ রেইমেন্ট। শিডিউলে পিছিয়ে পড়বেন বলে এক দিন দেরী করার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে ক্যাপ্টেন থেইন তৃতীয়বার প্লেন ওড়ানোর চেষ্টা করেন। সেই তৃতীয় বার চেষ্টা করাই কাল হয়ে দাঁড়ায় বাসবি বেবসের জন্য। বিমানটি মিউনিখ রানওয়ে পার হওয়ার আগেই বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, সাংবাদিক মিলিয়ে ৪৪ জনের ২০ জনই মারা যান তৎক্ষণাৎ। বাজেভাবে আহত একজন মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পথে এবং হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান আরও দু'জন। অর্থাৎ ৪৪ জনের ২৩ জনই মারা যান এই বিমান দুর্ঘটনায়।

     

    নিহত ২৩ জনের মধ্যে ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল একাদশে নিয়মিত খেলা ৮ খেলোয়াড়। দলের সবচেয়ে বড় তারকা ডানকান এডওয়ার্ডস ১৫ দিন পর হাসপাতালে মারা যান। বলা হয়, ডানকান এডওয়ার্ডস বেঁচে থাকলে পৃথিবী ববি চার্লটনকে চিনত না! পুরো ইংলিশ ফুটবলের আইকন ছিলেন ঐ সময়ে। তাঁর ক্ষিপ্রতা, নিশানাভেদী শট, খেলা সবমিলিয়ে সেই যুগে তাঁর ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না।

     

    ২১ জন যাত্রী বেঁচে গেলেও দুই বিখ্যাত ইউনাইটেড খেলোয়াড় জন বেরি এবং জ্যাকি ব্লাঙ্কফ্লাওয়ার এতোটাই বাজেভাবে আহত হন যে আর কোনদিন বুটজোড়া পায়ে দেওয়া হয়নি তাদের। জন বেরি অভিযোগ করেছিলেন, টমি টেইলর ভাল বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তাকে হাসপাতালে দেখতে যাননি, অথচ তিনি জানতেনই না, ফরোয়ার্ড টেইলর তখন অন্য পৃথিবীতে গোল করায় ব্যস্ত! বাসবি টানা ২ মাস হাসপাতালে ছিলেন, তিনি এই দুর্ঘটনায় এতোটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে ফুটবল থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, ‘’হারিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো চায়, তুমি যেন থেমে না যাও।‘’ বাসবি এ কথা শুনে ফিরে আসেন ম্যানচেস্টারে।

     

    প্রায় ৫ মাস ম্যানেজার পদ থেকে দূরে ছিলেন বাসবি। এ সময়ে দলের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন মারফি। বেঁচে যাওয়া খেলোয়াড় আর যুব দল মিলিয়ে ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে শুরু করেন মিশন ইম্পসিবল। দলকে তোলেন ১৯৫৮ এফএ কাপ ফাইনালে। যদিও হারেন বোল্টনের কাছে ০-২ গোলে।

     

    ক্লাব তখন বদলি খেলোয়াড়ের জন্য এতোটাই মরিয়া, মারফি আর্নি টেইলর, স্ট্যান ক্রোদারদের মত খেলোয়াড়দের ভেড়ান ওল্ড ট্রাফোর্ডে। তবুও দলের শোচনীয় অবস্থা ঠেকানো যায়নি। দুর্ঘটনার পর দলটি মাত্র ১৪ লীগ ম্যাচে মাত্র ১ বার জেতে, ফলে নবম অবস্থানে লীগ শেষ করে। তারপরও ইউরোপিয়ান কাপ সেমিফাইনালে মিলানকে হারায় ঘরের মাঠে। যদিও ফিরতি লেগে ৪-০ গোলে হেরে বাদ পরে সেমিফাইনাল থেকে। সেবারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ কাপ কমিটিকে অনুরোধ করে যেন  ট্রফিটি ইউনাইটেডকে দেওয়া হয়, তারা ছিল যোগ্য দাবিদার। রেড স্টার বেলগ্রেড এ প্রস্তাবে সমর্থন দেয়, তবে কমিটি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে।

     

    বাসবি আবার ক্লাবের দায়িত্ব নেন ১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে। ধীরে ধীরে তৈরি করেন দ্বিতীয় প্রজন্মের বাসবি বেবসকে। যুব দল থেকে তুলে আনেন জর্জ বেস্ট, সাথে দুর্ঘটনাকে জয় করা ববি চার্লটন, গোলকিপার হ্যারি গ্রেগ, বিল ফোকস এবং নতুন কেনা খেলোয়াড় ডেভিড হার্ড, আলবার্ট কুইক্সাল, ডেনিস ল’কে নিয়ে তৈরি করেন এক দুর্ধর্ষ দল যা বাসবি বেবসের নতুন প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত হয়।

     

    দলটি ১৯৬৩ সালে এফএ কাপ, ১৯৬৫ এবং ৬৭ সালে লীগ জেতে। ১৯৬৮ সালে শেষ ম্যাচে হেরে লীগ হাতছাড়া করলেও বেনফিকাকে হারিয়ে প্রথমবারের মত ইউরোপিয়ান কাপ জিতে নেয়।

     

    মিউনিখের সেই দুর্ঘটনার মাত্র ১০ বছর পর ১৯৬৮ সালে সেই ইউরোপিয়ান কাপ জেতা দলটা বাসবি বেবসই ছিল। কিন্তু কাপ নেওয়ার সময় বাসবি আর চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের উল্লাসের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন আরও ৮ জন। তাদের টিভি ক্যামেরায় দেখা না গেলেও তারা ছিলেন; বাসবির মতই হয়তো বলেছিলেন, ''ম্যানচেস্টার ইজ হেভেন অ্যান্ড উই আর দি এঞ্জেলস অফ হেভেন!''



                                                          ম্যাট বাসবি

     

    বাসবি অবসর নেন ১৯৬৯ সালে, তবে ৭০-৭১ মৌসুমে আবার এসেছিলেন এক মৌসুমের জন্য। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন।

     

    এখনো ওল্ড ট্রাফোর্ডে গেলে স্টেডিয়ামের পূর্ব অংশে দেখা যায় বাসবিকে, তিনি ম্যানেজারের মতই পর্যবেক্ষণ করছেন ক্লাবের পক্ষ থেকে বানানো রাস্তা ‘ম্যাট বাসবি ওয়ে’ থেকে, যেই রাস্তায় হয়ত এখনো বাসবির সেই হারিয়ে যাওয়া ছানাপোনারা ফুটবল খেলেন!