• ক্রিকেট

শততম টেস্টে বিজয়ঃ অভিজ্ঞতার ঝুলি আর তারুণ্যের বারুদ

পোস্টটি ৮২২০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
একটা টেস্ট ম্যাচ জিততে যা যা লাগে, তার সবকয়টা ছিল শততম ম্যাচে! ইংল্যান্ডের সাথে জয়ে তামিমের সেঞ্চুরি ছিল, মুমিন ইমরুলের ফিফটি ছিল; তবে দিনশেষে স্পিনের মায়াজালে খাবি খাওয়ানো মিরাজের বারো উইকেটই ম্যাচের নির্ধারক ছিল, এবং সেটা যে সব কন্ডিশনে সব প্রতিপক্ষের সাথে করা যাবে না তাও পরিষ্কার ছিল।
 
এই ম্যাচে শুভাশিষ আর তাইজুলের বোলিং বাংলাদেশের চিরন্তন বোলিং অ্যাটাকের রিপ্রেজেন্টেটিভ। শুভাশিষ খারাপ বোলিং করেছেন কেউ বলতে পারবে না: ভালো পেস, ভালো বাউন্স, হালকা মুভমেন্ট, লুজ বল বলতে গেলে দেনই নি। শুধু একটাই ইস্যু, ব্যাটসম্যান বিন্দুমাত্র থ্রেট অনুভব করেনি। রুবেল শফিউলরা অর্ধদশক ধরে তাদের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে যা করে যাচ্ছেন আরকি! তাইজুল দেশের সেরা তিনজন স্পিনারের একজন, তবু এই ম্যাচে প্রচুর লুজ বল দিয়েছেন, মাঝে মধ্যে দু'চারটা ভালো বল ছাড়া বাকি সবই নির্বিষ ছিল। শুভাশিষ তাইজুলদের ছোট করছি না, প্রতিদিন সবার সমান যাবে না এটাই স্বাভাবিক। তবু, প্রতীকী অর্থে শততম টেস্টে বাংলাদেশ বোলিং অ্যাটাকের একটি অংশ দেখিয়ে দিল কেন বাংলাদেশ জেতে না -- বিষ নাই বিষ নাই!
 
টেস্টে আপনাকে ২০ উইকেট নিতে হবে। সেটার জন্য শুধু ভালো পেস বাউন্সেও হবে না -- হোম ম্যাচে হয়তো মিরাজদের লেলিয়ে দিয়ে পার পেয়ে যাবেন, অ্যাওয়ে ম্যাচে ব্যাটসম্যানকে আউট করতে দরকার জেনুইন স্পেশাল বোলিং। যেটা আমরা এতকাল বিশ্বক্রিকেটে সময়ের সেরা বোলারদের করতে দেখেছি, দেখেছি একটিমাত্র স্পেশাল স্পেলে কীভাবে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়া যায়, সেটা যে কন্ডিশনেই হোক না কেন। সেই স্পেশাল বোলিং উপহার দিলেন মুস্তাফিজ। এখনও ছেলের অনেক কিছু শেখার বাকি, ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য ইনসুইঙ্গারটা ঠিক আয়ত্ত হয়ে উঠেনি। তাতে কী, স্পেশাল বোলার হওয়ার সেরা দুটো উপকরণ মুস্তাফিজের আছে, ব্যাটসম্যানের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকা বুদ্ধির দীপ্তি, এবং সেটা এক্সিকিউট করার কন্ট্রোল। রাউন্ড দ্য উইকেট বল করলেন, দিলেন আউটসুইঙ্গার, ঘুরালেন কাটার, পেস পরিবর্তন করলেন বুদ্ধিমত্তার সাথে। মরা পিচেও বল কথা বললো। শ্রীলংকার মাটিতে শ্রীলংকার টপ অর্ডার পারলো না এর উত্তর খুঁজে বের করতে। দ্য এক্স ফ্যাক্টর উই অলওয়েজ ড্রেমট অফ! 
 
মুস্তাফিজ এই স্পেলটা এক্সিকিউট করতে পারতেন না যদি অপর প্রান্তে কেউ প্রেশার রিলিজ করে দিতেন লুজ বল দিয়ে দিয়ে। সাকিব কী মাস্টারক্লাসটাই না দেখালেন! নিখুঁত লাইন লেংথে দম বন্ধ করে ছাড়লেন ব্যাটসম্যানদের, পেস কমিয়ে আনলেন, ফ্লাইট আর লুপ বাড়ালেন। খেয়াল করুন, সাকিব টি-২০’র দামি ক্রিকেটার, সেখানে বোলিং এর রেসিপি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা, জোরের উপর বল না করলে মার খাওয়া নিশ্চিত, টার্নের চেয়ে স্লাইডার বরং সেখানে সাকিবের রোজগার এনে দেয়। উনপঞ্চাশতম টেস্টে সাকিব দেখালেন অভিজ্ঞতার দামটা কোথায়, তিনি জানেন টেস্ট বোলিং-এ করণীয় কী, এই পিচে করণীয় কী, এবং সেটা করে দেখালেনও। চারটা জরুরী উইকেট, এবং সেগুলো হোম অ্যাডভান্টেজের বদান্যতায় পাওয়া নয়, জেনুইন স্পেশাল বোলিং করেই অর্জন করা। অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের দারুণ সুখকর মিশেল।
 
টেস্ট ব্যাটিং এ সবচেয়ে বেশি বলা হয় পার্টনারশিপের কথা, বলা হয়, অন্তত একজনকে লম্বা ইনিংস খেলতে হবে, বাকিদের সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। প্রথম ইনিংসে ৯৫, ৩৫, ৬২, ৯২, ১৩১, ৩৩ রানের জুটিগুলো দেখুন, সাকিবের সেঞ্চুরিটা দেখুন, সাথে মেলান সব স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের ৩০+ রান করাকে। দ্বিতীয় দিন শেষ বিকেলের পাগলামিটা বাদ দিলে রীতিমত অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়া ব্যাটিং কার্ড। অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের মিশেলটা এবার দেখবেন সাকিব মোসাদ্দেকের জুটিতে। তরুণ ব্যাটসম্যান অভিষেক ম্যাচে নেমে ধারাভাষ্যকারদের আহা-উঁহু করাচ্ছেন, সিনিয়র ক্রিকেটার ব্যাট উঁচিয়ে তালি দিয়ে উৎসাহ জানাচ্ছেন, যিনি নিজেও সেঞ্চুরি মেরে উদাহরণ সেট করেছেন। এনাফ সেইড! 
 
ফিল্ডিং হয়তো নিখুঁত ছিল না, তবে প্রথম ম্যাচের মত ক্যাচ মিসের মহড়াও দেখা যায়নি। বরং শততম ডিসমিসালের ম্যাচে মুশফিক উপহার দিয়েছেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কিপিং -- গ্রেট অ্যান্টিসিপেশন, পারফেক্ট এক্সিকিউশন। অভিজ্ঞতা-তারুণ্যের মিশেল এখানটায় দেখবেন মিরাজের একটি ওভার চলাকালে, স্ট্যাম্প মাইক্রোফোনে দর্শক শুনেছেন অধিনায়ককে বলতে, “ধৈর্য রাখ, ধৈর্য!”
 
ব্যাটিং-এ বড় পার্টনারশিপ, বড় ইনিংস, ফিল্ডিং-এ চোখ জুড়ানো ক্যাচ, বোলিং-এ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা স্পেশাল স্পেল -- কোনকিছুতেই কোন লাভ নেই যদি শেষটা ঠিকমত করতে না পারেন। টেস্ট জেতার শেষ হার্ডল, ফিনিশিং-- দ্য ফাইট উইথ ইওর অওন নার্ভ! হেরাথের দুই উইকেটের পর আজ দুপুরেই তো আমরা ভাবছিলাম, হাজার বছরের পুরনো সেই ধ্বস বুঝি আবারও ফিরে এল। সৌম্য সরকারের দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং যেকোনো দিন প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ম্যাচ বের করে আনতে সক্ষম, তবে নিজ ডিফেন্সের প্রতি সৌম্যর হয়তো আস্থা কম, শট খেললেই বরং ব্যাটে বলে জমে ঠিকমত। প্রেশার সিচুয়েশনে নার্ভ অত কথা শুনল না, উড়িয়ে খেলার সিদ্ধান্ত বুমেরাং হল। ইমরুলও কাটা পড়লেন নার্ভ হ্যান্ডল করতে না পেরে, নিজের সেরা দিনে হেরাথের ঐ বলটাতে যা খুশি করার সামর্থ্য অবশ্যই আছে ওর। যথারীতি, অভিজ্ঞতা তারুণ্যের মিশেলে এবার জবাবটা দিলেন তামিম সাব্বির জুটি। আনলাইক সৌম্য ইমরুল, দে ট্রাস্ট দেয়ার ডিফেন্স। পঞ্চম দিনে শ্রীলংকার পিচে হেরাথের বোলিং-এর বিপক্ষে খেলা -- তামিমের এই আশির দাম অন্য সময়ের একশ আশির সমান, লিখে রাখুন। অতিমানবীয় ব্যাটিং-এ প্রেশার পুরো তুলে দিয়ে গেলেন পরের ব্যাটসম্যানদের জন্য, ম্যাচ অফ দ্য ম্যাচ হওয়াটা পুরাই আসে। ওদিকে সাব্বিরের স্কিল, অ্যাবিলিটি নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়, তবে বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাটসম্যানের মত সাব্বিরও ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে লম্বা ইনিংস খেলা শিখে আসেনি। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে পঁচাত্তর ইনিংসে মোটমাট ৩টা সেঞ্চুরি, বড় ইনিংস খেলার অভ্যাস আদৌ আদৌ আদৌ নেই। এই পোস্টে টেস্ট জেতার রেসিপি নিয়ে লিখেছি, কিন্তু ভাই, টেস্ট *টানা* জিততে চাইলে কিন্তু রেসিপি ঐ একজায়গায়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট!
 
একদিন হবে, একদিন! 
 
260474.3