আহত বাঘের গল্প
পোস্টটি ৪৭৮৯ বার পঠিত হয়েছেদৃশ্যপট একঃ দিনটা ১৮ মে, ২০১১। আভিভা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছে দুই স্বদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বী পোর্তো ও ক্লাব ব্রাগা। দুইটি দলের লক্ষ্য একটাই। তা হলো ইউরোপা লীগ। খেলা চলছে, কিন্তু হঠাৎ ৪৪ মিনিটে একটি কালো লম্বা চুলওয়ালা প্লেয়ার এর জ্বালাময়ী শট এবং গোল! পোর্তো ইউরোপা লীগের চ্যাম্পিয়ন। এই একটি গোলের সুবাদে জয় পায় পোর্তো। ম্যান অফ ম্যাচ সেই কালো লম্বা চুলের প্লেয়ারটি।
.
দৃশ্যপট দুইঃ প্রথম দৃশ্যপটের প্রায় ঠিক এক বছর পর। ৯ মে, ২০১২ সালে আরেনা নাশিওনাল স্টেডিয়ামে ভিন্ন স্বদেশীয় দুই প্রতিপক্ষ মুখোমুখি হয়েছে ঐ ইউরোপা লীগের লক্ষ্যেই। এবারের দুইটি দল হলো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও অ্যাটলেটিকো বিলবাও। ঐ ম্যাচে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ জয় পায় তিন শূন্য গোলের ব্যবধানে। খেলার ৭ ও ৩৪ মিনিটে দুইটি গোল আসে ওই কালো লম্বা চুলের প্লেয়ারের কাছ থেকেই। এবং ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ ও তাকে দেওয়া হয়। আর তিনি হয়ে যান ফুটবল ইতিহাসের প্রথম প্লেয়ার যে পর পর দুইটি ক্লাব থেকে পর পর দুই বছর ইউরোপা লীগ জয়ের স্বাদ পায়।
.
দৃশ্যপট তিনঃ দ্বিতীয় দৃশ্যপটের প্রায় তিন মাস পর ঠিক ৩১শে আগস্ট ২০১২ সালে ইউয়েফা সুপার কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ওই বছরের সেরা দুইটি ক্লাব চেলসি ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। সদ্য ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লীগ অনেকটাই দাপটের সাথেই জয় করে এসেছিলো চেলসি। আর অন্যদিকে ইউরোপা লীগ জয় করা আঃ মাদ্রিদ। মোনাকো স্টেডিয়ামে দুই ইউরোপিও সেরা ক্লাবের মধ্যে যে ম্যাচটি হয়েছিলো তা ২২জন প্লেয়ার দ্বারা খেলা হলেও খেলা টি ছিল শুধু তার! কার? ওই যে কালো লম্বা চুল ওয়ালা প্লেয়ার। ৬, ১৯ ও ৪৫ মিনিটে হেট্রিক করে তার দল হয়ে যায় ইউরোপে সেরাদের সেরা। ফলাফল ৪-১ এ জয় পায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। আর আবারও সেই কালো লম্বা চুলের প্লেয়ারই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ।
অনেকেই হয়তো এখন আঁচ করতে পেরেছেন কে হতে পারে সেই কালো লম্বা চুলের প্লেয়ার। তবুও তার সম্পর্কে বলা কয়েকটি কথা বলি---
He is a great player - his quality on the ball and the way he shots is really impressive --- Leo Messi.
.
He is one of the most important strikers in the world. He has improved a lot in last 3 or 4 years --- Mascherano.
.
He is the one of the Best player inside the penalty box --- Pep Gardioula.
এ রকম আরো অনেক শত শত বাণী লিখা যাবে তার প্রতি। আচ্ছা আমার সূচনাটা আরো বেশি দীর্ঘকায় করবো না।তার ডাক নাম হলো --" El Tigre" বা The Tiger অথবা তাকে কিং অফ ইউরোপা লীগও বলা হয়। তার আসল নাম রাদামেল ফ্যালকাও। এখন চিনেছেন তাকে?
.
বাবা রাদামেল গারছিয়া ছিলেন একজন ফুটবলার। ১৯৮৬ সালে যখন তার ঘর আলো করে একটি সন্তান আসলো তখন তিনি তার প্রিয় আইডল দ্যা ব্রাজিলীয়ান লেজেন্ড রবারতো ফ্যালকাও এর নামের সাথে মিল রেখে তার ছেলের নাম রাখেন রাদামেল ফ্যালকাও। জন্ম নেওয়ার পর থেকেই তিনি বেড়ে উঠেন ফুটবলের পরিবেশে। তার পরিস্রুতিতে এগার বছর বয়সে তৎকালিন ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব আয়াক্সে এসে ট্রায়াল দেন। কিন্তু নানা জঠিলতায় তাকে আর আয়াক্সে আসা হলো না। হয়তো তার ভাগ্যে অন্য কিছু লিখা ছিলো।
তারপর আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেট এ যোগ দেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিনিয়র ডেব্যু করে জানান দেন তার আগমনী বার্তা। তার ক্ষীপ্রতা, আক্রমণাত্মক ধারা দেখে তার টিমমেট গনজালো লুডেনা অনেকটাই ঠাট্টার সাথে তাকে একদিন "El Tigre " বা The Tiger বলে উঠলেন। হয়তো এই একটি কথাই ছিলো তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার পিছনের অন্যতম ভূমিকা।
এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তরুন ফ্যালকাও আস্তে আস্তে নিজের ক্ষীপ্রতা প্রকাশ করতে লাগলেন। ৯৩ ম্যাচে ৩৬টি গোল আর ৬টি এসিস্ট নিয়ে তরুন বাঘ শাবক আস্তে আস্তে শিকার করা শুরু করেছেন। এর মাঝে তিনি ২০০৮ সালে আর্জেন্টাইন চ্যাম্পিয়নও হয়ে যান। তখন তাকে দলে ভেড়াতে উঠে পড়ে লাগে আস্টন ভিলা এবং ইন্টার মিলান এর মতো ক্লাব।
কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে তিনি ২০০৯ সালে ৫.৪৩ মিলিওন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন পোর্তোতে। সেখানে সেখানে নিজের আগমনি বার্তা দিলেন নিজের মতো করেই। হন দুইবার পর্তুগীজ চ্যাম্পিয়ন, দুইবার পর্তুগীজ কাপ ও সুপার কাপ উইনার। এবং প্রবল প্রত্যাশিত ওই ইউরোপা লীগ। ওই দুইবারই ছিলেন ইউরোপা ও পর্তুগীজ লীগের টপ স্কোরার। এত কিছু পাওয়ার পর যখন তিনি তার সাবেক কোচে সিমিওনের ডাক পেলেন সব কিছু ছেড়ে তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে। হয়ে যান অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের রেকর্ড ট্রান্সফার ফির মালিক ৪০ মিলিওন ইউরোর বিনিময়ে। যখন চলে গেলেন তখন তার থলিতে ছিলো ৮৭ ম্যাচে ৭২ গোল ও ১৭ টি এসিস্ট পোর্তোর হয়ে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে এসে কি কি করেছেন তার উপরের দৃশ্যপট দুই ও তিন এ আবার চোঁখ বুলিয়ে নিবেন। তার সময়ে মাদ্রিদ ছিলো অদম্য শক্তিশালী। ৯১ ম্যাচে করেন ৭০ গোল ও ৯ টি এসিস্ট। ২০১২ সালে জায়গা করে নেন ফিফা বর্ষসেরা একাদশে।
ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে চলেন দেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দিকে। তারপর নিজের প্রিয় আইডল থিয়েরের অরির বাল্যক্লাব মোনাকোতে ৬০ মিলিওন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন। ততদিনে তিনি ইউরোপা লীগের বর্তমান টপ স্কোরার সাথে সবচেয়ে বেশি গোল র্যাশিও ০.৯৩ নিয়ে।
কিন্তু নিজেকে যখন ভাসিয়ে নিচ্ছিলেন অসীম শূন্যতায় তখন তার ক্ষীপ্রতার আকাশে দেখা দিলো ঘন কালো মেঘ। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের ঠিক আগের মূহুর্তে হাটুঁর ইঞ্জুরীর কারনে বাদ পড়ে যান বিশ্বকাপ থেকে। এরপর শুরু হয় তার অধঃপতন। ইঞ্জুরী এতোই প্রবল ছিলো যে ডাক্তাররা আশংকিত ছিলেন যে সে আর হাটঁতে পারবে কিনা না। কিন্তু তিনি ফিরে আসেন। তার ভালোবাসার কাছেই তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু তার জন্য দুইবার শানিত চাকুর কাছে তিব্র মাশুল দিতে হয়। কিন্তু অভিশপ্ত কালো মেঘ যেন তার পিছু ছাড়তেই চাইছে না।
বিশ্বকাপের পর লোনে যোগ দেন মানচেষ্টার ইউনাইটেড এ। কিন্তু ঘন ঘন ইঞ্জুরীতে পড়া তার উপর ইংলিশ ফুটবলের সাথে মানিয়ে নিতে না পারায় তাকে আহত বাঘ হিসেবে ২৯ ম্যাচে ৪ গোল আর ৫ টি এসিস্ট নিয়েই সন্তোষিত থাকতে হলো। এর পরের সিজনে আবারও লোনে যোগ দেন চেলসিতে। কিন্তু তার ক্ষত বিক্ষত ঘা এখনো শুকায় নি। ইঞ্জুরীতে পড়ার প্রবলতা আর ইংলিশ ফুটবলের সাথে মানিয়ে নিতে না পারা থেকেই গেল। যার ফলশ্রুতিতে ১২ ম্যাচে ১টি গোল নিয়েই সন্তোষ্ট থাকতে হলো। কিন্তু তিনি ততদিনে আহত দেহ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে হয়ে গেলেন কলম্বিয়ার ইতিহাসের সর্বোচ্চ টপ স্কোরার।
কথায় আছে লড়াকু বাঘ শত ক্ষত-বিক্ষতের পরেও এগিয়ে গিয়ে শিকার করতে জানে। তিনি হার মানলেন না, ঠিক যেমন লড়াকু বাঘ অতি সহজেই নিজের হার মেনে নেয় না। নিজের অধ্যবসায়, নিজের পুরাতন ক্ষীপ্রতা, আর আক্রমণাত্মক ভাবকে কাজে লাগিয়েই ফিরে এলেন সেই চির-চায়িত ফর্মে। এই সিজনে এখন পর্যন্ত ২৪ ম্যাচে ১৯ গোল আর ৩টি এসিস্ট করেই ফিরে এলেন সেই পুরাতন ফর্মে। তার নামের দাম রাখলেন। হয়তো, গনজালো লুডেনার সেই ঠাট্টা করে বলা "El Tigre" বা The Tiger শব্দটিকেই নিজের ফিরে আসার ধারক ও বাহক হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।
শুভ ৩১তম জন্মদিন "রাদামেল ফ্যালকাও" বাঘের মতো আগ্রাসী হয়ে বেঁচে থাকো বছরের পর বছর।
- 0 মন্তব্য