ক্রিকেট : একটি খেলা ও ৭০০ বছর ধরে চলমান বিবর্তনের সারসংক্ষেপ ...
পোস্টটি ৯৬৬৯ বার পঠিত হয়েছেবর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ক্রিকেট । এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার মত মহাদেশগুলোতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য পর্যায়ের আর উপমহাদেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেরই একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট । একবিংশ শতকের ক্রিকেট অনেকটাই উন্নত , অনেক পরিনত , নিত্যনতুন সংযোজন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে খেলাটাকে করে তোলা হয়েছে সময়পযোগি । উৎপত্তির পর থেকে আজকের অবস্থানে পৌছাতে অনেকটা পথ ভ্রমণ করতে হয়েছে খেলাটিকে , মাঝখানে কেটে গেছে কয়েকশত বছর । কেমন ছিল ক্রিকেটের প্রাথমিক দিনগুলো ? কিভাবে শুরু হল খেলাটার ? কেমনই বা ছিল তখনকার দিনের ব্যাট বল ? এ নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই ক্রিকেট পিপাসুদের ।এ লেখাটা তাঁদের জন্যই ,কিছুটা পিপাসা হয়ত মিটতেও পারে...
দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলাটা কঠিন, খেলাটা ঠিক কখন কারা কোথায় প্রথম খেলেছিল । কেননা সময়ের পরিক্রমায় সেই তথ্যটা ক্রিকেট ঈশ্বর ও সম্ভবত ভুলে গেছেন, তবে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের ব্যক্তিগত একটা নথি থেকে ১৩০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের কেন্টের চারণভূমিতে ক্রিকেট সদৃশ্য কোন একটা খেলা সম্পর্কে জানা যায় । দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডের মেষ চারণভূমিগুলোতে এই খেলাটার জন্ম বলে মত দেন অধিকাংশ ক্রিকেট ইতিহাসবিদ ।
চারণভূমিগুলোতে ছোট ছোট ঘাসের কল্যাণে কাপড়ের টুকরা বা পশমের তৈরি বলগুলোকে লক্ষের দিকে ছুড়ে মাড়াটা সহজ ছিল । তখনকার দিনে মেষগুলোকে আবদ্ধ করে রাখতে খোলা আকাশের নিচে লাঠির সাহায্যে ছাদবিহীন এক ধরনের ঘরের প্রচলন ছিল , সেই সকল ঘরের দরজাকেই লক্ষ্য বা উইকেট নিরধারন করেই বল ছোড়া হত। ব্যাট হিসেবে ব্যবহার করা হত রাখালের হাতের লাঠি । সে সময় স্থানীয় বিভিন্ন নিয়ম কানুনেই বিভিন্নভাবে চলত ক্রিকেট এবং সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে দারুন জনপ্রিয় হতে শুরু করে । ক্রিকেটের সেই দিনগুলোতে ফাষ্ট , আন্ডারআর্ম বলের প্রচলন ছিল এবং ব্যাট ছিল বর্তমান হকি ব্যাটগুলোর মত বাঁকানো ।অষ্টাদশ শতকে ক্রিকেট ব্যাটের আকারে পরিবর্তন আসে যেগুলোর প্রতিফলন আজকের আধুনিক ক্রিকেট ব্যাট ।
এর পরের সময়টাতে ক্রিকেট সমগ্র ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১৫৫০ সালে ইংল্যান্ডের গিল্ডফোরড এ ক্রিকেট খেলার প্রমান পাওয়া যায় ও ১৫৯৮ সালে ফ্লোরিওর ইটালিয়ান ইংলিশ ডিকশনারিতে ক্রিকেট শব্দটার অন্তর্ভুক্তি ঘটে । জাস্পার ভিনাল নামে ইংল্যান্ডের সাসেক্স এর এক ব্যক্তি যিনি কিনা হরস্টেড গ্রিন এলাকার অধিবাসী ছিলেন, ক্রিকেট খেলার সময় ক্রিকেট বল তালুবন্দি করতে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাটের আঘাতে মারা যান ।তিনিই ক্রিকেট মৃত্য বরণকারী প্রথম ব্যক্তি এবং ঘটনাটা ঘটে ১৬২৪ সালে । তারও ২২ বছর পর ইংল্যান্ডের গ্রামার স্কুল আয়োজিত এক ম্যাচের মাধ্যমে ক্রিকেট প্রথমবারের মত লিপিবদ্ধকরণ করা হয়।
উৎপত্তির পর থেকে ক্রিকেটের বিস্তার শুধু ইংল্যান্ডেই সিমাবদ্ধ ছিল, তবে ক্রিকেট বিশ্বজয়ের লক্ষে যাত্রা শুরু করে ১৬৭৬ সালের গোড়ার দিকে ।বিশ্বে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডের বাইরে সিরিয়ার আলেপ্পোতে আয়োজিত হয় এক ক্রিকেট ম্যাচ এবং তারও ২১ বছর পর অর্থাৎ ১৬৯৭ সালে সাসেক্স এ আয়োজিত এক ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিটি দলে নির্দিষ্ট ১১ জন খেলোয়ারের অন্তর্ভুক্তির মধ্যদিয়ে গঠিত হয় ক্রিকেটের প্রথম একাদশ ।
১৭০০ সালের ভিতর ক্রিকেট সমগ্র ইংল্যান্ডে প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেয় । ১৭০৬ সালে উইলিয়াম গোল্ডউইন নামে এক ব্যক্তি ক্রিকেট ম্যাচের প্রথম লিখিত বর্ণনা প্রকাশ করেন । সেখানে তিনি লিখেন "" দুইটা দলের প্রথম দেখা হয় একটি নির্দিষ্ট মাঠে , যেখানে তাঁরা এসেছিল তাঁদের বাকানো ব্যাট সঙ্গে নিয়ে, তাঁরা পিচ নির্ধারণ করে এবং খেলার নিয়ম ঠিক করে নেয় । পিচে ২ জোরা উইকেট স্থাপন করে এবং প্রত্যেক জোড়া উইকেট এ থাকে ২ টি করে কাষ্টখন্ড যেটাকে স্ট্যাম্প বলা হয় এবং যেগুলোর মাথায় থাকে দুধ সাদা রং এর বেল । একটি ধাতব মুদ্রার মাধ্যমে তারা প্রথম ইনিংস শুরুর জন্য টস করে এবং আম্পায়ার বলেন শুরু করো এবং "লেথান ওরব" প্রথম বলটি ছুড়ে মারে ।তাদের ৪ বলে এক ওভার হয় ,আম্পায়ার উইকেটের পিছনে দাঁড়ান এবং টিলা আকারের কিছুর উপর স্কোরবোরড স্থাপন করা হয়।
১৭০৯ সালে কেন্ট বনাম সারের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে প্রথমবারের মত ইন্টার কাউন্ট্রি ক্রিকেটের লিপিবদ্ধকরন শুরু হয় এবং তার এক বছর পরেই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট যাত্রা শুরু করে। ক্রিকেটের প্রথম লিখিত আইনের সূত্রপাত ঘটে লন্ডন ক্লাব এর হাত ধরে ১৭৪৪ সালে । যেখানে বলা হয় "" উপস্থিত ভদ্র মহাদয়গনের মতামতের ভিত্তিতে খেলার নিয়ম নীতি নির্ধারিত হবে এবং দুইজন আম্পায়ার অবশ্যই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা রাখবেন। ষ্ট্যাম্প এর উচ্চতা হতে হবে ২২'' এবং সেগুলোর উপর বেলের প্রশস্থতা হবে ৬''। ক্রিকেট বলের ওজন হতে হবে ৫ অথবা ৬ আউন্স এবং ২ জোড়া ষ্ট্যাম্পের মধ্যবর্তী দুরুত্ত হবে ২২ গজ ""। তবে এখানে ক্রিকেট ব্যাটের আকার সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায় নি ।
১৭৬০ এবং ১৭৭০ সালের মধ্যে ব্যাটসম্যানকে লক্ষ করে বাতাসে বল ছোড়ার পরিবর্তে মাটিতে বল ছোড়ার প্রচলন শুরু হয়। যার ফলে বোলাররা পূর্বের তুলনায় আরো বেশি গতিতে বল ছুড়তে শুরু করে পাশাপাশি বল ঘোরানো এবং সুইং করতেও সুবিধা পেতে থাকে। জবাবে ব্যাটসম্যানদের সুবিধা বিবেচনা করে এসময় বাঁকানো ব্যাটের পরিবর্তে সোজা ব্যাট এর প্রচলন শুরু হয় যার আধুনিকতম সংস্করন বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেট ব্যাট ।এরই মধ্যে ডরসেট বনাম রোথাম এর মধ্যকার এক ক্রিকেট ম্যাচে ""জন মিনসাল"" এর সৌজন্যে ক্রিকেট পেয়ে যায় তার প্রথম শতক, এটা ১৭৬৯ সালের ঘটনা । ১৭৭০ সালের পরে ক্রিকেট বলের ওজন সাড়ে পাঁচ আউন্স নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং ক্রিকেট ব্যাটের আকার ৪১/৪" নির্ধারণ করে দেয়া হয় ১৭৭১ সালে, তার ৩ বছর পরে ক্রিকেট প্রথমবারের মত পরিচিত হয় লেগ বিফোর উইকেট নামে এক আজব নিয়মের সাথে এবং তারও ২ বছর পরে ক্রিকেটে অফিসিয়ালি স্কোরবোরড এর যাত্রা শুরু হয় । বড় ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের সময়সীমা ৩ দিন নির্ধারণ করা হয় ১৭৮০ সালে।
অষ্টাদশ শতকেই ক্রিকেট বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে । ১৭৩০ থেকে ১৭৪০ এই ১০ বছরে ইংল্যান্ডের তৎকালীন পত্র পত্রিকাগুলোতে ১০০ টি ক্রিকেট ম্যাচ লিপিবদ্ধকরন হয়, ১৭৫০ থেকে ১৭৬০ এর মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে দাড়ায় ২৩০ এবং ১৭৭০ থেকে ১৭৭৯০ এই সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এই শতাব্দীতেই ক্রিকেটকে ইংল্যান্ড তার জাতিয় খেলা ঘোষণা করে ।
ক
উনবিংশ শতকে এসে ক্রিকেটে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৮০৭ সালে " জন উইলি" ক্রিকেটে স্ট্রেইট আরম বলের সূচনা করেন,এবং লন্ডনের বলস পণ্ড এ হ্যাম্পশায়ার বনাম সারের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে ১৮১১ সালে যাত্রা শুরু করে মেয়েদের ক্রিকেট একই বছর ওয়াইড ডেলিভারি নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৮৩৮ সালে প্রথমবারের মত বলের পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হয় ।
এবার এল বিশ্বে প্রথমবারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচনার মহেন্দ্রক্ষন। ১৮৪৪ সালে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট খেলে ফেলল ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ । ১৮৭০ সালের পূর্বে ক্রিকেট মাঠের কোন সীমানা ছিল না ।এসময় ব্যাটসম্যান বলে আঘাত করার পর রান সংগ্রহের জনয দৌরাতো এবং ফিল্ডার বল কুড়িয়ে ফেরত পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত রান সংগ্রহ করত। ১৮৭০ সালে এসে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ক্রিকেট মাঠের সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে ।
১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ মেলবোর্ন এ অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের খেলার মধ্যে দিয়ে বিশ্বে প্রথমবারের মত সূচনা হয় টেস্ট ক্রিকেটের। ৪ দিনের ওই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ৪৫ রানে জয় লাভ করে । ১৮১৬ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ক্রিকেটে বলিং এর ধরনে বেশ পরিবর্তন সাধিত হয়। এরই ভিতর ১৮৬০ সালে ক্রিকেট পেয়ে যায় তার প্রথম হ্যাট্রিক বোলার এবং " ডব্লিউ জি গ্রেস" নামে এক কিংবদন্তি প্রথমবারের মত ক্রিকেটে ১০০০ রান ও ১০০ টি উইকেট এর মাইলফলক পূর্ণ করেন ।
বিংশ শতকে এসে ক্রিকেট বিশ্বব্যাপী ছরিয়ে পরে। বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের প্রচার ও প্রসারের লক্ষে ইংল্যান্ড , অস্ট্রেলিয়া ,দক্ষিন আফ্রিকার উদ্যোগে গঠিত হয় "ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স", যেটি বর্তমানের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং যেটার বর্তমান নাম "ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল"।
ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটের আবির্ভাব ঘটে ভারতে ইংরেজ সম্রাজ্র বিস্তারের পর। ১৭২১ সালে ভারতের বারোদার নিকট ক্রিকেট খেলা প্রথম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৭৯২ সালে কলকাতায় "কলকাতা ক্রিকেট এবং ফুটবল ক্লাব" প্রতিষ্ঠীত হয় এবং দক্ষিন ভারতের সেরিঙ্গাপত্তমে আরেকটি একই ধরনের ক্লাব প্রতিষ্টীত হয় ১৭৯৯ সালে। এভাবেই সময়ের পরিক্রমায় ভারতবর্ষে ছরিয়ে পরে ক্রিকেট এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩১ সালে ভারতবর্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূচনা হয় পাশাপাশি একই বছর ক্রিকেট ষ্ট্যাম্পের উচ্চতা ও প্রস্থ ২৮/৯" নির্ধারণ করা হয়।
সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেটকে সময়পযোগি হিসেবে গড়ে তোলা হয় । যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি মেলবোর্নে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের মধ্য দিয়ে ক্রিকেট বিশ্ব দেখে ফেলে প্রথম একদিনের আওন্ত্রজাতিক ম্যাচ। যে ম্যাচে ৪২ বল হাতে রেখেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট জয় এ লাভ করে অস্ট্রেলিয়া।মজার বিষয় হল, তখনকার ওয়ান্ডে ম্যাচ গুলো হত প্রতি ইনিংস ৪০ ওভারের ।
২০০৫ সালের ১৭ ফেবরুয়ারি বিশ্ব দেখে ফেলল ক্রিকেটের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সংস্করণটাকেও। ইডেন পার্কের সেই টি ২০ ম্যাচটায় অস্ট্রেলিয়া ৪৪ রানে পরাজিত করে নিউজিল্যান্ডকে ।
ক্রিকেট বিবর্তনের এই যাত্রায় সময়ের সাথে সাথে বদলেছে ক্রিকেটের নিয়ম কানুন ,ফরম্যাট ,ব্যাট বল , খেলার সময়সীমা সহ আরো অনেক কিছুই । সম্প্রতি ক্রিকেটে লেগেছে প্রযুক্তির ছোয়া । সংযুক্ত হয়েছে থার্ড আম্পায়ার, ডি আর এস , রঙ্গিন পোষাক সহ নানবিধ সুযোগ সুবিধা , পাশাপাশি বেড়েছে খেলাটির জনপ্রিয়তাও । তবে এত কিছু বদলের ভিরেও বদলায়নি খেলাটির প্রতি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা । যেটাকে সম্বল করেই বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ছে ক্রিকেট । জয় করছে নতুন নতুন দেশ, জনপদ। জনপ্রিয়তার নিরিখে ছাড়িয়ে যাচ্ছে অন্য সকল খেলাকে।
ক্রিকেট, ঝিঁঝিঁ পোকা নয় কিন্তু...এটা ব্যাট আর বলের আলিঙ্গন ...
- 0 মন্তব্য