• ক্রিকেট

গর্ডন গ্রিনিজঃ একজন জীবন্ত কিংবদন্তীর গল্প

পোস্টটি ৫৮৭৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মের কথা উঠলে অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হয় গর্ডন গ্রিনিজের নাম। সত্তর আশির দশকে ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা ক্লাইভ লয়েডের কালজয়ী দলের অন্যতম সদস্য তিনি। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেন, তিনি ক্রিকেটের ইতিহাসেরই সর্বকালের সেরা ওপেনারদের একজন। গ্রিনিজের ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। টেস্ট ক্রিকেটে ডেসমন্ড হেইন্সকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক উদ্বোধনী জুটি; যার কীর্তিগাথা আজও ক্রিকেটীয় রূপকথার অংশ হয়ে আছে।

236347

ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনিং জুটির তালিকা করলে গর্ডন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইন্স জুটির স্থানটা ওপরের দিকেই থাকবে। ৮৯ টেস্টের ১৪৮ ইনিংসে উদ্বোধন করতে নেমে দুজনে মিলে সংগ্রহ করেছেন ৬৪৮২ রান যা টেস্ট ক্রিকেটে যেকোন ওপেনিং জুটিতে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড। এই জুটির ১৬টি শতরানের পার্টনারশিপের মধ্যে ৪টি ছিল দুই শতাধিক রানের। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এন্টিগা টেস্টে সর্বোচ্চ ২৯৮ রানের জুটি গড়েছিলেন দুজন।

আধুনিক ব্যাটিংয়ের অন্যতম রূপকার গর্ডন গ্রিনিজ ছিলেন টেকনিক্যালি নিখুঁত একজন ব্যাটসম্যান। তাঁর ব্যাটিং স্টাইলকে বলা হয় ইংরেজ রক্ষণের সাথে ক্যারিবীয় আগ্রাসনের এক অদ্ভুত যুগলবন্দী। গ্রিনিজের ছেলেবেলাটা কেটেছে ইংল্যান্ডের রীডিং শহরে। সেখানেই আয়ত্ত করেছেন রক্ষণ সামলানোর যাবতীয় কলাকৌশল। যার কারণে ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই তাঁর ডিফেন্স ছিল কম্প্যাক্ট ও রক সলিড যা একজন আদর্শ ওপেনারের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। ডিফেন্সিভ টেকনিক খুব স্ট্রং হলেও গ্রিনিজ কিন্তু মোটেও রক্ষণাত্মক ব্যাটসম্যান ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন আগাগোড়া একজন মারকুটে খুনে মেজাজের ব্যাটসম্যান। তাঁকে বলা হয় সর্বকালের সবচাইতে বিধ্বংসী ওপেনারদের একজন।

ওপেনার হিসেবে গ্রিনিজ আদর্শ মানতেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তী রয় ফ্রেডেরিকসকে। রয় সম্পর্কে গ্রিনিজের বক্তব্য ছিল, "Roy was a dashing player, would almost play a stroke at every ball he faced. He was very courageous. It didn't matter who was bowling, how quick, he would challenge them."

গ্রিনিজের অন্যতম ট্রেডমার্ক শট ছিল পাওয়ারফুল স্কয়ার কাট। বিশেষত পয়েন্ট ও গালির মাঝখান দিয়ে 'স্কয়ার কাট' খেলার রীতিমতো মাস্টার ছিলেন গ্রিনিজ। আর সেগুলোতে টাইমিং হত দুর্দান্ত; প্লেসমেন্ট ছিল নিখুঁত। তাঁর মত অমন ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন স্কয়ার কাট ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোন ব্যাটসম্যান খেলেছেন কিনা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে গ্রিনিজ ছিলেন বরাবরই দারুণ আত্মবিশ্বাসী। টেকনিক্যালি সাউন্ড হওয়ার পাশাপাশি নতুন বলে সুইং সামলানোয় তাঁর ছিল বিশেষ পারদর্শিতা। বলের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে যতটা সম্ভব সোজা ব্যাটে খেলতেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে ইংলিশ পেসারদের বিপক্ষে তাঁর খেলা স্ট্রেট ড্রাইভগুলো ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি সবসময় বলতেন, "Strokeplay should be purposeful. If you're going to hit the ball, hit it."

ফাস্ট বোলারদের দ্রুতগতির বাউন্সারে মোটেও ভয় পেতেন না গ্রিনিজ। হুক ও পুল খেলার জন্য সবসময় রেডি রাখতেন নিজেকে। বারবাডোজের ফাস্ট বাউন্সি উইকেটে খেলে তিনি শিখেছেন কীভাবে বাউন্সার সামলাতে হয়। ব্যাকফুটে স্ট্রং বলে তিনি যে ড্রাইভ খেলতে জানতেন না তা কিন্তু নয়। ফ্রন্টফুটেও সমপরিমাণ দক্ষ গ্রিনিজ উইকেটের দুপাশেই চমৎকার ড্রাইভ খেলতেন। কাভার ড্রাইভ হোক কিংবা অন ড্রাইভ; তাঁর ড্রাইভগুলো হত খুবই পাওয়ারফুল। গ্রিনিজ ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে ক্লিন হিটারদের একজন। টিপিক্যাল ক্যারিবিয়ানদের মত গ্রিনিজ ছিলেন আগ্রাসনের পূজারি; আক্রমণই ছিল যার ব্যাটিংয়ের শেষ কথা।

bcc5ed3d9b2accc87fc9c41c94fc894ae92b3b37

গ্রিনিজের ভাষায়, " I liked to think of myself as someone who was going to take the fight to the bowler rather than the fight come to you."

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে গ্রিনিজের অভিষেক ১৯৭০ সালে কাউন্টির দল হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। হ্যাম্পশায়ারে খেলা অবস্থাতেই উদ্বোধনী জুটিতে পার্টনার হিসেবে পেয়েছিলেন বয়সে ৬ বছরের বড় প্রোটিয়া কিংবদন্তী ব্যারি রিচার্ডসকে। অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ কেমিস্ট্রি জমে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। রিচার্ডস-গ্রিনিজ জুটিকেই কাউন্টির ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটি মনে করেন অনেকে।

১৯৭৪ সালের কথা। কাউন্টিতে ফর্মের তুঙ্গে থাকা গ্রিনিজকে দলে নিতে ইংল্যান্ড তখন মরিয়া। এদিকে তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট খেলবেন। তার সামনে তখন দুটি রাস্তা খোলা। ইংলিশদের হয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার গড়বেন নাকি ফিরে যাবেন জন্মভূমিতে, প্রতিনিধিত্ব করবেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের। শেষমেশ দ্বিতীয় রাস্তাটিকেই বেছে নিলেন তিনি। ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের লোভনীয় প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে ১৯৭৪ সালে তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমি বারবাডোজে।

সেবার পাকিস্তান এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। পাকিস্তানের সাথেই একটা প্রস্তুতি ম্যাচে বারবাডোজের হয়ে ২৭৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেললেন ২৩ বছর বয়সী গ্রিনিজ। সেই ইনিংসের সুবাদেই ডাক পেয়ে যান ভারত সফরের টেস্ট দলে। একই সফরে প্রথমবারের মত ক্যারিবীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন স্যার ভিভ রিচার্ডসও। ১৯৭৪ সালে বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে একই ম্যাচে ভিভ রিচার্ডসের সাথে টেস্ট ক্যাপ মাথায় উঠেছিল গ্রিনিজেরও। ভিভ সেই ম্যাচে পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও (দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৪ ও ৩ রান) অভিষেক লগ্নটাকে স্মরণীয় করে রাখতে মোটেও ভুল করেন নি গ্রিনিজ। প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে হাঁকিয়েছিলেন অনবদ্য এক সেঞ্চুরি (১০৩)।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল গ্রিনিজের ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এই ৮ বছরে খেলা ৫৪ টেস্টে তাঁর অর্জন ১০ সেঞ্চুরি আর ২৩ ফিফটিতে ৫৩.৭ গড়ে ৪১৪০ রান। ১৯৭৭ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারও জিতেছিলেন গ্রিনিজ।

'৭৬ সালে ইংল্যান্ডকে তাঁদেরই ঘরের মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারানোয় বড় অবদান ছিল গ্রিনিজের। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৩ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিসহ ৬৫.৭৭ গড়ে গ্রিনিজের সংগ্রহ ছিল ৫৯২ রান।

ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে পাওয়া দুর্দান্ত ফর্মটা গ্রিনিজ ধরে রেখেছিলেন ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে দেশের মাটিতে আয়োজিত পাকিস্তান সিরিজেও। ৫ টেস্টে ৫৩.৬০ গড়ে ৫৩৬ রান করে ক্যারিবিয়ানদের ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ১ সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছিলেন ৪ হাফ সেঞ্চুরি।

১৯৮৩-৮৪ সালের বিখ্যাত 'রিভেঞ্জ' সিরিজে ভারতকে টেস্টে ৩-০ এবং ওয়ানডেতে ৫-০ ব্যবধানে হারায় ক্যারিবীয়রা। ৬ টেস্টের সিরিজে গ্রিনিজের সংগ্রহ ছিল ৫৭.৩৭ গড়ে ৪১১ রান। কানপুরের টার্নিং উইকেটে খেলেছিলেন ১৯৪ রানের অনবদ্য ম্যাচ উইনিং এক ইনিংস।

১৯৮৩ সালের ভারতের বিপক্ষে অ্যান্টিগা টেস্টে অপরাজিত ১৫৩ রানে ব্যাটিং করা অবস্থায় 'মৃত্যুপথযাত্রী' অসুস্থ মেয়েকে দেখতে মাঠ থেকে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ।

সেই ম্যাচের স্কোরকার্ডে গর্ডন গ্রিনিজের নামের পাশে প্রথমে 'রিটায়ার্ড আউট' লেখা হলেও মানবিকতার খাতিরে পরে সেটা পরিবর্তন করে লেখা হয় 'রিটায়ার্ড নট আউট'। ক্রিকেট ইতিহাসে 'রিটায়ার্ড নট আউট' হওয়া একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে অমর হয়ে আছে তাঁর নাম।

29058

১৯৮৪ সালের জুনে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে সিরিজের ২য় টেস্টে ২৪২ বলে ২১৪ রানের 'মহাকাব্যিক' এক ইনিংস খেলেন গ্রিনিজ। এটি ছিল টেস্ট ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি। অনবদ্য এই ইনিংসে ভর করেই শেষদিনে মাত্র ৭৮ ওভারে ৩৪২ রান তাড়া করার চ্যালেঞ্জে জিতেছিল ক্যারিবিয়ানরা। উল্লেখ্য, লর্ডসের ইতিহাসেও ওটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়লাভের রেকর্ড।

এরপর ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের ৪র্থ টেস্টেও ২২৩ রানের দারুণ একটি ইনিংস খেলেন তিনি। ক্যারিবিয়ানরা সেবার সিরিজ জিতেছিল ৫-০ ব্যবধানে। পরবর্তীকালে সিরিজটি 'ব্ল্যাকওয়াশ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসেও নিয়মিত রান পেয়েছেন গ্রিনিজ। ১৯৯১ সালে গায়ানার ব্রিজটাউনে তাঁর বিদায়ী টেস্টের আগের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেছিলেন ক্যারিয়ার সেরা ২২৬ রানের অসাধারণ একটি ইনিংস। তাঁর ওই ইনিংসের সৌজন্যেই অ্যালান বোর্ডারের শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে সেই ম্যাচে হারাতে পেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

প্রায় ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে গ্রিনিজ খেলেছেন ১০৮ টি টেস্ট ও ১২৮টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

১০৮ টেস্টে ৪৪.৭২ গড়ে তিনি রান করেছেন ৭৫৫৮। সেঞ্চুরি করেছেন ১৯টি আর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২২৬ রান।

গর্ডন গ্রিনিজ তাঁর টেস্টের সাফল্যটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও। পরিসংখ্যানও তাঁর হয়েই কথা বলে।

‘৭৫ আর ‘৭৯ বিশ্বকাপ জয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অপরিহার্য সদস্য গ্রিনিজ ১২৮ ওয়ানডেতে ৪৫ গড়ে রান করেছেন ৫১৩৪। ১১ টি সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি আছে ৩১টি। সর্বোচ্চ ইনিংস অপরাজিত ১৩৩ রানের।

ক্যারিবিয়ানদের হয়ে '৭৫ থেকে '৮৩ পর্যন্ত মোট ৩টি বিশ্বকাপ খেলেছেন গ্রিনিজ। বিশ্বকাপের ১৫ ম্যাচে গ্রিনিজের সংগ্রহ ৪৫.৫৬ গড়ে ৫৯১ রান। ৪টি ফিফটির সাথে আছে ২টি সেঞ্চুরিও। প্রথমটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অভিষেক সেঞ্চুরি; ১৯৭৫ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে এজবাস্টনে। আর দ্বিতীয় শতরানটি এসেছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ারের শততম ম্যাচে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বটি গর্ডন গ্রিনিজের। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংস খেলার পথে এই কীর্তি গড়েন তিনি।

ওয়ানডে ইতিহাসের চতুর্থ দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে গ্রিনিজ পেরিয়েছেন ১০০০ ও ৫০০০ রানের মাইলফলক।

byAFence

গর্ডন গ্রিনিজ যে একজন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার ছিলেন সেটা বোঝাবার জন্য একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। গ্রিনিজের ১১ ওয়ানডে সেঞ্চুরির ৯টিতেই জিতেছে তাঁর দল। আর টেস্টে? গ্রিনিজ সেঞ্চুরি করেছেন এমন একটি টেস্টও হারে নি এমনকি ড্র পর্যন্ত করেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ! অর্থাৎ তাঁর ১৯ সেঞ্চুরির সবকটিতে জয় পেয়েছে ক্যারিবিয়ানরা! তিনি টেস্টে ৬ বার আর সীমিত ওভারের ম্যাচে ২০ বার জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

১৯৯১ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া গ্রিনিজ পরবর্তীতে সফলতা পেয়েছেন কোচ হিসেবেও। টাইগারদের ঐতিহাসিক '৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় এবং '৯৯ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের নেপথ্য নায়ক ছিলেন এই বার্বাডিয়ান ভদ্রলোক।

১৯৯৭ সালে গর্ডন গ্রিনিজের মতো একজন বিখ্যাত ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব যখন বাংলাদেশের কোচ হয়ে এসেছিলেন, তখন পুরো জাতি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে বিভোর। কেনিয়াতে অনুষ্ঠিত '৯৪ আইসিসি ট্রফির ব্যর্থতা যখন আমাদের '৯৬ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নকে ভুলণ্ঠিত করেছিল, তখন এদেশের ক্রিকেটকে সাফল্য স্বপ্নে উজ্জীবিত করতে সুদূর বার্বাডোজ থেকে এসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের অন্যতম কাণ্ডারি গর্ডন গ্রিনিজ।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ার এসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এসিসি ট্রফির সাফল্যের পরপরই বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড আটঘাট বেঁধে নামে জাতীয় দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে লক্ষ্যে অসাধারণ এক পদক্ষেপ ছিল ক্যারিবীয় গ্রেট গ্রিনিজকে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। তৎকালীন বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই কেবল সম্ভব হয়েছিল সেটা। গ্রিনিজের জন্যও সেটি ছিল প্রথম কোন জাতীয় দলের হয়ে দায়িত্ব নেওয়া। তাঁর আসাটা এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে গ্রিনিজের ব্যাটিং দেখার সুখস্মৃতি তখনকার প্রজন্মের অনেকের মনেই তো টাটকা।

মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত '৯৭ আইসিসি ট্রফির পুরোটা সময় গ্রিনিজ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণার অফুরন্ত ভান্ডার। সেমিফাইনালে ওঠার পথে গ্রুপ পর্বের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচটা ছিল হল্যান্ডের বিপক্ষে; পেন্ডুলামের মতো দুলছিল সে ম্যাচের গতি-প্রকৃতি। হল্যান্ডের মামুলি টার্গেট তাড়া করতে নেমে মাত্র ১৫ রানেই প্রথম ৪ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকছিল বাংলাদেশ। পরবর্তীতে বৃষ্টির আনাগোনা, ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে বাদ পড়ার আশঙ্কা, মিলিয়ে ভয়ংকর স্নায়ুক্ষয়ী এক ম্যাচ ছিল সেটি। এই ম্যাচ হারলে যে বিশ্বকাপ স্বপ্নটাও ধ্বংস হয়ে যেত! অধিনায়ক আকরাম খানের অনবদ্য ৬৭ রানের ইনিংসের সুবাদে হল্যান্ড বাধা পেরিয়ে সেমিফাইনালে উঠে বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক দূর এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।

হল্যান্ডের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর সেই জয়ের ওপর ক্রিকইনফোর ম্যাচ রিপোর্টে বলা হয়েছিলঃ

“Gordon Greenidge crying. Just imagine a win that makes Greenidge cry; a man who had come from a different country, a different culture. The owner of one of the fiercest square-cuts ever seen, the man with the double-century on one leg, the man whose image first comes to mind when the words "beware the wounded batsman" are said; Greenidge cried after that win. That's how much it meant to the team.”

সেমিতে স্কটল্যান্ডকে সহজেই হারিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হয় বাংলাদেশের অগণিত ক্রিকেটভক্তের। ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে আরও এক ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। আরও একটি বৃষ্টিবিঘ্নিত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে কেনিয়াকে ২ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ ঘরে তোলে স্বপ্নের আইসিসি ট্রফির শিরোপা। সেই জয়ও আসে শেষ বলের নাটকীয়তায়!

একের পর এক স্নায়ুক্ষয়ী সেই মুহূর্তগুলো বাংলাদেশ সফলভাবে উতরাতে সমর্থ হয়েছিল কেবল গ্রিনিজের দূরদর্শিতা ও অভিজ্ঞতার গুণেই। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে অভিভাবক হিসেবে তাঁর মতো একজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দলের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিল। চাপের মুহূর্তে মাঠের বাইরে থেকে যেভাবে তিনি খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতেন, মনে সাহস জোগাতেন তা আজও অনেক ক্রিকেটারের স্মৃতিতে অম্লান। দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন গর্ডন। অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের সাথে তাঁর একটা আবেগময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

আইসিসি ট্রফি জয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ গ্রিনিজকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছিল। বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীর পর বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পাওয়া দ্বিতীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন গ্রিনিজ। নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গর্ডনকে দেওয়া হয়েছিল একটি পাসপোর্ট। গর্ডন সেই পাসপোর্টটি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন যত্নের সঙ্গে।

'৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের পর গ্রিনিজের অধীনেই বাংলাদেশ পেয়েছিল ওয়ানডে স্ট্যাটাস। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের আগে বেশ কয়েকটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তাঁর হাত ধরেই কেনিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে জয়। গ্রিনিজের অধীনে সাফল্য-ব্যর্থতা হাতে হাত মিলিয়েই এগিয়েছে। তবে তাঁর সময়ের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখার সুযোগ খুব কমই। বরং এদেশের ক্রিকেটে সাফল্য আসার রাস্তাটা নির্মিত হয়েছিল তাঁর হাতেই। গ্রিনিজের সময়েই ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ; মেহরাব হোসেনের ব্যাটে।

03

অচেনা ও কঠিন ইংলিশ কন্ডিশনে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্টে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্থানীয় কাউন্টি দলগুলোর বিপক্ষে সেবার তিনটি ম্যাচ খেলেছিলাম আমরা। এসেক্স আর আর মিডলসেক্সের বিপক্ষে দুটি জয় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল বাড়তি আত্মবিশ্বাস। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়টা আসে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে । তবে এরই মধ্যে ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটি ছিল নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেবারই প্রথমবারের মতো একটি টেস্ট দলকে হারালাম আমরা। ঐতিহাসিক জয়ের সেই ম্যাচটির কয়েক ঘণ্টা আগে গ্রিনিজের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বরখাস্তের নোটিশ। চাকরি হারানো গ্রিনিজ তবু সেদিন এসেছিলেন মাঠে; দেখা করে গিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয় শিষ্যদের সঙ্গে। যে কিনা দলটার পেছনে এতো পরিশ্রম করল, অথচ এত বড় একটা বিজয়ের আনন্দ উদযাপিত হয়েছিল তাঁকে ছাড়াই!

'৯৯ বিশ্বকাপের আগে থেকেই এদেশের ক্রিকেট প্রশাসকদের সঙ্গে কিছু ব্যাপারে গ্রিনিজের টানাপোড়েন চলছিল। বাংলাদেশ তখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে ব্যাকুল। অথচ বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো ছিল অনুন্নত; আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরুই হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে তাই টেস্ট মর্যাদার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন গর্ডন। গ্রিনিজের মত ছিল, টেস্ট খেলার জন্য বাংলাদেশ এখনো তৈরি নয়। আর তাতেই ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরাগভাজন হন তিনি।

তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এমন একটা দিনে যার একদিন পরেই জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটি লজ্জা দিয়েছিল সবাইকে। লজ্জার মাত্রাটা আরো বেড়ে গিয়েছিল, গর্ডন গ্রিনিজ বিশ্ব ক্রিকেটের একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব বলে। গর্ডন গ্রিনিজ যে মাপের ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব, তাঁকে এভাবে বিদায় করে দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটই অসম্মানিত হয়েছে।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলল, ভালো করল অথচ গর্ডন বিদায় নিলেন নিরবে, নিভৃতে, মাথা হেঁট করে। এই ঘটনাটি জাতি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু তো করেইনি, বরং গর্ডনের সেই বিদায় জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল।

বিদায়টা খুব সুখের না হলেও গ্রিনিজের মনে যে বাংলাদেশের জন্য একটা আলাদা জায়গা আছে, তার প্রমাণ মেলে ২০০০ সালে; বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের স্বর্ণালি ক্ষণে। সেবার বিসিবির বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি সস্ত্রীক বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই। সবকিছু ভুলে এদেশের মাটিতে তিনি সেবার পা রেখেছিলেন বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবেই। অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের দারুণ পারফরম্যান্স দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন গ্রিনিজ। উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছিলেন, "I am very happy for Bangaldesh and its players, who have done wonderfully well".

অভিষেক টেস্টে শতক হাঁকানো সাবেক ছাত্র আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে নিজের হোটেল রুমে ডেকে নিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন গ্রিনিজ। পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়ে স্নেহের আলিঙ্গনে সিক্ত করেছিলেন প্রিয় শিষ্যকে। আর বলেছিলেন, "Well played, but why did you get out? You should have kept your patience. After all it is not every day that you get a chance to make a real big score."

বাংলাদেশের কোচ হিসেবে কাটানো তিনটে বছর গ্রিনিজ কখনোই ভুলবেন না। শুধু ক্রিকেট নয়, এ দেশের মানুষের কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছেন, সেটাও হয়ত কোনদিন ভুলবেন না গ্রিনিজ। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, "বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্বটা ছিল কোচ হিসেবে আমার ক্যারিয়ারের প্রথম বড় দায়িত্ব। আমার সময়ে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতেছিল, যা তাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে আমার রয়েছে অনেক স্মৃতি। আমরা সবাই মিলে যা যা অর্জন করেছিলাম, তার জন্য আমি আজও গর্ববোধ করি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়েই আছে।"

গর্ডন গ্রিনিজকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে নিবেদিত প্রাণ বিদেশি কোচ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। এদেশের ক্রিকেটের আজকের উত্থানের পেছনে গ্রিনিজের অবদানকে অস্বীকার করবার কোন উপায়ই নেই।

১৯৫১ সালের পহেলা মে বার্বাডোজের সেন্ট পিটার নামক স্থানে জন্মেছিলেন মহান এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব। গত সোমবার ছিল তাঁর ৬৬ তম জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইল অনেক অনেক শুভকামনা। যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন।বাংলাদেশের ক্রিকেটপাগল মানুষ আপনাকে কোনদিনও ভুলবে না।