একজন সৌভাগ্যবান দর্শকের গল্প
পোস্টটি ৬০২৪ বার পঠিত হয়েছে১.
একজন প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ ব্যবসায়ী কর্মসূত্রে সেবছর ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ব্যবসার কাজকর্ম সব মেটানোর পর দেখলেন হাতে আরও একটা দিন বেশি পড়ে আছে। আবার সেই দিনই পড়েছে ভদ্রলোকের জন্মদিনটাও। সঙ্গে স্ত্রীও এসেছেন। তাই ঠিক করলেন আগামী দিনটি এখানেই কাটিয়ে তবেই দেশে ফিরবেন। বয়স তো আর কম হল না। এবার না হয় পূর্বপুরুষদের প্রিয় উপনিবেশেই জন্মদিনটা কাটুক। কিন্তু এই জন্মদিনটাই যে তাকে এক ঐতিহাসিক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী করে রাখবে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেন নি।
দিনটি ছিল ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। দিল্লীতে তখন শীতকাল চলছে। বেড়ানোর জন্য আদর্শ একটি দিন হলেও স্থানীয় বন্ধুবান্ধবরা জোর করছে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাওয়ার জন্য। খেলাটি যে তার বিশেষ অপছন্দ তা কিন্তু নয় তবে বিশেষ পছন্দও নয়। টিকিট কেটে সারাদিন মাঠে বসে থাকার মত ধৈর্য ওনার কোনকালেই ছিল না। ছেলেবেলায় খেলাটি প্রচুর খেলেছেন। এমনকি বাবার সাথে একবার ম্যাচও দেখতে গিয়েছিলেন। ওনার বাবা ছিলেন ক্রিকেটের একজন পাঁড় ভক্ত। শেষমেশ বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
২.
খেলা চলছে ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে। টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিন। ভারত বনাম পাকিস্তান। পাঁচ দিন ধরে খেললেও অনেক টেস্ট ম্যাচ অমীমাংসিত থেকে যায়। তবে এই ম্যাচের ফলাফল ছিল অনুমানযোগ্য। কেননা চতুর্থ দিনেই চতুর্থ ইনিংস শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের সামনে ৪২০ রানের লক্ষ্য। কিন্তু পিচের যা অবস্থা শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না খেলা পাঁচ দিন পর্যন্ত গড়াবে।
লাঞ্চ পর্যন্ত কোনো উইকেট পড়ল না পাকিস্তানের। খারাপ উইকেটেও বেশ ভালোই সংগ্রাম চালিয়ে গেল পাকিস্তানের ওপেনিং জুটি। তবে ভারতীয় বোলারদের দেখে ভদ্রলোকের বিশেষ সুবিধার ঠেকল না। লম্বামতন করে ওই স্পিনারটিকে তো কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগলো। স্পিনার তো নয় যেন ‘স্লো’ ফাস্ট বোলার! কেমন লাফাতে লাফাতে ছুটে এসে জোরের ওপর বল করে, ছোঁড়েও বল বেশ দ্রুত, কিন্তু ঘোরে কই। তবে হ্যাঁ বোলারটির একটা জিনিসে অস্বাভাবিক রকমের নিয়ন্ত্রণ আছে সেটি হল সোজা বল ছাড়ার যাকে বলে স্টাম্প টু স্টাম্প ডেলিভারি। যদিও তাতে কোনো লাভ হয়নি। ছয় ওভার বল করে ইতোমধ্যেই সে ২৭ রান দিয়ে ফেলেছে। দেখা যাক মধ্যাহ্নভোজন সম্পন্ন করে এসে কি খেল দেখাতে পারে সে।
লাঞ্চের পর সত্যিই সেই স্পিনারটি খেল দেখাতে শুরু করলেন। পরপর দু’দুটো উইকেট পতনের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গোটা গ্যালারি থেকে বার বার ভেসে আসছিল কুম্বলে! কুম্বলে! হ্যাটট্রিকটা যদিও করতে পারলেন না, তবুও মাত্র তিন ওভার বল করেই চার-চারটে উইকেট ঠিকই তুলে নিলেন লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলে। ভদ্রলোক বুঝলেন যে কেবল চরকির মত বল ঘোরানোতে কোনো কৃতিত্ব নেই। তার সাথে চাই লাইন, লেংথ, অ্যাকুরেসি আরও কত কি!
৩.
ইতিমধ্যে তার নয়টি উইকেটই নেওয়া হয়ে গেছে! কুম্বলে কি দশটা উইকেটই নেবে নাকি? এও কি কখনও সম্ভব হয়েছে? সমস্ত স্টেডিয়াম তখন উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছে! তার মধ্যে কুম্বলে আবার তখন 'অন আ হ্যাটট্রিক।' হ্যাটট্রিক করলেই দশে দশ! মাথার মধ্যে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। এগারো নম্বর ব্যাটসম্যানটা কি কুম্বলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে? আটকাতে পারবে কুম্বলেকে ইতিহাস গড়ার কীর্তি থেকে?
সমস্ত দর্শকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন বাইশ গজে, কিন্তু ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক। মাথার মধ্যে একের পর এক স্মৃতি ওই কুম্বলের বলের মতো বনবন করে ঘুরছে। এ কোন অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছেন তিনি? প্রায় তিন দশকের ব্যবসায়িক জীবনে কখনো শখ করে হলেও ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে মাঠে আসেন নি। বাবা নিয়ে গিয়েছিল সেই কোন ছেলেবেলায়। তারপর দীর্ঘসময় পর এই স্টেডিয়ামে আসা। হঠাৎ যেন বাবার মুখে শোনা একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর, “জেমস ওয়ালেস বার্কও শেষরক্ষা করতে পারেনি”।
কয়জনই বা পারে? ক্রিকেট ম্যাচে এরকম প্রায়শই হয়ে থাকে যে একজন ব্যাটসম্যান প্রবল প্রতিরোধ গড়েও শেষরক্ষা করতে পারেনা, জয় ছিনিয়ে নেয় প্রতিপক্ষ দল। এই ম্যাচেও না হয় তাই ঘটল। পিচের হাল দেখে এই ম্যাচের ফলাফল তো টসের সময়ই প্রায় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। টস জেতো, ম্যাচ জেতো। তাই একাদশ ব্যাটসম্যান ওয়াকার ইউনিসের কাছে বিশেষ কিছু আশা করা চলে না। কিন্তু তাকেও কি বাকি নয়জনের মত নিজের উইকেটটা অনিল কুম্বলেকেই দিয়ে আসতে হবে? ম্যাচ বাঁচিয়ে শেষরক্ষা করার চিন্তাটা তখন আকাশকুসুম কল্পনা কিন্তু উইকেটটা তো অন্য কেও নিতে পারে।
অবশেষে ওয়াকার ইউনিস কুম্বলের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন। কিন্তু বলি হতে হল অপরজনকে। পাকিস্তান ম্যাচটা হেরেই গেল তার সাথে অনিল কুম্বলেকে দিয়ে গেল এক ইনিংসেরই দশ দশটা উইকেট। বিশ্বরেকর্ড! ইংরেজ ভদ্রলোক আবেগে আপ্লুত। জন্মদিনের বিশেষ সারপ্রাইজ গিফটটা যে কখনো ভোলার নয়! পাশে বসে থাকা স্ত্রীও তার এই উত্তেজনা টের পেয়েছেন। স্ত্রীও ভালই উপভোগ করেছে ম্যাচটি। ভদ্রলোক উত্তেজনায় পাশের দর্শকটির সাথে গল্প জুড়ে দিলেন, “জানেন, সেই দশ বছর বয়সে বাবার সাথে একবার মাত্র ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম, আর এতোদিন পর...”।
ম্যাচ শেষ। দর্শকরা এবার উৎফুল্ল মনে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।
৪.
সাবেক ইংলিশ অফ স্পিনার জিম লেকারই বিশ্বের একমাত্র বোলার যিনি অনিল কুম্বলের অনেক আগেই একই রেকর্ডের নজির সৃষ্টি করেছেন এমনকি তার চেয়েও চমকপ্রদ নজির! এক ইনিংসে দশ উইকেট তো নিয়েছেনই! সাথে একটা গোটা টেস্ট ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে একাই নিয়েছিলেন ১৯ খানা উইকেট! সেই অনন্য কীর্তি গড়ার দিনেও অনেক ভাগ্যবান দর্শক মাঠে উপস্থিত ছিলেন। কী আশ্চর্য! রিচার্ড স্টোকস নামের সেই ইংরেজ ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি নাকি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিম লেকারের ১০ উইকেট নেওয়ার দৃশ্যও মাঠে বসে উপভোগ করেছেন!
সেই ১৯৫৬ সালের কথা। ১০ বছরের বালক রিচার্ড স্টোকস নাকি বাবার হাত ধরে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল। সেইটিই ছিল তার জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা আর এই নাকি ৪৩ বছর পর ফিরোজ শাহ কোটলাতে তার দ্বিতীয় ম্যাচ দেখতে আসা। যদিও তাঁর কাছে জিম লেকারের বেশিরভাগ স্মৃতিই এখন ঝাপসা তবে একটা জিনিস তার বেশ মনে পড়ে সেই ম্যাচে কুড়িটি উইকেটের মধ্যে একমাত্র যে ব্যাটসম্যানটি লেকারের হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলেন তার নাম ছিল জেমস ওয়ালেস বার্ক।
- 0 মন্তব্য