• ক্রিকেট

রিভার্স ওয়াইন্ড ১

পোস্টটি ৪০৫০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

শিরোনাম দেখে ভাবছেন কি হতে পারে লেখার বিষয়বস্তু। আসলে রিভার্স ওয়াইন্ড বলে কোন টার্মস নাই। এইটা নিতান্তই আমার ভেজাল মস্তিষ্ক থেকে বের হইছে। রিভার্স ওয়াইন্ড দ্বারা আমি যেটা বুঝাতে চাইছি সেটা হলো ঘুর্নি ঝড়ে দেখবেন মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই বাতাসের গতিপথ বদলে যায়। যেইদিক থেকে বাতাস আসছিল সেদিকেই ঘুরে যায়।

ক্রিকেটেও সে রকম কিছু ঘটনা ঘটেছে যা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সে সব ম্যাচের কতক ম্যাচ নিয়েই আমার এই সিরিজ লিখা। আলোচনার শুরুতে বলি ক্রিকেট প্রেডিক্টেবল খেলা। দাড়ান ভাই রেগে যাবেন না। আগে ব্যাখ্যা করে নেই। সব খেলার একটা মোমেন্ট আসে যখন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে কি হতে যাচ্ছে খেলার ফলাফল। সেটাকে বলে প্রেডিক্টশন মোমেন্ট। অন্যান্য খেলায় এই মোমেন্টটা অনেক পরে আসে। কিন্তু ক্রিকেটে সেটা অনেক আগেই চলে আসে। ম্যাচের পরিস্থিতি দেখে মানুষ অনেক আগেই আঁচ করতে পারে কি হতে যাচ্ছে। সে কারণেই ক্রিকেটকে প্রেডিক্টেবল খেলা বলা। আর ক্রিকেটের মজাটা এখানেই।

অন্য খেলায় প্রেডিকশন মোমেন্টে আপনি যা প্রেডিক্ট করবেন তার ৯৫% ই বাস্তবে ঘটবে। কিন্তু ক্রিকেটে সেটা হবে ৮০%। অর্থাৎ আপনি যেটা প্রেডিক্ট করে রাখছেন ক্রিকেট আপনাকে বোকা বানিয়ে ঘটাবে আরেকটা। হরহামেশাই ক্রিকেটে এটা ঘটে থাকে। এ কারণেই ক্রিকেটকে আনপ্রেডিক্টেবল খেলা বলে। যাক অনেক বকবক করলাম। আপনারা এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে গেছেন। এবার কাজের কথাই শুরু করি।

৩১ মে ১৯৮৪। সেদিন ওল্ড ট্রাফের্ডে একটি ওয়ানডে খেলতে মুখামুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবিয়ানরা তখন তাদের সেরা সময়টা পার করছে। তারকায় ঠাসা দল। দলে ছিল ভয়ানক সব ব্যাটসম্যান আর আগুনের গোলা মারা ফাস্ট বোলার। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলপতি ক্লাইভ লয়েড ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বেচারার সিদ্ধান্তটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। ইংলিশ বোলাররা যেন সেদিন পণ করেই নেমেছিলেন সব গুড়িয়ে দিব। অহ বলাই হয় নি ম্যাচটি ছিল ৫৫ ওভারের। ব্যাটিং এ নেমে মাত্র ১১ রানেই সাজঘরে ফেরেন তখনকার তো বটেই সর্বকালের অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটি গর্জন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইন্স।

তখন উইকেটে চুইংগাম চাবাতে চাবাতে এলেন ভিভ। শুরুর এই ধাক্কা না সামলাতেই রিচার্ডসনকে কট & বোল্ড করে দেন উইলস। দলের রান মোটে তখন ৪৩। এবার ভিভ চেষ্টা করলেন গোমেজকে নিয়ে ইনিংস মেরামত করতে। কিন্তু বেচারা গোমেজ শুরুতেই ফেইল। মাত্র ৪ রান করেই বোল্ড হয়ে যান। এরপর এলেন ইয়া বিশাল গোঁফের অধিকারী সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। লয়েড-ভিভ জুটি তখন ক্রিজে। চিন্তা করেন একবার কি অবস্থা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাল করেই আছে ম্যাচে। কিন্তু ঐ যে সেদিন ইংলিশ বোলাররা পণ্য করে নেমেছিলেন সব গুড়িয়ে দিব। মাত্র ৮ রান করে লয়েডও রণে ক্ষান্ত দিলেন।

৮৯ রানে একটা দলের টপ অর্ডার উড়ে গেলে সে দল নিয়ে কারই তেমন প্রত্যাশা থাকে না। তখন একটাই চাওয়া টেনে টুনে কোনমতে সম্মানজনক একটা স্কোর দাঁড় করানো। এত কিছু হচ্ছে অন্য প্রান্তে ভিভ নির্বিকার। মুহূর্তেই তাকে একা রেখে সাজঘরে ফেরেন ডুযন, ম্যালকম মার্শাল। ১০২ রানেই ৭ উইকেট নেই। সম্মানজনক স্কোর গড়ার শেষ আশাটাও মিইয়ে গেল। কিন্তু এসবে যেন কোন ভাবনা নাই ভিভের। বোধকরি তিনি আগে থেকেই জানতেন কি হবে সেদিন। ৭ উইকেট পরার পরেই শুরু হল আসল প্রতিরোধ। ব্যাপতিস্তাকে নিয়ে পাল্টা জবাব দেন ভিভ। অষ্টম উইকেট জুটিতে আসে ৫৯ রান। এই ৫৯ রানের ২৬ ছিল ব্যাপতিস্তার। তখনও ভিভকে ঠিক ভিভ মনে হচ্ছিল না।

আসলে পরিস্থিতির কারণেই ভিভ বাধ্য হচ্ছিলেন রয়েসয়ে খেলতে। ১৬১ রানের মাথায় ব্যাপতিস্তা বোথামের শিকার হলে ভাঙ্গে এ জুটি। ভিভ তখন স্বপ্ন দেখছিলেন এ রকম আরেকটা জুটি গড়ে ফাইটিং স্কোর গড়তে। কিন্তু মাত্র ৫ রান যোগ হতেই জুয়েল গার্নার আউট হয়ে যান। শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে উইকেটে আসেন মাইকেল হোল্ডিং। উইকেটে কেবল এই দুইজনই। এর মানে হল একজন আউট হলেই খেল খতম। শেষ উইকেট জুটি থেকে দলের কোন প্রত্যাশা থাকে না। যা করবে খোদা করবে এই ভেবেই ভিভ শুরু করলেন তার স্বভাবজাত ব্যাটিং।

হোল্ডিং কে এক প্রান্তে রেখে বেধড়ক পেটাতে থাকেন ইংলিশ বোলারদের। ১৫০ তে গুটিয়ে যাওয়ার আশংকায় থাকা ক্যারিবিয়ানরা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। ভিভ করেন সেঞ্চুরি। এরপরই যেন ভিভ আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠেন। মাঠের চারদিকে বৃষ্টির মত বাউন্ডারি হতে থাকে। ইংলিশ বোলারদের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কিন্তু কিসের কি। ওভারের পর ওভার যায়। ভিভের থামার নাম গন্ধও নাই। ১৫০ ছাড়িয়ে ভিভ তখন ছুটে চলেছেন ডাবল সেঞ্চুরির দিকে। সে জমানায় ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরির নাম মুখে নেওয়াও পাপ ছিল। অনেকটা এখন টি টুয়েন্টিতে ডাবল সেঞ্চুরির মতই। সেদিন ভিভকে থামানো যায় নি। ওভারই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ৫৫ ওভার শেষে ভিভ অপরাজিত থাকেন ১৮৯ রানে। ২১ টা চারের সাথে ছিল ৫টা বিশাল ছক্কা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৭২। আর ২/১ টা ওভার পাইলে হয়ত ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ডাবল সেঞ্চুরির পাশে ভিভের নাম থাকত। শেষ উইকেট জুটিতে মাইকেল হোল্ডিং কে নিয়ে তুলেছিলেন ১০৬ রান। তাতে হোল্ডিং এর অবদান মাত্র ১২। তবে অপরাজিত থেকে হোল্ডিং ও দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন ভিভকে। নাইলে কি আর এমন মহাকাব্য লিখা হয় ভিভের। ওয়ানডে ইতিহাসে এটাই এখনও পর্যন্ত সেরা ইনিংস হয়ে আছে।

যে দল ১৫০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার আশংকায় ছিল তারাই ২৭২ রানের বড় স্কোর দাঁড় করায়। এইটা সম্ভব হয়েছিল শুধু ভিভের অতি মানবীয় ইনিংসের কারণেই। হোল্ডিং,গার্নার, মার্শালদের সামনে তো রীতিমত অনতিক্রম্য টার্গেট। ইংল্যান্ডও পারে নি সেটা অতিক্রম করতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা জিতেছিল ১০৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। শুধু একজনই যে সব ওলট পালট করে দিতে পারেন সেটা ভিভ দেখিয়েছিলেন।