• ক্রিকেট

ডগলাস ম্যারিলিয়ারঃ স্কুপ শটের জনক

পোস্টটি ৫৪১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলা জিম্বাবুয়ে দলটাকে যারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের কাছে 'ডগলাস ম্যারিলিয়ার' নামটা মোটেও অপরিচিত লাগার কথা নয়। ডগলাস ম্যারিলিয়ার ছিলেন মূলত লোয়ার মিডল অর্ডারে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করা একজন অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার। পার্থ ও ফরিদাবাদে খেলা অসাধারণ দুটি ক্যামিও ইনিংসের জন্য তিনি ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অনেকে হয়ত ভাবছেন, কী এমন করেছেন তিনি। আজকে সেই গল্পই শোনাব আপনাদের।

আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পার্থের ওয়াকায় অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার শ্বাসরুদ্ধকর এক ওয়ানডে ম্যাচ দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। তুমুল নাটকীয়তায় ভরা সেই খেলায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে মাত্র ১ রানে হেরে যায় জিম্বাবুইয়ানরা। তবে সেই ম্যাচটিকে সবাই মনে রেখেছেন শুধুমাত্র ডগলাস ম্যারিলিয়ারের কারণে। বিখ্যাত সেই ম্যাচের শেষ ওভারটিই ছিল তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।

a202e77015ebaeae77fcac2e48b6761b

গ্লেন ম্যাকগ্রার করা ইনিংসের শেষ ওভারে মাত্র ৫ বল খেলে দুটি বাউন্ডারিসহ ১২ রানে অপরাজিত ছিলেন ম্যারিলিয়ার। কিন্তু সেই ৫ বলের ইনিংসে এমন কিছু উদ্ভাবনী শট খেলেছিলেন তিনি যা ক্রিকেটে কেউ দেখেনি আগে। ৩০৩ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে শেষ ওভারে যখন জয়ের জন্য প্রয়োজন ১৫ রান, তখন আগে কখনোই ম্যাকগ্রার মুখোমুখি না হওয়া ম্যারিলিয়ার ওভারের প্রথম ও তৃতীয় বলটিকে অফ স্টাম্পের দিকে সরে গিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাঁধের ওপর দিয়ে ফ্লিক করে অনায়াসে ফাইন লেগ সীমানা পার করেছিলেন।

ম্যারিলিয়ার উদ্ভাবিত অভিনব শটটি অনেকটা আজকালকার ক্রিকেটে দারুণ জনপ্রিয় 'স্কুপ', র‍্যাম্প' কিংবা 'ল্যাপ' শটের মত ছিল। পরবর্তীতে ম্যারিলিয়ারের নামেই ওই শটের নামকরণ করা হয় 'ম্যারিলিয়ার স্কুপ'। অনেকের মতে, ক্রিকেটে ল্যাপ বা স্কুপ শটকে জনপ্রিয় করার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল এই ম্যারিলিয়ারের। তাকে স্কুপ শটের জনকও বলেন কেউ কেউ।

ম্যারিলিয়ার ম্যাজিকের এখানেই শেষ না। ঠিক পরের বছরেই ভারতের ফরিদাবাদে অনুষ্ঠিত এক ওয়ানডেতে ২৭৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে জিম্বাবুয়ে তখন নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। দশম ব্যাটসম্যান হিসেবে ম্যারিলিয়ার যখন উইকেটে এলেন জয়ের জন্য জিম্বাবুয়ের চাই ৩২ বলে ৬৫ রান, হাতে ২ উইকেট। শুরু হলো টাটেন্ডা টাইবুকে সাথে নিয়ে ম্যারিলিয়ারের নিরন্তর লড়াই! কিছুক্ষণ পর টাইবু আউট হয়ে গেলেও থামেননি ম্যারিলিয়ার। ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান গ্যারি ব্রেন্টকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান শেষ পর্যন্ত।

034823

সেদিন মাত্র ২১ বলে ফিফটি পূরণ করেছিলেন ম্যারিলিয়ার। ২৪ বলে ১০টি চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ৫৬ রান করে দলের জন্য ১ উইকেটের অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে আনেন তিনি। এটি ছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা জয়। উইকেটের দু'পাশে বিশেষ করে ফাইন লেগ দিয়ে স্কুপ, সুইপ, ল্যাপ, র‍্যাম্প, ফ্লিক, প্যাডল কী ছিল না সেই ইনিংসে! ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা 'ক্যামিও' ইনিংসটিতে ইম্প্রোভাইজেশনের কোন কমতি ছিল না। ওই ম্যাচেই ৪ উইকেট নেয়া পেসার জহির খানের করা ৪৭ ও ৪৯তম ওভারে ম্যারিলিয়ার যে শটগুলো খেলেছিলেন তা হতবাক করে দিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। 'ম্যারিলিয়ার স্কুপ' শটে বল যখন একের পর এক সীমানাছাড়া হচ্ছিল জহির খানের বিস্ময়ভরা মুখের অসহায় অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল সব। শুধু জহিরই নন, তখনকার দিনে বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলার অনিল কুম্বলের বলে খেলা দারুণ সব ড্রাইভ, সুইপ ও লেটকাটের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। ম্যাচ শেষে যারপরনাই বিস্মিত ও হতাশ ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন তিনি জীবনে কোনদিন কাউকে এমন অদ্ভুত শট খেলতে দেখেননি।

14510186-58

ডগলাস ম্যারিলিয়ার তার ছোট্ট ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার এরকম ইম্প্রোভাইজড শট খেলেছেন। ক্রিকেটের প্রথম 'থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি' ব্যাটসম্যান বোধ হয় তিনিই। পরবর্তীকালে 'ম্যারিলিয়ার স্কুপ' শটটির মত স্কুপ বা ল্যাপ অনেকেই খেলেছেন। বিশেষ করে টি২০ ক্রিকেটের আবির্ভাবের পর অনেক ব্যাটসম্যান যেমন মোহাম্মদ আশরাফুল, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকরত্নে দিলশান, এবি ডি ভিলিয়ার্স, এউইন মরগ্যান, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, সাকিব আল হাসানরা স্কুপ ও ল্যাপ শটে দারুণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। দিলশান তো বিখ্যাত হয়ে আছেন তার আবিষ্কৃত 'দিলস্কুপ' শটের জন্য। তবে স্কুপ শটের জনক হিসেবে বিবেচিত ডগলাস ম্যারিলিয়ারকে কয়জনই বা মনে রেখেছেন?

043818

দুর্ভাগ্যক্রমে পর্যাপ্ত সুযোগ ও ধারাবাহিকতার অভাবে তিনি তার ক্যারিয়ার বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হওয়া ম্যারিলিয়ারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অধ্যায় থেমে গিয়েছিল মাত্র ৪৮ ওয়ানডে ও ৫ টেস্টেই। ২০০৩ এর এপ্রিলে শারজায় কেনিয়ার বিপক্ষে তার ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেন তিনি। ২০০৩ সালের জুলাইতে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে যেদিন তিনি সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেন তার বয়স তখন ছিল মাত্র ২৪ বছর। তার ক্যারিয়ারের এমন অকাল পরিসমাপ্তির পেছনে আর্থিক অনটনও একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে আর্থিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। ক্রিকেট ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ডগলাস। পরবর্তীতে এক সাক্ষাতকারে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা ও অতৃপ্তির কথা ব্যক্ত করেন তিনি। অবসরের পরের সময়টাতে ক্রিকেটকে কতটা মিস করতেন সেটা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।

মজার ব্যাপার হল, ম্যারিলিয়ার তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন ওপেনার হিসেবে। অভিষেক ম্যাচেই অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের সাথে ৮৩ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়েন তিনি। তরুণ বয়স থেকেই স্থানীয় কোচরা ম্যারিলিয়ারকে অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার হিসেবে দেখতেন। বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেটে পারফরমেন্স দিয়েই তার প্রতিভার স্বাক্ষরও তিনি রেখেছিলেন। ১৯৯৬ সালে জিম্বাবুয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন তিনি। সেই ট্যুরের এক ওয়ানডে ম্যাচে সতীর্থ মার্ক ভারমিউলেনের সাথে ওপেনিং জুটিতে ২৬৮ রানের বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন তিনি।

ম্যারিলিয়ারের ব্যাক্তি জীবনও তার ক্যারিয়ারের মতোই নাটকীয়তাপূর্ণ ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে হারারেতে মারাত্মক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু ও বন্ধুর পরিবারের কয়েকজন সদস্য সেই একই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল। দুর্ঘটনায় ম্যারিলিয়ারের দুটো পা'ই ভেঙ্গে গিয়েছিল। প্রায় এক বছর ধরে তাকে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ হয়ে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। এ রকম একটি ভয়াবহ ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা যার জীবনে এসেছে সে তো সহজে দমবার পাত্র নয়। ক্রিকেটে ফিরে এসে দ্রুত পারফর্ম করে জিম্বাবুয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা করে নেন তিনি।

শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে ম্যারিলিয়ারের মত ক্রিকেটারকে বিচার করা সম্ভব না। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেনই মাত্র তিন বছর। পরিসংখ্যান বলবে তার ওয়ানডে গড় মাত্র ১৮ কিন্তু বলবে না যে বেশিরভাগ সময়ে লোয়ার অর্ডারে খেলা অদম্য সাহসিকতার অধিকারী এই ব্যাটসম্যান একজন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার ছিলেন। ভয়ডরহীন 'নাথিং টু লুজ' মানসিকতার এককালের দারুণ সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটার হাজারো ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন।