• ক্রিকেট

সোনামনিদের সহজ "আশরাফুল পাঠ" : কিছু মিথ ও সেসবের সত্যিকার তর্জমা

পোস্টটি ৩৭৮৩১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

"সোনামনিদের সহজ "আশরাফুল পাঠ" : কিছু মিথ ও সেসবের সত্যিকার তর্জমা"

ক্রিকেট মূর্খ

.......................................................................

১. আশরাফুল তো নিজে থেকেই সব দোষ স্বীকার করেছেন…

তর্জমা: আত্মগ্লানিতে রাতের ঘুম হারাম, দিনে অস্থিরতা। অনুশোচনা পুড়তে পুড়তে ‘খাঁটি’ হওয়া। কোনো নির্ঘুম এক রাত শেষে সুন্দর ভোরে মনস্থির করে ফেলা। এরপর মিডিয়ার সামনে অকপটে সব স্বীকার!

আশরাফুলের ব্যাপারটি কি এরকমই ছিল? মোটেও না! আকসুর জালে সে বন্দী হয়েছিল। আকসুর হাতে ছিল সব প্রমাণ। আকসুর কাছে শুরুতে সবই অস্বীকার করেছে। পরে একটার পর একটা প্রমাণ দেখাতে শুরু করার পর আস্তে আস্তে সে ভেঙে পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনেই সব প্রমাণ চোখের সামনে দেখার পর স্বীকার করে। যদিও তখন করা আর না করার পার্থক্য সামান্য। তবে আকসুর জন্য আশরাফুলের স্বীকারোক্তি জরুরী ছিল আরেকটা কারণে। স্বীকার করা মানে তখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জড়িত অন্যদের কথাও জানা যায়।

যাই হোক, ঘটনা ছিল এটিই। তো এটা নিজে থেকে স্বীকার করা কিভাবে হলো? নিজে থেকে স্বীকার করেছিলেন বলা চলে হানসি ক্রনিয়ে। তিনিও প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন। বোর্ড তার পাশে ছিল শক্ত ভাবে।  হয়ত কিছুই হতো না। কিন্তু অনুশোচনায় ভুগে চার্চের পাদ্রীর সঙ্গে কথা বলে পাদ্রীর পরামর্শেই দোষ স্বীকার করেন। রাত ৩টায় বোর্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলি বাখেরকে ফোন করে বলেন যে ‘অসৎ ছিলাম।’ তাতে তার দোষ কমছে না, তবে এই দাবী করা যায় যে নিজে থেকে স্বীকার করেছিলেন।

আশরাফুল নিজে থেকে স্বীকার করেনি।  অকাট্য প্রমাণ হাজির করার পর স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এরপর ‘তদন্তে সহায়তা করলে শাস্তি কম হবে’, ‘আইসিসিকে তথ্য দিলে আইসিসিও তার ব্যাপারটা দেখবে’... এসব বলার পর সুরসুর করে সব বলে দিয়েছে। আরও অনেক তথ্য দিয়েছে।

.....................................................................

২. মিডিয়ার সামনে কান্না করে নিজের ভুল স্বীকার করেছে আশরাফুল, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছে…

তর্জমা: আবারও ওপরের কথা দিয়েই শুরু করতে হয়। নিজে থেকে কিছুই করেননি। আকসুর কাছে ধরা খেয়ে এবং স্বীকার করতে বাধ্য হওয়ার পর, এবং আরও কয়েকজনের নামসহ অনেক কিছু বলার পরও আশরাফুল চুপচাপ ছিলেন। পরে প্রথমে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় নিউজ হয়। এরপর প্রথম আলোতে। সাংবাদিকরা সব ছুটে যান আশরাফুলের বাসায়। তখন কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন আশরাফুল। ক্ষমা চান।

 

কান্না হয়ত মেকি ছিল না। ক্ষমা চাওয়াটাও হয়ত মন থেকেই। কিন্তু আবার খেয়াল করুন, সে কিন্তু নিজে থেকে ক্ষমা চায়নি! আকসুর কাছ থেকে ফেরার পর যদি মিডিয়া ডেকে বা সবার সামনে ক্ষমা চাইত, তাহলে নাহয় বোঝা যেত!

আশরাফুল পরে একটি টিভিতে বলেছিলেন, মিডিয়ার কোনো এক বড় ভাইকে বিশ্বাস করে বলেছিলেন আকসুর কাছে ধরা খাওয়ার কথা। সেই বড় ভাই পরে নিউজ করে দিয়েছে। যাই হোক, তাতে সেই বড় ভাইকে আমরা বিশ্বাসঘাতক বলতে পারি। তবে এটাও বুঝতে পারি, ওই বড় ভাই নিউজ না করলে আকসুর রায় না আসা পর্যন্ত আশরাফুল কিছুই বলতেন না। স্বীকার করা বা জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া তো বহূদুর।

শেষ কথা একটাই, নিজে থেকে কিছুই করেনি আশরাফুল (ফিক্সিং ছাড়া)। কাজেই তার সাহস আছে, সত্য স্বীকার করেছে, এসব কথা বলে ‘সত্য’, ‘সাহস’ এই ধরণের শব্দগুলোর অপমান করবেন না!

................................................................................

৩. আশরাফুলের উপায় ছিল না। সে তো ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্রিকেটার, মালিকের কথা শুনতে হবে। তাই বাধ্য হয়েছে ফিক্সিংয়ে। মালিকদের ফাঁদে পা দিয়েছে।

তর্জমা: ওই সময় ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের অধিনায়ক কে ছিল, মনে আছে তো? ভদ্রলোকের নাম মাশরাফি মুর্তজা। ঢাকার মালিকরা ম্যাচ পাতানোর ছক কাটার সময় মাশরাফিকে বলার সাহসই পায় নাই। কারণ বললে মাশরাফি তাদের খবর করে ছাড়ত! আগের বারও, এক সাবেক ক্রিকেটার সামান্য একটু ইঙ্গিত দিয়েছিল মাশরাফিকে। তাতেই মাশরাফি সেটা মিডিয়াসহ সংশ্লিস্ট সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। যেটার কারণে পরে মাশরাফির প্রাণ হুমকির মুখে পড়েছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিরাপত্তা দিতে চেয়েছিল। মাশরাফি নেয় নাই। সেই সাহস ও দাপট তাঁর আছে।

আর আশরাফুলের জন্য ফিক্সিং ছিল ডালভাত। সেজন্যই ওই ম্যাচে  ইনজুরির কথা বলে মাশরাফিকে বাইরে রাখা হয়। হাঁটুতে ব্যথা ছিল মাশরাফির, তবে না খেলার মত নয়। দল থেকে তাঁকে বলা হয় বিশ্রামের কথা। নাটকের সফল মঞ্চায়নের জন্যই আশরাফুলকে সেদিন অধিনায়ক করা হয়। কোচ ইয়ান পন্টের মাধ্যমে আগে থেকেই ঘটনা জানতে পেরে আকসু ফাঁদ পাতে পন্টকে দিয়ে। তাতেও অনেকটা বেরিয়ে আসে যে আশরাফুলের জন্য এসব করা ব্যাপার না।

পন্ট নিজের জবানবন্দীতে বলেছিলেন, “They wanted the normal captain, Mashrafe Mortaza, replaced for the game with Mohammad Ashraful as they knew that Mashrafe would have no part in any corruption. He had already reported a previous approach and gone public in the media, too. So they wanted him out of the side.”

একাদশের বাইরে রাখায় ও পরে ফিক্সিং ম্যাচ বুঝতে পেরে মাশরাফি পরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ডাগ আউটে বোতলে লাথিও মারেন। যাই হোক, একজনকে মালিকরা বলারই সাহস পায়নি। আরেকজন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করছে। কারণ সে এসবে অভ্যস্ত। কত পেয়েছিল ওই ম্যাচে ফিক্সিংয়ের জন্য? ৫ হাজার? ১০ হাজার ডলার বড়জোর? হয়ত আরও কম। কিন্তু এতই ডালভাত হয়ে গিয়েছিল যে যখন তখন করতে পারত। দিনের পর দিন করে আসছিল। কাজেই আশরাফুল বাধ্য হয়েছে, এটা বলা হাস্যকর।

...................................................................

৪. আশরাফুল তো দেশের সঙ্গে বেঈমানি করে নাই। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট একটু ভুল করে ফেলছে। মালিকপক্ষই তো সব দুই নম্বর!

তর্জমা: আকসুর জিজ্ঞাসাবাদেই আশরাফুল স্বীকার করেছে, ২০০৪ সাল থেকে সে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচেও স্পট ফিক্সিং করেছে। ৩টি ম্যাচের কথা তো স্বীকারই করেছে। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে, ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে, ২০১২ টি-টেয়েন্টি বিশ্বকাপে। আশরাফুল বলেছিলেন, সাবেক তিন ক্রিকেটার তাকে এই জগতে এনেছেন। আইসিসি তখন জানিয়েছিল যে এসবেরও তদন্ত হবে। কিন্তু আইসিসি বলে কথা, পাড়ার যুব সমিতির মত সংগঠন। সেই তদন্ত শুরুর খবর নাই।

 

৮ বছরের মধ্যে ৩ বারের কথা তদন্তে এসেছে বলেই হয়ত স্বীকার করেছেন। বাকি সময় নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে ছিলেন না! কয়েক বছর পরপর হুটহাট ফিক্সিং করেননি! নিয়মিতই করেছেন। আরও অনেক বারই করেছেন।

মনে করে দেখুন, ম্যাচের পর ম্যাচ আশরাফুল একই ভুল করে গেছেন। একই জায়গায় বারবার ক্যাচ দিয়েছেন। ফিল্ডার ছিল, ক্যাচ ছেড়েছে, তারপরও ওখানেই আবার ক্যাচ দিয়েছেন। কোনো কোনোদিন বেশি আক্রমণাত্মক খেলেছেন, কোনোদিন বেশি রক্ষণাত্মক। কোনো সময় হুট করেই কোনো একটা ওভারে হয়ত প্রচণ্ড ছটফট করে শট খেলেছেন। সবই কিন্তু স্পট ফিক্সিংয়ের সিম্পটম! ক্রিকেটীয় কারণেও হতে পারে। তবে যখন দিনের পর দিন, বছরে পর বছর হয়ে আসছে, তখন ঠিক ক্রিকেটীয় ব্যখ্যাকে ঢাল করা যায় না। ওইসব ম্যাচের অনেকটাই হয়ত ছিল স্পট ফিক্সিংয়ের অংশ!

শ্রীলঙ্কার এসএলপিএলেও স্পট ফিক্সিং করেছেন। বিপিএলে করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি করেছেন জাতীয় দলের হয়েই। তো তাকে জাতীয় বেঈমান কিংবা দেশদ্রোহী বললে ভুলটা কোথায়?

........................................................................

৫. ভুল করেছে, শাস্তি পেয়েছে। মাফ করে দেওয়াই যায়। মানবিকতা বলেও তো ব্যপার আছে!

তর্জমা:  অবশ্যই আছে। অবশ্যই ক্ষমা কেউ করতে পারেন। কেউ ক্ষমা নাও করতে পারেন। কোনোটাতেই ক্ষতি বা সমস্যা নেই। তবে তাকে ‘নায়ক’ বানাতে গেলেই সমস্যা! নিষেধাজ্ঞার শাস্তিতে তার প্রায়শ্চিত্ত হয়নি। পাপের ফল কিছুটা ভোগ করেছে বলা যায়। আবার জাতীয় দলে ফিরে বছরের পর বছর বাংলাদেশের হয়ে অসাধারণ পারফর্ম করলে, অভাবনীয় কিছু করলে, দেশকে অনেক অনেক জয়, অনেক ট্রফি আর সাফল্য এনে দিলে হয়ত বলা যাবে কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হলো।

 

সেটার জন্য আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ খেলতে হবে। ২ বছর পর নিষেধাজ্ঞা পুরো উঠলে জাতীয় দলে ফিরতে হবে। এবং আলাদিনের চেরাগ পেতে হবে। তাইলেই কেবল অভাবনীয় কিছু করা সম্ভব। তা না হওয়া পর্যন্ত আশরাফুল ‘খলনায়ক’ হতে পারে, নায়ক নয়। শাস্তি ভোগ করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরছে। সাধারণ প্রক্রিয়া। বাড়তি উচ্ছ্বাস কেন? অতি উচ্ছ্বাস দেখিয়ে এই সময়ের তরুণ ক্রিকেটারদের, বা ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমরা কি বার্তা দিচ্ছি? ফিক্সিং করো, ইচ্ছেমত টাকা কামাও। ধরা খেলে সমস্যা নাই। ৩ বা ৫ বছর নিষিদ্ধ। মিডিয়ার সামনে কাঁদবা। ভুল করেছি বলে রব তুলবা। নিষেধাজ্ঞা শেষে ‘জাতীয় বীর’ হয়ে ফিরবা, তাই তো?

 

আবার এটাও মনে রাখতে হবে, এই ২ বছরের মধ্যে যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ফিক্সিংয়ের তদন্তও শুরু করে আইসিসি, তাহলে … :) !

.....................................................................................

৬. বাংলাদেশের অনেক জয়ের নায়ক আশরাফুল। ভুল পথে পা বাড়ালেও তাকে ক্ষমা করে একটু আলাদা চোখে দেখাই যায়!

তর্জমা: ৬১টি টেস্ট খেলেছে আশরাফুল। এই পরিমাণ টেস্ট খেলে অনেকে শুধু তার দেশের নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের লিজেন্ড হয়ে যায়। আশরাফুলের ব্যাটিং গড় ২৪। যাই হোক, সেই পুরোনো কাসুন্দি না ঘাঁটি। বলছিলাম অনেক জয়ের নায়ক বলে প্রচলিত ধারণার কথা। আশরাফুলের ৬১ টেস্টে বাংলাদেশ জিতেছে ৪টি। সেই ৪ ম্যাচে আশরাফুলের রান…. (ব্রেস ইওরসেল্ফ)…৪ ম্যাচের ৮ ইনিংসে রান মোট ৭৩। সর্বোচ্চ ২২। গড় ৯.১২! অনেক অনেক জয়ের নায়ক!

ওয়ানডেতে বড় দলগুলির বিপক্ষে, জিম্বাবুয়েসহও যদি ধরি, তাহলে বাংলাদেশের জয়ে আশরাফুলের বড় অবদান আছে ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়েকে হারানো, ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া, ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ে। আরও দু-একটা জয়ে টুকটাক ফিফটি বা কিছু করে খানিকটা অবদান। এই তো। অনেক জয়ের নায়ক তাতেই? আর হিসাব করুন, কত কত ম্যাচ সে খেলেছে। কত ম্যাচ সে জেতাতে পারত!

 

আরেকটা হিসাবও করা যায়। কত ম্যচে দলকে বিপদে ফেলে এসেছেন? কত ম্যাচে দৃষ্টিকটু ভাবে আউট হয়েছেন?

দলকে জেতানোর পাল্লা ভারী যাদের, তাদের নায়ক বলে। দলকে বিপদে ফেলে আসার পাল্লা ভারীদের নয়!

...........................................................

৭. হাবিবুল বাশার, শাহরিয়ার নাফিসরাও তো দেশের সঙ্গে বিদ্রোহ করে আইসিএলে গিয়েছিলেন!

তর্জমা: দুটো এক নয়। আইসিএলে যাওয়াকে দেশদ্রোহ বলা যায় না। অনেকগুলো ব্যাপার ও দিক আছে এতে।

প্রথমত, আইসিএল নিষিদ্ধ করাই ছিল একটা নিষিদ্ধ কাজ! আইপিএলের মত আইসিএলও তো একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট! দুটি পাশাপাশিই চলতে পারত! কিন্তু আইপিএলকে বাঁচাতেই আইসিএল নিষিদ্ধ করে ভারতীয় বোর্ড। আর মূলত আর্থিক কারণেই আইসিসি ও অন্যান্য বোর্ডগুলোর জোর ছিল না ভারতের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার। তারাও নিষিদ্ধ করে আইসিএলকে।

একজন পেশাদার ক্রিকেটার বা খেলোয়াড়ের নিজের স্বাধীনতা আছে কোথায় খেলবে, সেটা বেছে নেওয়ার। আইসিএল তো আর ক্রিমিনালদের লিগ ছিল না! হ্যাঁ, মূল সমস্যা ছিল যে আইসিএলে গেলে দেশের হয়ে আর খেলা যাবে না। এটা জেনেও আইসিএলে যাওয়া মানে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত। অনেকেই যায়নি। মাশরাফির অফার ছিল ৮ কোটি টাকার। তামিম ইকবালের শোনা যায় আরও বেশি অঙ্কের প্রস্তাব ছিল। তারা যাননি। আবার হাবিবুল বাশার, রফিকদের আপনি কোনো দায়ই দিতে পারেন না। কারণ তাদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ। মঞ্জু, শরিফ, তাপস বৈশরাও তখন বোর্ডের চুক্তি বা জাতীয় দলের আশেপাশে নেই। মাহবুবুল করিম, গোলাম মাবুদরা আবার জাতীয় দলের স্বপ্ন ধেখার অবস্থায়ও ছিল না। কাজেই একটি পেশাদার লিগে খেলতেই পারেন!

এখানে মূল পার্থক্য হলো দৃষ্টিভঙ্গির। আজকে ক্রিস গেইল, সুনিল নারাইন, ডোয়াইন ব্রাভোদের নিয়ে আপনি নাচানাচি করছেন না? অথচ গেইল বছরের পর বছর বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে সই করছেন না। নারাইন সম্ভবত ক্যারিয়ারে কখনোই করেনি। ব্রাভো ওয়ানডে অধিনায়ক থাকার সময়ও কেন্দ্রীয় চুক্তিতে সই করেননি। কারণ ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে তারা বিশ্ব জুড়ে টি-টোয়েন্টি খেলতে চান। দেশের হয়ে সবসময় খেলতে দায়বদ্ধ থাকতে চান না। তাদের নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি কমই। আজকে সাকিব আল হাসান বা মুস্তাফিজুর রহমান যদি বিসিবির চুক্তিতে সই না করে, আমরা তাদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে তাদের বসবাস করাই নরক করে তুলতে পারি। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সেখানেই।

তার পরও, দিনশেষে দেশের হয়ে খেলাই সবচেয়ে আগে। এবং অবশ্যই শাহরিয়ার নাফিস, নাজিমউদ্দিন, অলক কাপালি, আফতাব, ফরহাদ রেজা, ধিমানদের উচিত হয়নি আইসিএলে যাওয়া। তবে সেটার সঙ্গে ফিক্সিং মেলে না কোনো ভাবেই। তারা ক্রিকেট খেলতেই গিয়েছিলেন। দেশে বা দলের হয়ে খেলে ইচ্ছে করেই বাজে খেলার জন্য টাকা নেননি!

তার পরও আরেকটু যোগ করা যায়। এই আইসিএল কাণ্ডের নাটের গুরু কে জানেন? এখানেও জনাব আশরাফুল। তিনিই সবার আগে প্রস্তাব পান এবং দলটা সাজানোর দায়িত্ব পান। তিনিই দল গোছাতে থাকেন আড়ালে। অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে দল হারছে, কিন্তু সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। মাঠের বাইরে, এমনকি অনেক সময় ড্রেসিং রুমেও আশরাফুল মিটিং করছেন সবাইকে আইসিএলে যেতে রাজী করাতে! আশরাফুলকে ক্যাপ্টেন ধরেই দল সাজানোর প্রস্তাব দিয়েছিল আইসিএল কতৃপক্ষ। হাবিবুল বাশার দৃশ্যপটেই ছিলেন না। সবাই জানত, হাবিবুল টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান নন।

আশরাফুল আবার দল সাজাতে সাজাতে ফন্দি আঁটছিলেন অন্য একটি। শাহরিয়ার নাফিসদের সরিয়ে বাংলাদেশ দলে নিজের ক্যাপ্টেন্সি দীর্ঘসময় ধরে রাখার পথ পরিস্কার করা। দল সাজিয়ে তাই শেষ মূহুর্তে চম্পট দিলেন আশরাফুল। আয়োজকরা পড়ল বিপদে। একজন অধিনায়ক দরকার। তখনই নেওয়া হলো হাবিবুলকে। আশরাফুল হয়ে গেলেন নায়ক!

আমাদের লিটল মাস্টার এরকমই বহুরূপী!

 

৮. আশরাফুল বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম তারকা, মহাতারকা, আশার ফুল, আরও যত হাবিজাবি…

তর্জমা: বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস কি এত ক্ষুদ্র যে আশরাফুলই প্রথম তারকা? সত্তর-আশির দশকে না-ই গেলাম… এই নব্বই দশক…বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ৭-৮ বছর আগে মহিন্দর অমরনাথ বলেছিলেন, টেস্ট মানের ব্যাটসম্যান মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। আশরাফুল ৬১ টেস্ট খেলেও টেস্ট মানের হতে পারেনি, সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু অনেকের মতেই, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান নান্নু। প্রথম বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের নায়ক। তারকা নন?

আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুলরা তারকা ছিলেন না? সেই নব্বইয়ে ইডেনে ম্যান অব দা ম্যাচ আতহার আলি খান, প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক মোহাম্মদ রফিক তারকা ছিলেন না? রফিকের মত জনপ্রিয় ক্রিকেটার তো মাশরাফি ছাড়া বাংলাদেশে আর কাউকে দেখা গেছে বলে মনে হয় না।

হ্যাঁ, আশরাফুলের প্রতিভা ছিল সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার। আমাদের সর্বকালের সেরা হওয়ার, আমাদের প্রথম বৈশ্বিক মহাতারকা হওয়ার। সৃষ্টিকর্তা সেই প্রতিভা তাকে দিয়েছিলেন। সে পারেনি কাজে লাগাতে। আসলেই সে আশার ফুল ছিল। তার হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেট সামনে এগিয়ে যাবে, এই আশায় ছিলাম আমরা। কিন্তু দেশকে এগিয়ে নেবে কি, সে নিজেই এগোতে পারেনি। কেন পারেনি? একসময় আমরা ধারণা করতাম, সে নির্বোধ। মাথায় বুদ্ধি কম। টেম্পারামেন্ট নাই। এইসব হাবিজাবি। এখন আমরা জানি, সে দিনের পর দিন ইচ্ছে করেই খারাপ খেলেছে। সে পারেনি, কারণ সে অসৎ। সে খেলাটার সঙ্গে, যে খেলায় তার এত প্রতিভা, সেই পবিত্র খেলাটার সঙ্গে বেঈমানি করেছে।

.................................................................

৯. সামনে কি?

তর্জমা:  সময়ই বলবে সামনে কি অপেক্ষায়। সে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে ২ বছর পর জাতীয় দলে ঢুকতে পারলে তার জন্য ভালো। যদি অসাধারণ, অভাবনীয় কিছু করতে পারে বাংলাদেশের হয়ে, তখন হয়ত তার দিকে একটু সানুগ্রহ দৃষ্টিতে তাকানো যাবে। আর যদি আগের মতোই অধারাবাহিক থাকে, তাহলে কারও কিছু করতে হবে না। এমনিতেই তাকে 'কিক আউট' করা হবে দল থেকে। তার মতো ধারাবাহিকতা দিয়ে একটা সময় বাংলাদেশ দলে খেলে যাওয়া গেছে। এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট সেসব দিন পেছনে ফেলে এসেছে!