• ক্লিয়ার মেন অ-১৭ ফুটবল
  • " />

     

    ছেঁড়া বুট, ফুটবল আর বদলে যাওয়া জোগেনের জীবন

    (ক্লিয়ার মেন অনুর্ধ্ব-১৭ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রাজশাহীর সোনাদীঘি স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন জোগেন লাকড়া। হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও। দুর্দান্ত খেলে ঢাকা আবাহনীর বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পেয়েছেন। ব্রাজিল গিয়েছিলেন অনুশীলনের জন্য, এক মাস সেখানকার এক ক্লাবের হয়েও খেলেছেন। জোগেনের বদলে যাওয়া জীবনের গল্প তুলে ধরে হলো এখানে )


    ঢাকা  ছাড়ার সময় একটা বল সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন জোগেন লাকড়া। রাজশাহী থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে তার গ্রাম। গোদাগাড়ী উপজেলায়। জোগেনরা সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন বিজয়ীর বেশে। সারা দেশের  ১৭২ টি স্কুলের ভেতর সেরা ফুটবল দল হয়ে। গোদাগাড়ীর ছোট গ্রামে সেদিন চ্যাম্পিয়ন দলের চেয়ে বরং ওই বল নিয়ে মাতামাতি বেশি জোগেনের বন্ধুদের। এমন বল আগে দেখেনি তারা। বেলুনের মতো হালকা, খালি পায়ে কিক মারা যায় যত ইচ্ছা ততো। একটা বল ঘিরে পাড়া-প্রতিবেশির আগ্রহ দেখে নতুন উন্মাদনা জাগে জোগেনের মনে। ফুটবল খেলতেন নিয়মিত, আশে-পাশের গ্রামে জোগেনের নাম ডাক ছিল। অথচ এতোদিন একটা ফুটবলই ছিল না তার। স্কুল ফুটবলের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট জিতিয়ে এনেছেন দলকে, এরপর একটা বল পেয়েছেন। সেটাই জোগেনের প্রথম ফুটবল।

    এই ফুটবল জাদু জানে। একটা বল রাতারাতি ভাগ্য বদলে দিতে পারে একজনের। পেলে থেকে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, লিওনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো- সবার জীবন ওই এক বলের জাদুতেই বদলে গিয়েছিল। জোগেন অখ্যাত দেশের আরও অখ্যাত এক গ্রামের ১৭ বছর বয়সী এক ছোকড়া। ফুটবল কীভাবে জীবন বদলে দিতে পারে ওই এক টুর্নামেন্ট দিয়ে সেটা জেনে গেছেন তিনি।

    সোনাদীঘি স্কুলের হয়ে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূল পর্বে খেলতে ঢাকায় এসেছিলেন জোগেন। ঢাকায় ওটাই প্রথম আসা তার। স্বপ্নের পথে হাঁটা শুরু তখন থেকে। ফাইনালে ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন সোনাদীঘি। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা জোগেন পেয়েছিলেন গোল্ডেন বুট। এর পর ডাক পেয়ে যান ঢাকা আবাহনীর অনুর্ধ্ব-১৮ দলে। সুযোগ মেলে ব্রাজিল গিয়ে এক মাস অনুশীলনেরও। এক বছর আগেও ঢাকায় যাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারেননি, সেই  জোগেন ঘুরে এসেছেন ব্রাজিলও।

    অথচ সোনায় মোড়ানো বুট হাতে নেওয়ার আগে একজোড়া চামড়ার বুট জোটাতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল তাকে। গোদাগাড়ীর জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য। জোগেনও তাদের একজন। চার ছেলে-মেয়ের টানাটানির সংসার জোগেনের কৃষক বাবার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, বুট তো সেখানে বিলাসিতা।

    ***

    পাড়ার সমবয়সীদের সঙ্গে একসাথে স্কুলে যেতেন জোগেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছেলে শিক্ষিত হয়ে চাকরি করবে সেনাবাহিনীতে। হাল ধরবে পরিবারের। জোগেনের ইচ্ছাও তেমন। কিন্তু স্কুলের পড়াশুনার চেয়ে বরং ওই বলটাই ছোটবেলা থেকে বেশি টানত জোগেনকে। বন্ধুদের কাছেও বল ছিল না। তাই পলিথিন-খড়কুটো এক করে দড়ি পেঁচিয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলতেন। অবশ্য সেই খেলায় বেশিদিন মন টেকেনি জোগেনের। দিনের পর দিন সহজেই ম্যাচ জিতে ফেলায় আনন্দ থাকলেও মনের খোরাক তো মেটে না!

    বয়স তখন নয় ছুঁয়েছে। পাড়ার মাঠে বয়সের প্রায় দ্বিগুণ বড় ছেলেরা যখন খেলতে নামত মাঠের এক পাশে তখন দাঁড়িয়ে থাকতেন জোগেন। যদি সুযোগ মেলে! সুযোগ একদিন পেলেনও। ওই দিনের পর আর মাঠে নামার জন্য কারও কাছে ধর্না দিতে হয়নি জোগেনকে। বাড়ি এসে ‘বড় ভাইয়েরাই’ ডেকে নিয়ে গেছেন জোগেনকে। এই গ্রামের সঙ্গে ওই গ্রামের ম্যাচ, অমুকের সঙ্গে তমুক- সবাই নিজেদের দলে চায় জোগেনকে। বল আর খেলার জোগান মিলেছিল তাতে। কিন্তু বুট যোগাবে কে জোগেনকে? ওই ‘বড় ভাইতেই' মুক্তি। এর ওর ছিঁড়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া বুট যোগাড় করে আনতেন জোগেন। জোড়া-তালির সেলাই দিয়ে এরপর ওই বুট পরেই গোদাগাড়ী দাপিয়ে বেড়াতেন। 
     

    জোগেনের মাটির ঘরে তখন বিদ্যুৎ সংযোগও ছিল না। টেলিভিশন থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। নেইমার তখন সবে মাত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। জোগেন ফুটবলে ব্রাজিলের ভক্ত। নেইমার তার পছন্দের ফুটবলার। কিন্তু খেলা দেখার উপায় নেই। এক কিলোমিটার হেঁটে গ্রামের বাজারে গিয়ে টেলিভিশন দেখতেন জোগেন, একে ওকে অনুরোধ করে খেলার চ্যানেলটা খুঁজতেন। পাঁচ মিনিট-দশ মিনিট যতটুকু সুযোগ পেতেন ততোটুকুই আত্মস্থ করতেন। এর পর খেলতে নামলে সেগুলো অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। আর পড়াশুনা তো চলছিলই পাশাপাশি।

    জীবন এমন ফুটবলময় হলেও হয়ত আরেকটু সহজ হত জোগেনের। কিন্তু শুধু পড়াশুনা বা শুধু ফুটবল- কোনোটা নিয়েই থাকার সুযোগ নেই তার। বাবা আর বড় ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করতেন ফসলের মাঠে। এত কিছু করতে গিয়ে শেষে পড়াশুনাটাই না গোল্লায় যায়- সেই ভয়ে বাবা-মা একসময় ফুটবল খেলা বাদ দিতেও বলেছিলেন জোগেনকে। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পর আর অবশ্য এসব শুনতে হয়নি, জোগেনের বাবা-মাও বুঝে গেছেন এই ছেলের প্রতিভা আছে।

    ***

    ক্লিয়ার মেন অনুর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টের জন্য সোনাদিঘীর দলটাও বাছাই করেছিলেন জোগেন নিজেই। অজপাড়া গাঁয়ের সেই স্কুল, ফুটবল দল দিয়ে পরিচিতি পেয়ে গেছে রাতারাতি। এর পর ঢাকা আবাহনীতে ডাক পেয়েছিলেন জোগেন, আর তার  সতীর্থ প্রবিত কুমারের সুযোগ মিলেছে সাইফ স্পোর্টিংয়ে। দুইজনই অনুর্ধ্ব-১৮ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন নিজেদের দলের হয়ে।

    জোগেন ডেভেলপমেন্ট ফুটবলও খেলেছেন রাজশাহী বিভাগের হয়ে। গতি আছে, আর আছে অবিশ্বাস্য দক্ষতা। খেলেন ফরোয়ার্ড হিসেবে। ড্রিবলিং আর ফিনিশিং দু’টোই বয়সের তুলনায় দুর্দান্ত। শীর্ষ ক্লাবের চোখ তার ওপর পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে তো বটেই, জোগেন নজর কেড়ে এসেছেন ফুটবলের দেশ ব্রাজিলেও।

    ক্লিয়ার মেন টুর্নামেন্টের পর বয়সভিত্তিক দলের আরও তিন তরুণের সঙ্গে দারুণ এক সুযোগ মিলে যায় জোগেনের। সুযোগ মেলে ব্রাজিল ভ্রমণের। সেখানের ক্লাব সোসিয়েদাদ এস্পোর্তিভার হয়ে এক মাস অনুশীলন করেন জোগেনরা। দলের হয়ে অংশ নেন ব্রাজিলের অনুর্ধ্ব-১৭ এর অঞ্চলভিত্তিক টুর্নামেন্টেও। অংশ নেওয়া পর্যন্তই অবশ্য থামেনি তাদের যাত্রা, ওই টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের তরুণরা। জোগেন সেখানে নজর কেড়েছেন আলাদা করে, সোসিয়েদাদ কোচ নাকি রেখেও দিতে চেয়েছিলেন তাকে।

    ব্রাজিল গিয়ে প্রিয় দলের একটি খেলা দেখার সুযোগও হয়েছিল জোগেনের। ২০১৯ কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলাটি মাঠে বসে দেখেছিলেন তারা।  জোগেনের ভাষায়, সেই অভিজ্ঞতা ছিল স্বপ্নের মতো। এসব বলতে বলতে জোগেন নিজেই যেন আরেকবার ফিরে যান সাও পাওলোতে। শিহরণ অনুভব করার অধিকার তো জোগেনের আছেই, এক বছর আগে তো এক জোড়া বুট আর একটা ফুটবলের স্বপ্ন দেখাই বাড়াবাড়ি ছিল তার জন্য।

    এই এক বছরে স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠেছেন জোগেন। আপাতত পড়াশুনা আর খেলা-দু’টোই যাচ্ছেন। ব্রাজিল গিয়ে সোসিয়াদাদের সতীর্থরা বন্ধু হয়ে গেছেন জোগেনের। তাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় এখন তার। দেশে ফেরার সময় দামী একটি মোবাইল ফোন কিনে এনেছিলেন। ঢাকায় নিজের ক্লাবের খোঁজ খবর নিতে  কল করতে গিয়ে সেই মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ছিনতাইকারী। আপাতত তাই ব্রাজিলিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই জোগেনের। তবে জোগেন যে ছাপ ব্রাজিলে রেখে এসেছেন সেটা তো সহজে ভোলার কথা নয় ভবিষ্যৎ নেইমার, কুতিনিয়োদের।   

    জোগেন লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। কোনো তারকা হয়ে যাননি তিনি। এখন তারকা হওয়ার কথাও না তার। আপাতত স্বপ্ন জাতীয় দলের হয়ে খেলা। তার জন্য জোগেনকে পাড়ি দিতে হবে আরও কঠিন পথ। এসব অজানা কিছু নয়, তত্ত্বকথা আর বাস্তবতা। কিন্তু জোগেন বুঝে গেছেন একটা গোল চামড়ার বল কীভাবে বদলে দিতে পারে মানুষের জীবন। এই বল পুঁজি করে যতজনের জীবন পালটে গেছে তাদের সঙ্গে আছেন জোগেনও।