• ক্রিকেট

মিশন ২০১৯ বিশ্বকাপ

পোস্টটি ২৭৭১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

মাত্রই শেষ হলো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ডামাডোল । বৈরী আবহাওয়া এর মত বৈরী ছিল এবারের ম্যাচগুলোও । পরতে পরতে চমক দেখানো এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির চমক বজায় ছিল গোটা টুর্নামেন্ট জুড়েই । সবচেয়ে বড় চমক বোধয় ছিল এবারে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে ওঠা । হ্যা অনেকেই হয়তো পাকিস্তানের কথা বলবেন , কিন্তু  আনপ্রেডিক্টেবল নামের তকমা তো আর গায়ে এমনি এমনিই লাগেনি । আগের টুর্নামেন্টগুলোও তারা এভাবেই জিতেছে এবং এবারও যে এভাবেই ফাইনালে গেছে এবং জিতেছে সেটা আর নতুন কি , বরং প্রেডিক্টেবলই বলা যায় । প্রথমবারের মত সেমিফাইনাল খেলা অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার ছিল এবং বাংলাদেশ বাকি বিশ্বের সমীহও আদায় করে নিয়েছে । কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে এর পরের বিশ্বকাপ এই ইংল্যান্ডেই এবং সেক্ষেত্রে আমাদের এই পর্যন্ত আসায় কি কি ভুল ছিল সেটা ভুলে গেলে মোটেই চলবে না ।

                                                                                                                                                                                                        

প্রথমেই  ব্যাটিং  । স্পষ্টতই দুর্বলতা দেখা গেছে আমাদের ওপেনিং পার্টনারশিপে । প্রতিটা ম্যাচেই শুরু থেকেই প্রচুর ডট বল খেলেছে ওপেনারেরা । প্রথমেই আসি ইংল্যান্ডের সঙ্গে । প্রথম ১০ ওভার শেষে আমাদের রান ছিল মাত্রই ৩৬ । তাতে ছিল ৪ টি চার ও ১টি ৬ । ডট বল ছিল ৪৫ টি !! আর সেই ম্যাচেই ইংল্যান্ডের ১০ ওভার শেষেরান ছিল ৫১-১ । তাদের ডট বল ছিল ৩২টি । এখানেই দেখুন আমরা কিন্তু প্রায় ১৩ টি বল পিছিয়ে গিয়েছি । অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাংলাদেশের রান ছিল ১০ ওভার শেষে ৩৭-১ । সেখানে ছিল ৪ টি চার এবং ডট বল খেলা হয়েছে ৩৮ টি । সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ডট বল খেলেছিল ৩২ টি সাথে ছিল ৬টি চার । কিন্তু ১০ ওভার শেষে তাদের রান ছিল ৫৭-১ । এখানে দেখুন আমরা ৬ টি বল বেশি ডট খেলেছি মাত্র কিন্তু রান অস্ট্রেলিয়ার থেকে ২০ কম । এখানে আমরা ২০ টি রানে পিছিয়ে পড়েছি । অস্ট্রেলিয়া প্রথম ১০ ওভারের পাওয়ার প্লেতে রান তোলায় এতটাই উদগ্রীব ছিল যে , আমরা তাদের দৌড়িয়ে ৪ রানও নিতে দেখেছি মুস্তাফিজের প্রথম ওভারে । অথচ আমাদের সবচেয়ে বেশি ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান তামিমও কিন্তু শুরুতে যথেষ্ট ডট বল খেলেছেন । ১০ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার রান ছিল ৩৫ বলে ২৩ যাতে তিনি খেলেছেন ২১ টি ডট বল !! এখন যদি আমি বলি যে ,তামিমের এই ডটে যে প্রেশার ক্রিয়েট হয়েছিল সেটা সামাল দিতে গিয়েই ইমরুল কায়েস আউট হয়েছেন তাহলে কি খুব ভুল হবে ? তামিম যদি হালকা পুশ করে ওই ২১ বলে ১০টি রানও নিতেন তাহলে আমাদের রান হত ৪৭ । তখন ইমরুল ওরকম শট খেলার ঝুকি নিতেন ? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নাহয় প্রথম পাওয়ার প্লের কথা বাদ দিলাম , ধরে নিলাম ওটা হয়েছে ব্যাটিং কল্যাপ্সের জন্য । কিন্তু ওই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের ১০ ওভার শেষে রান কত ছিল জানেন ? ৬০-১ । ভারতের সঙ্গে ম্যাচে ১০ ওভার শেষে আমাদের রান ছিল ৪৬-২ , যেখানে ডট বল ছিল ৪০ টি । সেখানে ভারতের ডট বল ছিল ৩০ টি ,রান ছিল ১০ ওভারে ৬৩ । সতরাং ,প্রতিটি বড় দলের  সাথে তুলনায় দেখা যাচ্ছে যে আমরা তাদের চেয়ে কম হলেও ২০-১৫ রান ও বলে পিছিয়ে রয়েছি প্রথম ১০ ওভারে । প্রতিটা ম্যাচেই এটা খুব বড় প্রভাব ফেলছে । প্রতি দলেই ওপেনিং ব্যাটসম্যানের এখন লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষ বোলারকে ভড়কে দেওয়া শুরুতেই , কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই হচ্ছে । স্পষ্টতই এখানে মানসিকতাই প্রধান সমস্যা । এই মানসিকতার জন্যই পাকিস্তান ভারতের বিপক্ষে ১৭৫-১ উইকেট থেকে ৩৩৮ রান করে এবং আমরা ১৭৫-২ থেকে ২৬৪ করতেও অনেক কষ্ট হয় । সেই কেদার যাদব কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষেও বোলিং করেছে , সফল হয়নি কিন্তু  আমাদের বিপক্ষে হয়েছিল । আমাদের ম্যাচের শেষ ১০ ওভারে সবসময়ই সমস্যা ছিল , সেটার সমাধান এখনও খুব একটা হয়নি । ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ বাদে ,শেষ ১০ ওভারে খুব বেশি রান আমরা কোনো দলের বিপক্ষেই তুলতে পারিনি । তবে সে দোষ আমি খুব বেশি এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে দিব না , কারণ অনেক বড় দলের ক্ষেত্রেও এবার এই সমস্যাটা কিছু দেখা গেছে । কিন্তু প্রকটভাবে যেই সমস্যা দেখা গিয়েছে সেটা হচ্ছে সিংগেল তোলার মানসিকতার এবং সেটা আমাদের খেলা প্রথম ১০ ওভারগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে । সিঙ্গেলসে খেলে প্রেশার যে কতটা কমে ও স্টেবল পজিশনে চলে যাওয়া যায় সেটা তো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আমাদের আমাদের রিয়াদ ও সাকিবই দেখিয়ে দিলেন । টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই বোঝা যাচ্ছিল  তিন নম্বর পজিশনে সাব্বির কেন ব্যর্থ এবং চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তিনি সেটাই আরও ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন । আমার মনে হয় আমাদের ১৯ বিশ্বকাপের জন্য এই পজিশন নিয়ে জোরেশোরে ভাবা প্রয়োজন এবং খেলোয়াড়দের সিংগেলস বের করার উপায় নিয়েও অবশ্যই ভাবতে হবে ।

 

tamim-m

 

এবার আসি বোলিং এ । পুরা টুর্নামেন্টে পিচ ছিল ব্যাটিং সহায়ক । তাই বোলারদের নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই । এই টুর্নামেন্টে  আমাদের সবচেয়ে ইকোনমিকাল বোলার ছিলেন মাশরাফি এবং পুরা টুর্নামেন্টে মাশরাফি ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিবের ওই ১০ ওভার ছাড়া কাউকেই আমি মাথা খাটিয়ে  বল করতে দেখিনি । হ্যা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মোসাদ্দকের ওই স্পেলটাও দুর্দান্ত ছিল । মুস্তাফিজ পুরো টুর্নামেন্টেই নিজের ছায়া হয়ে ছিল , তাসকিন নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটি বাদে ভারতের সঙ্গে তেমন সুবিধা করতে পারেননি । তবে দুজনের উপর আমাদের যথেষ্টই ভরসা রাখা উচিত ,তাদের প্রতিভায় কোনো সন্দেহ নেই এবং  উন্নতির জন্য যথেষ্ট সময় সামনে  পড়ে আছে । কিন্তু রুবেলে  তার আস্থার প্রতিদান একেবারেই দিতে পারেননি । বয়স অনুযায়ী এখনই তার সেরা দেওয়ার সময় কিন্তু তিনি কোনো একটা কারণে তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেরাটা দিতে পারছেন না । এক্ষেত্রে , অবশ্যই বোলিং কোচের দোষ আছে , স্রেফ বাউন্সের সেই ৯০ সালের সময়ে যে বর্তমান ক্রিকেট নেই সেটা তাকে বুঝতে হবে । শুধুমাত্র গুড লেন্থে বোলিং করে যে কিভাবে এই পিচে ব্যাটসম্যানদের বেধে রাখা যায় সেটা পাকিস্তান ভারতের সাথে খুব ভালভাবে দেখিয়ে দিয়েছে । তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের শেষদিকের ওভারগুলোতে বোলিংও ভাল উদাহরণ হতে পারে ।  যেহেতু খেলা আবার এই ইংল্যান্ডেই হবে , তাই এই ব্যাপারটায় জোর দেয়া অবশ্য কর্তব্য । পাশাপাশি ফিল্ডিং এ জোর দেয়ার সময় এসেছে । পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়েই বলি , তাদের ফিল্ডিং নিয়ে কিন্তু যুগে যুগেই অনেক হাসিতামাশা হয়েছে , সেটার যথেষ্ট কারণও ছিল । সেই তারাই কিন্তু এবার ফিল্ডিং এ আমূল পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে এবং সেটা করে তারা দারুণভাবে সফল । আমাদের এবারের ফিল্ডিং ছিল বাজে এবং এটার খেসারত দলকে ভালভাবেই দিতে হয়েছে ।   

 

                                                                                                                                Maortaza

 

পরিশেষে যেটা বলতে চাই যে , ২০১৯ বিশ্বকাপকে ঘিরে আমাদের মাস্টার প্ল্যান করা উচিত । কারণ আমাদের এখন এই বিশ্বাস জন্মেছে  যে , টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনের সামর্থ্য আমাদের অবশ্যই আছে এবং এর জন্য প্রয়োজন তীব্র ইচ্ছা ও মানসিকতার পরিবর্তন । আমাদের অবকাঠামো যথেষ্টই বাজে এবং সময় এসেছে সেটা পরিবর্তনের । সাথে সাথে বিসিবির এটাও মনে রাখা উচিত যে , তারা বেতন দিয়েই কোচ রাখছে এবং সেজন্য কোচের কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্বও রয়েছে । খেলা না থাকলেই বাইরে গিয়ে ছুটি কাটানো এবং খেলার আগে এসে নেট ব্যাটিং  ও স্ট্যাটিক্টিস দেখে প্লেয়ার বাছাই করা বন্ধ করতে হবে । আসল খেলাটা নেটের পিচে হয় না এবং আমাদের ঘরোয়া লিগের মান তত উন্নত নয় যে , আপনি তিন বছরে একজন খেলোয়াড়ের গড় দেখেই তাকে দলে ঢুকাবেন । এদিকে বিসিবির নজর দেয়া খুবই প্রয়োজন । যেই পিচে ইংল্যান্ডে খেলা হবে , সেরকম পিচ বানিয়ে ব্যাটসম্যান ও বোলারদের প্রস্তুত করতে হবে । ব্যাটসম্যানদের সিংগেলস নিয়ে রানের চাকা সচল রাখা ও বোলারদের এই পিচেই  সুইং করা ও গুড লেন্থে বল করানো শেখাতে হবে । সবাইকে নিজের নিজের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে ও সেই অনুযায়ী কঠোর অনুশীলন করা প্রয়োজন । সেই অনুযায়ী কাজ করলে ১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল , চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলার পর ১৯ বিশ্বকাপে আমরা মাশরাফির কথামত আরও ভাল কিছু করার আশা করতেই পারি । ২০১৯ বিশ্বকাপই খুব সম্ভবত মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপ , তাই আরও ভাল কিছু মানে কি এবং সেটা করতে পারলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এই কিংবদন্তির বিদায়টা কেমন হবে সেটা হয়তো আপনি আমি বা বাংলাদেশের খেলোয়াড় কারওই অজানা নেই !