• ক্রিকেট

যুগের যুগান্তকারী রুপান্তর

পোস্টটি ৬৭৯০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পা তখনো কাঁপছিল। দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছি। আতহার আলীর ধারাভাষ্য মনে হচ্ছিল আরেকটি উইকেটের পতন ঘটিয়েই ছাড়বে। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই যততক্ষন পর্যন্ত না সাকিব বুকের উপর আসা একটি বল পিছনে পুল করে ছয় মেরে সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন। নিশ্চিত হয়ে গেছে খেলার ফলাফল। বারবার ক্রিকইনফোতে কমেন্ট করেও সেগুলা পিকড হচ্ছিলনা। যারা ইনিংসের শুরুতে কথা বলছিল বাংলাদেশের ম্যাচুরিটি লেভেল নিয়ে, তারা এখন উলটা সেটা নিয়েই প্রশংসা করছে। জয় তখনো মাত্র এক হাত দূরে। চায়লেই এক কদমে পার হওয়া যাবে। সাকিব করতে গেলেনও তাই। সেঞ্চুরির পরের ওভারের প্রথম দুই বলেই ব্যাক টু ব্যাক বাউন্ডারি - তাও আবার বোল্টকে যার রুদ্ররূপ দেখেছিল টপ অর্ডার। আরে ভাই থাম সাকিব, রিয়াদকেতো সেঞ্চুরি করতে দিবি। কথাটা শুনেই ফেলল মনে হয়। জয় থেকে মাত্র নয় রান দুরত্বে রেখে শেষ হলো সাকিব এর কাব্যিক, কৌশলী ও শৈল্পিক ইনিংস। গ্যালারিতে থাকা দর্শক করতালি শুনতে শুনতে বের হয়ে এলেন - হয়তো ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে। আউট করেও তাই হাত তালি দিতে ভুলেন নি ট্রেন্ড বোল্ট।

এদিকে তখনো মাহমুদুল্লাহ সেঞ্চুরি থেকে দুই রান দূরে। টাইগারদের অনেক বিখ্যাত জয়ের রুপকার তিনি। পর পর দুই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বধের নায়ক। এশিয়া কাপে যার কাঁধে ভর করে উঠেছিল ফাইনালে। কদিন আগে ত্রিদেশীয় সিরিজেও এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই খেলেছিলেন ম্যাচজয়ী সময়োপযোগী ইনিংস। তিনি আবারো এসে গেলেন দৃষ্যপটে, ত্রাতার ভূমিকায়। সাকিবের বিদায়ের পর মোসাদ্দেক এসেই যেন চায়লেন খেলা শেষ করে দিতে। কিন্তু তা কি হয়? দুই রানের পর সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রিয়াদকে। বোল্টের দীর্ঘ ওভারের এক বল বাকি। রান দরকার ছয়, মাহমুদুল্লাহর দরকার ২ রান সেঞ্চুরি পূরণ করতে। এই পর্যায়ে এসে মনে পড়ে গেল গত টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই তীরে এসে তরি ডুবানোর ম্যাচের কথা। দুইজন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান থাকতেও ৪ বলে ৩ রান ব্যার্থ হয় যার কারণ ছিল শেষে এসে আক্রমনাত্মক শট খেলা। কালও কিন্তু সাকিব শট খেলতে গিয়েই আউট হলো। কি জানি? রিয়াদ যদি এবারো ছয় মারতে গিয়ে টাইমিং এ ভুল করে ফেলে? সেটা না হয় একবার হয়ে গেছে, তাই বলে বাউন্ডারি মেরে খেলা শেষ করার অভ্যাসতো রিয়াদের জন্য নতুন কিছুনা। ভুল করলেন না, ছয়ই হয়তো মারতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এক ড্রপে সীমানা পার করার সাথে সাথে করলেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি এবং তিনটাই বিদেশের মাটিতে, অ-উপমহাদেশীয় দলের বিপক্ষে, আইসিসি ইভেন্টে। তিনি জানেন কত এতদূর আসতে কত বাধা পেরিয়েছেন। প্রায় দশ বছর ধরে জাতীয় দলে খেলেও মুল্যায়ন পাননি সাকিব তামিম দের মতো। দলকে জয়ের বন্দরে পৌছানো অনেক টেম্পারমেন্ট দেখানো ইনিংস খেলেও থেকে গেছেন আড়ালে। সেঞ্চুরিরর পর তাই সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না। আর ড্রেসিং রুমের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে কি যেন দেখালেন, হয়ত মাশরাফিকে উদ্দেশ্য করেই।

এরপরের ওভারের প্রথম বলে মোসাদ্দেকের ব্যাট থেকে আসা চারে নিশ্চিত হয় "শক্তিশালী" বাংলাদেশের বিজয়। স্ট্যান্ডে মাশরাফির উল্লাসে ফেটে পড়া। পরিচিত জায়গা মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, তাইতো। এখানেইতো আশরাফুলকে দেখেছিলাম উল্লাস করতে। সে কি উত্তেজনা, সে কি শিহরন। গতকালও সোফিয়া গার্ডেনে সেই শিহরনটাই ফিরে এসেছিল বাংলাদেশ দলের সমর্থকদের মনে। সেদিনও আমরা আমাদের সামর্থের প্রমাণ দিয়েছিলাম। গতকালও তাই। সেদিন আশরাফুল আর সুমনের জুটি ভীত গড়ে দিয়েছিল জয়ের। শেষে রফিক আর আফতাবের দৃড়চেতা ইনিংসে লাল সবুজের পতাকা উড়েছিল ব্রিটিশ রাজ্যে। কি অদ্ভুত! এক যুগ পরেও বাংলাদেশকে সেই সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে যাওয়া লাগছে। কিন্তু কালকের জয়ই কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের রুপান্তরকে একেবারে নিশ্চিত করেনা?

সেই ২০১৫ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড বধ থেকে শুরু। এরপর জয়হীন কোন সিরিজ কাটায়নি বাংলাদেশ। হেরেছে শুধু একটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ, ইংল্যান্ডের সাথে। এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলেছে। সিরিজ জিতেছে পাকিস্তান, ভারত, দঃ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে। তবুও সংশয় বাংলাদেশকে নিয়ে। দেখুন না, গতকাল ৩৩ রানে উইকেট পড়ার পরও মানুষ সহজে বলে দিচ্ছিল এই দলটা এখনো আগের মতোই রয়ে গেল। এতদিন যে ক্রিকেট বাংলাদেশ খেলে গিয়েছিল তার স্বীকৃতি যেন হাত থেকে ছুটেই যাচ্ছিল। কি হতো যদি বাংলাদেশের ইনিংস ১০০র বেশি না হতো? দ্বিপাক্ষীক সিরিজ কয়জনে দেখে? এটাইতো বিশ্বমঞ্চ, পৃথিবীর সব ক্রিকেট চোখ এখন এখানে। এখানে না পারলে কেউ বিশ্বাস করবেনা, করেওনা। আমরাও করিনা। সেই অবিশ্বাসের পর্দা সরাতেই যেন মিশনে নেমেছিলেন সাকিব-রিয়াদ। দুইটি অতিমানবীয় ইনিংস লিখল ক্রিকেটের একটি বীরত্বগাঁথা। দূর হলো সব শংসয়। কার্ডিফ সাক্ষী হয়ে থাকল আরেকটিবার। যুগান্তরে সম্পন্ন হলো বাংলাদেশের আরেকটি রুপান্তর। জায়ান্ট কিলার ট্যাগতো অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট পরাশক্তি। আর শুনতে চাইনা কোন সংশয় বাণী যেমনটি শুনা যাচ্ছেনা নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে - কারণ তারাও ক্রিকেট পরাশক্তি। এগিয়ে যাও মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ। তোমাদের হাতেই লেখা হবে আগামীদিনের বাংলাদেশ দলের জন্য কিংবদন্তিতূল্য গল্প।