ক্রিকেট ও একটি প্রজন্মের বেড়ে ওঠার গল্প
পোস্টটি ১০০৩৪ বার পঠিত হয়েছেসেই আকরাম খান থেকে আজকের সদ্য প্রজ্জলিত মিরাজ, যুগে যুগে খেলোয়াড়দের বিবর্তন আর ক্রিকেটের উন্নতির সাক্ষী হয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে সমর্থকদের একটি প্রজন্ম । যে প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট হচ্ছে দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় সমার্থক শব্দ, যে প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট হচ্ছে সবচেয়ে বৃহৎ আনন্দের উপলক্ষ্য, যে প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট হচ্ছে আবেগ প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় উপাদান ।
বলছি ৯০’ এর দশকের শুরুর দিকে জন্ম গ্রহণ করা কয়েক লাখ তরুণ তরুণীর কথা । যারা ক্রিকেট উন্মাদনার সাক্ষী সেই ৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি থেকে।জাফর উল্লাহ শরাফতের কণ্ঠে রেডিওতে শোনা “১ বলে ১ রান” এর রোমাঞ্চকে কে যারা এখনও তাদের জীবনের অন্যতম সেরা অ্যাডভেঞ্চার মনে করে। ক্রিকেটের জয় যাদের জন্য ছিল একদিনের স্কুল ছুটি, ঘুরতে যাওয়া আর রঙ মাখামাখির উপলক্ষ্য । যারা বড় হয়েছে, আবেগকে বুঝতে শিখেছে, বাস্তবতাকে মানতে শিখেছে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে।
৯৯ সালের বিশ্বকাপ এই প্রজন্মের প্রথম বিশ্বকাপ। মনে আছে আমি নিজে তখন সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি । স্কুল থেকে মসজিদ, পাড়ার সেলুন থেকে কাঁচাবাজার – সব জায়গায় সব বয়সী মানুষের মুখে তখন একটাই কথা - ক্রিকেট, বিশ্বকাপ আর বাংলাদেশ। অবস্থাটা এমন আমরা বুঝতে শিখলাম বাংলাদেশ মানেই ক্রিকেট, ক্রিকেট মানেই বাংলাদেশ । কোন সন্দেহ নেই, আজকের সাকিব,তামিম, মিরাজ, মোসাদ্দেক গড়ে ওঠার পিছনে সেই বিশ্বকাপ আর আইসিসি ট্রফির ভূমিকা অপরিসীম । সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো আর বছরখানেক পরেই টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যাওয়ায় ক্রিকেট এই প্রজন্মের কাছে এক রূপকথা বনে যায় ।যেখানে কোন দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ। প্রজন্ম বড় হয়, সাথে আমাদের ক্রিকেটও । আমরা রূপকথা ছেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসি ।
আমরা পরের ৫ বছর পরাজিত হতে থাকি, দেশের মাটিতে ,বাহিরের মাটিতে। একনাগারে, ক্রমাগত । ক্রিকেট বিশ্ব তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আমরা ব্যথিত হই, সমালোচনা করি কিন্তু ছেড়ে যাই না। কেউ কেউ উপরে উপরে বলি, “ক্রিকেট ? নো থ্যাংকস”, কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে টিভি ছেড়ে ঠিকই স্কোর চেক করি । কোনদিন দল ভাল খেলতে থাকে, লুকিয়ে না দেখে প্রকাশ্যেই খেলা দেখে সবাই । সবাই বলতে সবাই, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে রাগী শিক্ষক, থানার রাগী দারোগা থেকে হরতাল ডাকা রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সবাই । বুঝতে পারি , আবেগটা কমেনি একটুও উলটা বেড়েছে ।এরই মধ্যে বাংলাদেশ হঠাত একদিন জিম্বাবুয়কে হারায় , ৫ বছর পর, ২০০৪ সালে। আবার পোশাকে, রাস্তায় রঙ আবিষ্কার করি, বহুদিন পর স্কুল অর্ধেক হয়েই ছুটি হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে নয়, সবাই বিজয় উদযাপন করতে রাজপথে জড়ো হয়। বুঝতে পারি , ক্রিকেট এদেশের মানুষের কাছে, এ প্রজন্মের কাছে ধর্মের চাইতে কোন অংশে কম নয় ।দিন বাড়তে থাকে, আমরা ব্যস্ত হতে থাকি, কিন্তু যেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ থাকে- সেদিন স্কুলে ছাত্র কম থাকে, রাস্তা ফাঁকা থাকে এমনকি গৃহ শিক্ষকও টিউশন কামাই দেয় । আমরা প্রথম টেস্ট জিতি, কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারাই, ০৭ এর বিশ্বকাপে অহংকারী ভারতকে মাটিতে নামাই । ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি হয়, চায়ের আড্ডা গরম হয়ে উঠে, এমনকি ক্রিকেটকে সামানভাবে ভালবাসতে থাকা তরুণ তরুণীর মধ্যে হৃদয়জনিত ব্যাপারও ঘটে । আমরা বুঝতে পারি – ক্রিকেট আমদের বিনোদন নয়, অভ্যাস । যেই অভ্যাস কখনও ছেড়ে যাবে না ।
পথের পরিক্রমায় নিউজিল্যান্ডকে হোয়াটওয়াশ করে, ২০১২তে এশিয়া কাপ ফাইনালে খেলে, ২০১৫ বিশকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে , ২০১৬ তে টি টুয়েন্টি এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলে, দেশের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, ইংল্যান্ড-শ্রীলংকাকে টেস্টে হারিয়ে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে - বাংলাদেশ এখন অনেক বড় দল । বয়সের বিবেচনায় শৈশবে সেই ৯৯ এর বিশ্বকাপ দেখা প্রজন্মটাও অনেক বড় । হলফ করে বলতে পারি এই প্রজন্ম ক্রিকেটের মতো আর কোন কিছুকে এতো আপন করে ধারণ করে নি। এই প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বড় আবেগের নাম ক্রিকেট, সবচেয়ে বেশি সুখের দিন ক্রিকেটের একটি জয়ের দিন । আমরা ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখি , ক্রিকেটের সাথে অভিমান করি , ক্রিকেটের সমালোচনাা করি আবার ক্রিকেটের সাফল্যকে ব্যক্তিগত সাফল্যের চেয়ে এক ইঞ্চিও কম ভাবি না । ক্রিকেটই আমাদের সব অনুপ্রেরণার উৎস, এই ক্রিকেটই আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে আমরাও পারি, অবশ্যই পারি। ক্রিকেট আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভালবাসা, আমাদের ছোটবেলার ভালবাসা। সব ভালবাসা ভোলা যায়, শৈশবের ভালবাসা ভোলা যায় না ।
- 0 মন্তব্য