• ফুটবল

হোসে মরিনহোঃ একচোখা আলোতে। পর্ব ১।

পোস্টটি ১৭৫৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ইউরোপের ফুটবলে নতুন জোয়ার আসি আসি করছে। স্পেনের ক্যাটালান প্রদেশ এ এফ সি বার্সেলোনার পাশে ভ্যালেন্সিয়া দাপটের সাথে উঠে দাড়াচ্ছে। দর্পের সাথে ইউরোপে হাটাচলা করছে দেপোর্তিভো লা করুনিয়া। ইটালীতে লীগের পড়তি শুরু হয়েছে।তার মাঝে দাড়ীয়ে এসি মিলান আভাস দিচ্ছে ইউরোপে দাপট অক্ষুন্ন রাখার।তবে সিরি এ তে ম্যাচ পাতানোর বিষবাষ্প ও যে একটু করে করে আসছে না তাও না। ইংলীশ ফুটবলে আর্সেনাল লিখছে এমন এক গল্প যা বছরের পর বছর ধরে ইনভিন্সিবল নামে বলা হবে। ফ্লেরেন্তিনো পেরেজ বছরে বছরে শক্তি বাড়ানোর নামে যাকে ইচ্ছা সাইন করাচ্ছেন সব মিলে সে এক অস্থির সময়। বলা হচ্ছে নতুন মিলেনিয়াম এর শুরুর দিকের কথা। মিলেনিয়াম চেঞ্জ এর প্রভাব ফুটবলে বেশ স্পষ্ট।

গল্পটা শুরু হোক মাদ্রিদ থেকে। রিয়াল মাদ্রিদ এর গ্রুপে পর্তুগীজ ক্লাব পোর্তো ছিল।৩-১ গোলে প্রত্যাশিত ভাবে রিয়াল মাদ্রিদ জিতেও গিয়েছিল তাদের সাথে দুই ফিক্সচার এর একটিতে। কিন্তু অন্যটিতে পোর্তো তাদের আটকে দেয়। ফ্লেরেন্তিনো পেরেজ এর খামখেয়ালীতে ভরা দলটি কোনদিন খুব ভালো খেলত। কোনদিন ভরাডুবি ঘটাত। তাই তেমন চোখে লাগেনি ব্যাপারটা। কিন্তু পোর্তো সেদিন ভাল খেলেই গোল করতে দেয়নি লস ব্লাঙ্কোস দের। রিয়াল মাদ্রিদে প্রথম হয়ে গ্রুপ থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যায়। আর পোর্তো হয় দ্বিতীয়, লস ব্লাঙ্কোস দের সেবারের ইউরোপিয়ান দৌড় শেষ হয় মোনাকোর সাথে দুই লেগ মিলে ৫-৫ গোলের এক থ্রিলার এর মাধ্যমে। যেখানে এওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে মোনাকো উঠে যায় সেমিফাইনালে।ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস দুই লেগেই গোল করে নিজের শৈশবের ক্লাবকে বিদায় করেন।কিন্তু তাদের দৌড় শেষ হয় ফাইনালে।কার কাছে? সেই পোর্তো! ভাবছেন ছোট দল হাচড়ে পাচড়ে উঠে গেছে? তাহলে শুনুন – পথের মধ্যে তাদের সামনে হেরে গেছে স্যার এলেক্স এর দাপুটে ইউনাইটেড। স্পেনের নতুন পরাশক্তি দেপোর্তিভো লা করুনিয়াকে টপকাতে হয়েছে তখন। ফ্রান্সের জায়ান্ট কিলার লিও কেও কোন অঘটন ঘটাতে দেয় নি সেই পোর্তো। তাতেও যদি মন না ভরে তাহলে শুনুন- রিয়াল মাদ্রিদ এর জালে ৫ বার বল ঠেলে দেয়া মোনাকোর সামনে জাল নিয়ন্ত্রনে রেখে ফাইনালে গুনে গুনে তিন গোল দিয়েছিল সেই পোর্তো।

ইউরোপ যখন প্রথমবার পদানত!
তা কে কে ছিল সেই দলে? ডেকো, রিকার্ডো কারভালহোরা ছিল বটে।আরেকটু এগুলে পবেন হোসে বসিঙ্গওয়াকে। তবে এরপরে বাকীদের নাম বললে আপনি মনে করতে পারবেন না।যেমন ওই সিজনে দলের টপ স্কোরার ২০ গোল করা বেনি ম্যাকার্থি নামে এক দক্ষিন আফ্রিকান ভদ্রলোক। তাহলে কী এমন জাদুবলে ঘরোয়া পর্তুগীজ আর ব্রাজিলের দ্বিতীয় সারির একদল খেলোয়াড় চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে গেল?লীগ আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এর ডাবল জেতা দলটি ঘরোয়া কাপ এও রানার আপ হয়েছিল। রহস্যের নাম হোসে মরিনহো।

পাগুলের সময়কে উপস্থাপন করতেই বোধ হয় আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে পাগুলে কোচ এর আবির্ভাব টা এই সময়। তো এই দল তো সফল হল। এরপরে মরিনহো মানেই সাফল্য। আরেকটু মোটা ব্রাকেট এ দেখলে instant success. মরিনহোকে আনবেন সফল দল পাবেন- এর মত ব্যাপার। এই ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়েছিল সাফল্যের জন্যে যা লাগে খরচে রাজি থাকা রোমান আব্রাহমোভিচ এর। সেই ভদ্রলোক আবার এক মৌসুম আগে চেলসি কিনে নিয়েছেন। আগে থাকা স্টার দের সাথে কিছু যোগ বিয়োগ ও করেছেন। লীগে দ্বিতীয় হয়ে নেহাত খারাপ ও করেনি দল। কারণ প্রথম হওয়া দলটা সেই ইতিহাস গড়া ইনভিন্সিবল আর্সেনাল। কিন্তু মন তার ভরেনি। তার দরকার সাফল্য। আর দ্বিতীয় হওয়া কোন সাফল্য নয়। তাই নরম সরম রানিয়েরিকে সরিয়ে ধরে আনলেন সেই পাগলাটে মরিনহোকে। পাগুলে সময়ের পাগুলে চ্যাম্পিয়ন।
 

মরিনহো এসেই একটা কাজ করলেন। সাফল্য টাফল্য আসার আগেই একটা ঘোষনা দিলেন। I am the special one. তারপরে প্রায় ৫০ বছর পরে লন্ডনের নীল অংশে শিরোপা এনে দিয়ে কথাটা যে ফাকা বুলি ছিল না সেটাও বুঝিয়ে দিলেন।মাদ্রিদে শুরু হওয়া গল্পটা এবার আমরা গল্পটা টেনে নিয়ে যাব বার্সেলোনাতে। এই যে সাফল্যের মডেল এই যে পাগলাটে একটা বিচরণ আর এই সীমাহীন আত্মবিশ্বাস মরিনহো কোথায় পেলেন এর গল্পটা আবার গাথা আছে ক্যাটালুনিয়াতে। বার্সেলোনা তখন ক্রুইফ এর প্রথম জমানার সুফল ভোগ করছে। ক্রুইফের পর অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসাবে চার্লস রেক্সাচ এর পরে ববি রবসন এসেছেন ক্যাটালান রাজধানীতে। ইংরেজ কোচের দোভাষী হিসাবে সাবেক সেমি প্রফেশনাল ফুটবলার হোসে মরিনহোর কোচিং এর আশেপাশে পদার্পন।

বার্সেলোনার মরিনহো। ভ্যান গালের সহকারী হিসাবে।

এরপরে লুই ভ্যান হাল এসে দেখলেন দোভাষীর কোচিং জ্ঞান টাও ফেলনা নয়। ক্যাটালানদের সেই সময়ের ফিলোসফি এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে পজেশনাল ফুটবল এর সেই ধারনা একটা একাডেমির মূলভাবধারা হিসাবে একদল নতুন ঘরানার ফুটবলার তো বটেই, এনেছিল একদল নতুন ভবিষ্যত কোচ ও। যাদের মধ্যে পেপ গার্দিওলা, লুইস এনরিকেরাও আছেন। আর আছেন একজন মরিনহো। সাফল্যের মডেলটা মরিনহো পেয়েছেন বার্সেলোনার দর্শনের আশেপাশেই। আর পাগলাটে ভাবটা কিছুটা ভ্যান হাল এর মত। কিন্তু সব যদি কপি করাই হবে তাহলে তিনি “স্পেশাল ওয়ান” কেন? 


তিনি স্পেশাল কারন তিনি বার্সেলোনার পজেশনাল দর্শনের ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে বিশ্বাস করেন। তিনি ভ্যান হালের শিষ্য কিন্তু যে ভ্যান হাল শেখান যে বক্সে ঢুকে ফার্স্ট টাচ এ শট নিতে নেই, সেখানে মরিনহো বলেন যত কম টাচ এ গোল করা যাবে তত নিখুত সে আক্রমণ। যে স্কুলের পিওর ছাত্র গার্দিওলা শেখান যত পার বল পায়ে রাখ, সেই একই স্কুলের পাশে বেড়ে ওঠা কোচ মরিনহো বলেন- বল যত প্রতিপক্ষের পায়ে থাকবে তত সে ভুল করবে। বল তাই নিজের পায়ে রেখো না। প্রতিপক্ষ বল নিয়ে থাকুক। তুমি জয় পেলেই খুশী থাক। আর তিনি স্পেশাল কারণ তিনি জয় চান। ব্যাপারটা সরাসরি প্রতিপক্ষকে ছিড়ে খুড়ে হোক বা ছলে বলে কৌশলেই হোক। ৬-৫ এ হারার চেয়ে ১-০ তে জিতে তিনি খুশী হবেন। মরিনহো মানে তাই সব সময় দৃষ্টিনন্দন ফুটবল নয়। মরিনহো মানে সব সময় স্পোর্টসম্যানশীপ নয়। মরিনহো মানে ১-০ গোলের জয়। মরিনহো মানে সাফল্য। মরিনহো মানে এক রহস্য। মরিনহো মানে খামখেয়ালীপনার মাঝে জয়ের জন্যে খেলা হাজার হাজার মাইন্ড গেম যার কিছু কিছু নোংরার এলাকাতেও ছড়িয়ে যাবে। মরিনহো এসবে তেমন পাত্তা দেন না। আজ তিনি বলবেন রোনালদো সেরা। কাল সেরা তিনেও তাকে রাখবেন না। কেন? কারণ আজ রোনালদো তার খেলোয়াড়। কাল সে অন্য দলের। মরিনহো শুধু নিজের দলটাই দেখবেন। তার সাফল্যের জন্যে সব করবেন। তিনি প্রফেশনাল। পাগলামী বা খামখেয়ালীও তার সেই প্রফেশনালিজমের অংশই। এখানেই মরিনহো আলাদা। এখানেই তার মত আর কেউ নেই।
অনেকেই ইকার ক্যাসিয়াস এর আত্মবিশ্বাস হারানোর পিছনে মরিনহোর এই বেঞ্ছে বসানোকে দায়ী করেন।

কিন্তু মরিনহো সাফল্যের কার্যকরী টনিক হলেও সাইড ইফেক্ট ছাড়া পথ্য তিনি নন। ওই যে বলছিলাম যে বার্সেলোনা দর্শনের ১৮০ ডিগ্রী উলটো চিন্তা করেন তিনি- সেই কারণে যুব প্রতিভা উন্নয়নে মরিনহো প্রায় এক বিভীষিকার নাম। মরিনহোর দলে খেলোয়াড় দুই ধরনের। যাদের পছন্দ করেন এবং যাদের পছন্দ করেন না। এর বাইরে কোন ক্রাইটেরিয়া নেই। পছন্দনীয় হতে তারকা হতে হবে বা প্রুভেন হতে হবে এমন নয়। তিনি তারকাদের মহাতারকা বানাতে পারেন। আবার অপছন্দের হলে কাকার মত প্রতিভার অপচয় করতে পারেন বা ইকার ক্যাসিয়াস কে বেঞ্চে বসাতে পারেন। তার চেয়ে যেটা চোখে লাগে- ফার্গুসন যেমন একটা ক্লাস অব ৯২ বড় করেছেন, লুই ভ্যান হাল যেমন জাভি ইনিয়েস্তাদের সুযোগ দিয়েছেন বার্সেলোনা মূল দলে, ইয়ুপ হেইঙ্কস যেমন মুলার, টনি ক্রুস দের ভিত্তি করে বায়ার্ন এর একটা জেনারেশান গড়েছেন মরিনহোর সিভিতে এমন কিছু নেই। তিনি নিজে দুটো আলাদা লীগের দল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতেছেন। লীগ শিরোপা যেসব দেশে ম্যানেজারিয়াল দায়িত্ব নিয়েছেন কোথাও বাকী নেই। কিন্তু ইয়ুথ কখনো এর পেছনে বড় কোন ব্যাপার ছিল না। আর মরিনহো অনেকটাই মার্সেনারী ঘরানার। ৩ বছরের বেশি এক ক্লাব সামলান নি। পোর্তো আর ইন্টার মিলান এ যেমন বিদায় নিয়েছেন সাফল্যের ছটা নিয়ে চেলসি (২ বার) আর রিয়াল মাদ্রিদ তাকে বরখাস্ত করেছে একটা পর্যায়ে গিয়ে হঠাৎ ক্যারিশমা হারানোয়। তিন বারেই পেছনে রেখে এসেছেন অসুখী ড্রেসিং রূম আর রহস্যজনক ব্যার্থ একটা করে সিজন।

এই সময় গুলোতে মরিনহো নিজের খেলোয়াড়দের পর্যন্ত আড়াল করেন না সমালোচনা থেকে। বরং প্রকাশ্যে এমন কিছু বলে বসেন যাতে সবাই বুঝে নেয় ওই চেয়ারে আর বেশিদিন তিনি নেই। এই পাগলামি কেন করেন মরিনহোই ভাল জানেন। এই কারনেই তিনি মরিনহো। তিনি রহস্য। তিনি পাগলামি।

(আগামী খন্ডে সমাপ্য)