• ফুটবল

সর্বকালের সেরা স্কোয়াডের বিশ্বজয় আর হার না মানা কিছু রেকর্ড

পোস্টটি ৬৫৪১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
ব্রাসিল এমন একটা ফুটবল দল যারা কিনা ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দল এবং তাদের আছেও সর্বকালের সেরা স্কোয়াড। সর্বকালের সেরা দল ত ব্রাসিল, বুঝলাম। কিন্তু ব্রাসিলের আবার সর্বকালের সেরা স্কোয়াড কোনটা..? ১৯৫৮ বিশ্বকাপের দলটি নাকি ২০০২ এর রোনালদো রিভালদোর দলটি..?
যদিও আমরা সবাই জানি ব্রাসিলের আর ইতিহাসের সর্বকালের সেরা স্কোয়াড কোনটি। হ্যাঁ, সেই দলটি হলো ১৯৭০ বিশ্বকাপের ব্রাসিলের দল। এই দলটি শুধু ব্রাসিলের সেরা স্কোয়াড না, ফুটবল ইতিহাসের সেরা স্কোয়াড যারা করেছিলেন বিশ্বজয়, যারা বিশ্বকাপকে একেবারে নিজেদের করে নিয়েছিলেন, যেই দলটা সবুজ মাঠে ছবি এঁকেছিলো হাতের বদলে পা দিয়ে, যেই দলটা ফুটবল খেলাকে অ্যাখ্যা দিয়েছিলো "জোগো বনিতা" বা "বিউটিফুল গেইম" নামে। যেই দলটার প্রত্যেক পজিশনের প্লেয়ার ছিলো সর্বকালের সেরা প্লেয়ারদের কাতারে..!

                                                              আজ বলবো তাদের বিশ্বজয়ের কাহিনী..!
১৯৬২ বিশ্বকাপে নিজেদের ২য় বিশ্বকাপ জিতার পর ১৯৬৬ বিশ্বকাপের হট ফেবারিট ছিলো ব্রাসিল। কিন্তু সেই দলে পেলে-গারিঞ্চা-আমিরাল্ডো-জায়েরজিনহো থাকা স্বত্বেও লজ্জাজনক ভাবে হাঙ্গেরীর সাথে ৩-১ এর হার, পর্তুগালের সাথে ৩-১ এর হার আর মাত্র বুলগেরিয়ার সাথে ২-০ এ জয় নিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাসিল। সবাই ভেবেছিলো ইতালীর মতই ব্রাসিলের দুর্দশা এসে পড়েছে, যাদেরও কিনা পর পর দুবার বিশ্বকাপ জয়ের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু দলটা যে ব্রাসিল, যারা মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে, কিন্তু সাফল্য তাদের সব সময়.................!

১৯৬৬ বিশ্বকাপ ইউরোপ ঘুরে ১৯৭০ বিশ্বকাপের আসর বসে মেক্সিকোতে। বিশ্বকাপের নবম আসর। যেই আসরে পুরো বিশ্ব বুঝেছিলো ফুটবল একটি খেলার চেয়েও বেশী, বুঝেছিলো ফুটবল হলো ছন্দের খেলা কোন লাত্থালাত্থির খেলা না.....!

১৯৭০ বিশ্বকাপের আসর প্রথমবারের মত মেক্সিতো বসে। ১৬টি দল, ৫ টি ভেন্যু নিয়ে মেক্সিকো প্রথম আয়োজন করতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের নবম আসর। যেই বিশ্বকাপের হট ফেবারিট ছিলো হাঙ্গেরী, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, জার্মানের মত দল। ৩১এ মে থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মেক্সিকোর মধ্যকার খেলা দিয়ে শুরু হয় ৭০ এর বিশ্বকাপের যাত্রা আর শেষ হয় ২১এ জুন ব্রাসিল বনাম ইতালীর মধ্যকার ম্যাচের মাধ্যমে। ৩২ টি খেলার মধ্যে ৯৫টি গোল যার মধ্যে ছিলো ১ টি আত্মঘাতী গোল। পুরো বিশ্বকাপে দর্শক হয়েছিলো তৎকালীন রেকর্ড সংখ্যক ১৬ লক্ষ ৪ হাজার ৬৫ জন। প্রতি ম্যাচে গড়ে দর্শক হয়েছিলো ৫০ হাজার ১২৭ জন..!

১৯৭০ এর আসর ছিলো ব্রাসিলের জন্য সমালোচকদের জবাব দেওয়ার আসর যারা বলেছিলো ব্রাসিলের দিন শেষ। ৬২ এর কোচ মরেইরা চলে যাবার পর ৬৬ তে কোচ হয়ে এসেছিলো ভিসেন্তে ফেওলা। দল সেই বিশ্বকাপে লজ্জাজনক ভাবে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ হয়ে যাবার পর দলের কোচ হয়ে আসে সালদানহা। সালদানহার অধীনেই ব্রাজিল 1970 বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সব ম্যাচ খেলেছিলো এবং প্রতিটি ম্যাচ জিতেছিলো কিন্তু মিডিয়ার সামনে লাগামহীন কথাবার্তা আর প্রেসিডেন্টের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিশ্বকাপ শুরুর কিছুদিন আগে স্যাকড হন সালদানহা। তখন তড়িঘড়ি করে জাগালোকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যিনি ৫৮ ও ৬২ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাসিল দলের গুরুত্বপুর্ন সদস্য ছিলেন। সেই কিংবদন্তী ফুটবলার হলেন ব্রাসিলের কোচ। যিনি পেলের সাথে পাশাপাশি খেলতেন এখন তিনি সেই পেলেকেই শিক্ষা দিবেন। জাগালোর কোচ হয়ে আসা কিন্তু বেশী দিন না। ৬২ বিশ্বকাপের পর পর ই অবসরে যান জাগালো। তারপরই ৭০ বিশ্বকাপের কোচ। প্লেয়ার হিসেবে জিতেছেন টানা ২টি বিশ্বকাপ। কোচ হিসেবে কি তার প্রথম কোচিং ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপটি জিততে পারবেন..?

দলে এসেই দলকে নতুন ভাবে সাজান তিনি। ৫৮ থেকে ৬৬ বিশ্বকাপ খেলা প্লেয়ারগুলো বুড়িয়ে যেতে থাকে। গোলকিপার গিলমার, ডিফেন্ডার দেলমা, নিলটন সান্তোস, মিডফিল্ডার দিদি, স্ট্রাইকার ভাভা। একে একে সবাই বুড়িয়ে যেতে থাকেন।

তাই দলকে তিনি ঢেলে সাজাতে চেয়েছেন। স্কোয়াড থেকে বাদ দেন ইতিহাস আর ফুটবল মাঠ কাঁপানো গারিঞ্চাকে তার অফফর্ম আর বেখেয়ালী জীবন যাপনের জন্য। ফ্লুমেন্সিসের গোলকিপার ফেলিক্স, তৎকালীন অধিনায়ক সান্তসের কার্লোস আলবার্তো, সান্তোসের ক্লোডোলাল্ডো, বোটাফেগোর জায়েরজিনহো, সাও পাওলোর জারসন, ক্রুয়েজিরোর টোস্টাও, সান্তোসের পেলে, করিন্থিয়াসের এলাস্টিকো বয় রিভেলিনোদের নিয়ে তিনি সাজান তাঁর স্বপ্নের একাদশ। দলে নেই কোন বিগত বিশ্বকাপগুলোর সেরা প্লেয়ার শুধুমাত্র পেলে আর জায়েরজিনহো ছাড়া। দলের ফর্মেশন দিয়ে দিলেন ৪-২-৪ এর এক নান্দনিক ফর্মেশন.....!

এই সেই বিশ্বকাপ, যেই বিশ্বকাপ জয়ের পর বিশ্বকাপটি ব্রাসিল একেবারে তাদের করে নেন আর পেলের নাম তিনটি বিশ্বকাপ জিতা প্লেয়ারের নামে নামাঙ্কিত হয়..!

১৯৭০ এর বিশ্বকাপের ব্রাসিলের স্থান হয় গ্রপ সি তে। যেখানে রয়েছে গর্ডন ব্যাঙ্কস, জিওফ হার্স্ট, ববি চার্ল্টনের ইংল্যান্ড, ডিফেন্ডিং রানার্স আপ চেকোস্লোভাকিয়া আর রাডুর রোমানিয়া..!

৩জুন ১৯৭০।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে ব্রাসিল ঠিক ৬২ বিশ্বকাপের ফাইনালের প্রতিপক্ষ চেকদের সাথে। ৬২ বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট। সেদিন ত ব্রাসিল সফল হয়েছিলো। আজকে কি চেকরা তার প্রতিশোধ নিতে পারবে নাকি ব্রাসিল ই সফল হবে..? সবার মনেই একটা প্রশ্ন..

খেলার ১১ মিনিটেই পেত্রাসের গোলে এগিয়ে যায় চেকরা। সে কি উল্লাস চেকদের..! কিন্তু এটা ব্রাসিল..! ২৪ মিনিটে এলাস্টিকো বয় রিভেলিনোর গোলে এগিয়ে যায় ব্রাসিল। ৫৯ মিনিটে পেলের গোলে সেলেসাওরা ২-১ এ এগিয়ে যায়..! এরপর সাম্বার অসাধারন নৈপুন্যে ৬১ মিনিট আর ৮৩ মিনিটে জায়েরজিনহোর জোড়া গোলের চেকদের ৪-১ এ উড়িয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে সেলেসাওরা, যাদের পায়ে দেখা গিয়েছে ছন্দময় নান্দনিক খেলা, রিভেলিনোর চোখ ধাঁধানো এলাস্টিকো আর পেলের অসাধারন স্কিল আর জায়েরজিনহোর গোল করার ক্ষুধা..!

৭ জুন ১৯৭০।
নিজেদের ২য় ম্যাচ খেলতে ইউরোপের পরাশক্তি ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় সেলেসাওরা। ইংল্যান্ডের সেই দলটা ছিলো খুবই ভয়ানক। গর্ডন ব্যাংকস, ববি চার্লটন, জিওফ হার্স্ট, মার্টিন পিটার্স আর ফ্রান্সিস লিদের নিয়ে গড়া টিমটি ছিলো খুবই শক্তিশালী। হাড্ডাহাডি খেলার মধ্য দিয়ে প্রথমার্ধ গোলশুন্য ড্রতে শেষ হয়। এরপরের অর্ধেও ব্রাসিলকে মারাত্মক ভুগিয়েছে ইংলিশরা। সেই ম্যাচে গর্ডন ব্যাংকসের প্রত্যেকটা সেইভ বিশ্বকাপের সেরা সেইভের উপাধী পেয়েছিলো। রিভালিনো বাঁকানো শট সেইভ, টোস্টার শট সেইভ, আর সবচেয়ে বেশী যে সেইভটির জন্য আলোচিত হলো সেই সেইভটি হলো পেলের হেড সেইভ। রাইট উইং থেকে জায়েরজিনহো ক্রসকে অসাধারন হেডে গোলবারে ঢুকিয়ে দিলো পেলে, এখন শুধু মাত্র বল জালে স্পর্শ করা আর গোল উদযাপন করা বাকী ছিলো। কোথার থেকে যেনো গর্ডন উড়ে এসে বলটিকে ডান হাত দিয়ে বাড়ী দিয়ে বারের বাহিরে পাঠিয়ে দিলো তা আল্লাহ ই জানে। একদম সম্পুর্ন হয়ে যাওয়া গোলটিকে গর্ডন সেদিন যেভাবে সেইভ করেছিলো তা ছিলো আসলেই দর্শনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠে নি, ৬৯ মিনিটে রাইট উইং থেকে জায়েরজিনহোর জোড়ালো শটে পরাস্থ হয় ইংলিশ ইতিহাসের সেরা গোলকিপার গর্ডন ব্যাংকস। অবশেষে ১-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে সেলেসাওরা। সেদিন পেলে ছিলো নিজের ছায়া হয়েই..!

১০জুন ১৯৭০।
রোমানিয়াদের সাথে গ্রুপ পর্বের নিজেদের শেষ ম্যাচ। বেশ হাড্ডাহাড্ডিই লড়াই হয়েছিলো। ১৯ মিনিটেই পেলের গোলে এগিয়ে যায় ব্রাসিল। এরপর ৩৪মিনিটে গোল করে দলকে সমতায় আনেন ডুমিতারসে। এরপর ২২ মিনিটে জায়েরজিনহোর গোলে ২-১ এ এগিয়ে যায় সেলেসাওরা। ব্রাসিলের ইতিহাসে জায়েরজিনহোই একমাত্র প্লেয়ার যিনি কিনা ৭০ এর বিশ্বকাপে সব ম্যাচেই গোল করার গৌরব অর্জন করেন। রোনালদো ২০০২ এ শুধু ইংল্যান্ডের সাথে গোল করতে পারে নি..

এরপর ৬৭ মিনিটে আবার পেলে ম্যাজিক। নিজের জোড়া গোল করে দলকে ৩-১ এ এগিয়ে নিয়ে যান..!

এরপর ৮৪ মিনিটে ডেম্ব্রোবসি গোল করে ব্যবধান কমায়। দল জিতে ৩-২ এ..!

এই প্রথম ব্রাসিল গ্রুপ পর্বের প্রত্যেকটি ম্যাচ জিতে দাপটের সাথে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়াটারে পা রাখে..!

১৪ জুন ১৯৭০। কোয়াটারে প্রতিপক্ষ ল্যাটিনের পেরু। তাই পেরুর নাড়ীভুড়ি জানা ব্রাসিলের ফরযে আইন। ১১ মিনিটেই এলাস্টিকো বয় রিভেলিনোর গোলে এগিয়ে যায় ব্রাসিল। এরপর ১৫ মিনিটে নাম্বার নাইন পরিধানরত টোস্টাও নিজের প্রথম গোল করেন এই বিশ্বকাপে..
.
২৮মিনিটে গেলারদোর গোলে ২-১ এ ব্যাবধান কমায় পেরু। ৫২ মিনিটে আবার টোস্টার গোলে ৩-১ এ এগিয়ে যায় ব্রাসিল। এরপর ৭০ মিনিটে কুবিয়াসের গোলে পেরু ব্যবধান কমালেও ওয়ান্ডার বয় জায়েরজিনহো ৭৫ মিনিটে করা গোলে ব্রাসিল ৪-২ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে..! উড়ে উড়ে ব্রাসিল চলে যায় সেমিতে..!
.
১৭জুন ১৯৭০।
সেমিতে প্রতিপক্ষ আরেক ল্যাটিন, ৫০ এর মারকোনাজোর সেই ভিলেইন দল উরুগুয়ে। ১৯৫০ বিশ্বকাপের পর ২০ বছর পর বিশ্বকাপে আবার একে অপরের মুখোমুখি হয়। তাই ব্রাসিল ছিলো পুরানো প্রতিশোধ তুলার। উরুগুয়েদের হারালে ফাইনাল না জিতলেও ফাইনালে ত যেতে পারবে..! আর উরুগুয়ের ছিলো ২০ বছর পর ফাইনালে যাওয়ার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস..!

খেলার ১৯ মিনিটেই কুবিয়ার গোলে এগিয়ে যায় উরুগুয়ে। এরপর একে একে ৪৪ মিনিটে ক্লোডোয়াল্ডো, ৭৬ মিনিটে জায়েরজিনহো আর ৮৯ মিনিটে রিভেলিনো শেষ পেরেক ঢুকিয়ে দেয় উরুগুয়ের কফিনে। ৩-১ এ জয় নিয়ে আর এক পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে ৮ বছর পর ৪র্থ বারের মত ফাইনালে যায় ব্রাসিল..! রেকর্ড সংখ্যক শিরোপা হাতছানি দিয়ে ঢাকছে ব্রাসিলকে..!

ওইদিক দিয়ে আরেক কান্ড। গ্রুপ পর্বে উরুগুয়ে, সুইডেন, ইজরাইয়েল কে টপকে কোয়াটারে মেক্সিকোকে উড়িয়ে দিয়ে, সেমিতে জার্মানকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দীর্ঘ ৩২ বছর পর প্রথম ফাইনালে রিভা, রিভেরা, মারটিনোর ইতালী..!

সমীকরন এমন যে, ব্রাসিল যদি বিশ্বকাপটা জিতে তাহলে রেকর্ড সংখ্যক ৩ বার জিতবে, আর ইতালী যদি জিতে তাহলেও ইতালী রেকর্ড সংখ্যক ৩ বার কাপ জিতবে। কারন ইতালী ইতমধ্যে ১৯৩৪, ১৯৩৮ বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে..!

২১ জুন ১৯৭০।
নবম বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেই দল জিতবে সেই দল জুলে রিমে বিশ্বকাপটি একেবারে নিজেদের করে নিয়ে নিবে। কারন তখন নিয়ম ছিলো যে দল ৩ বার বিশ্বকাপ জিতবে সে দল একেবারে বিশ্বকাপ নিয়ে নিবে। আর ব্রাসিল ইতালী দু দলই দুবার করে নিয়েছে ইতমধ্যে...!

কার হাতে উঠবে সোনালী বিশ্বকাপ? সর্বকালের সেরা স্কোয়াড পেলে-রিভেলিনো-জায়েরজিনহোদের হাতে? নাকি চমক দেখানো ইতালীর হাতে..?

৪-২-৪ এর এক অসাধারন ফর্মেশনে ব্রাসিল ফাইনালে। রিভেলিনো-পেলে-টোস্টাও-জায়েরজিনহোদের নিয়ে ব্রাসিল ছিলো সেরা এটাকিং মুডে..

                                                                রেফারী বাঁশী ফু..! ইতালীর কিক অফ..

খেলার বয়স ১৮ মিনিটের কাছাকাছি।
লেফট উইং থেকে ব্রিত্তো থ্রো দেয় রিভেলিনোকে, রিভেলিনোর ক্লিয়ার ক্রস ইতালীর একেবারে বারের একটু সামনে পড়লে উড়ন্ত বলকে এক অসাধারন হেডে জালে জড়ান স্যার কিং পেলে..!

ব্যস, শুরু হলো উচ্ছ্বাস। পেলের উদযাপন ছিলো জায়েরজিনহোর কোলে উঠে ডান হাত মুঠ করে জয়ের উল্লাস যা এখনো ফুটবল ব্যাপারের কোন শো-তে টিভিতে হাইলাইটস হিসেবে দেখা যায়..! ব্রাসিল ১-০ এ এগিয়ে..

খেলার বয়স ৩৬ মিনিট।
ব্রাসিলিয়ান প্লেয়ারের কাছ হতে মিডফিল্ড থেকে বলটাকে চিলের মত ছোঁ মেরে দৌড়াতে দৌড়াতে ব্রাসিল শিবিরে ঢুকে যায় বনিনসেগনা। গোলকি ফেলিক্স এগিয়ে আসলে তাকে আর ব্রাসিলের ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ফাঁকা বারে গোল দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে বনিনসেগনা আর ইতালী। না দেখলে বুঝবেন না কি সেই উল্লাস..!

ইতালী ১-১ ব্রাসিল। কি হবে শেষ পর্যন্ত..? কার ভাগ্য সহায় হবে আজ..?

খেলার বয়স ৪৫ মিনিট।
ব্রাসিল ফ্রি কিক পেলে তাতে কিক নিতে আসে রিভেলিনো। জোড়ালো শটকে বুকে রিসিভ করে টোস্টাও বলটাকে মাটিতে নিয়ে বল জালে জড়ান। কিন্তু একি..? রেফারী ইশারা লাইন্সম্যানের দিকে..!

অফসাইড..  বঞ্চিত হলো চমৎকার একটি গোল..

খেলার বয়স ৬৫ মিনিট+।
ল্যাফট উইং থেকে মার্কো অ্যান্টিনিও পাস দেয় রিভেলিনোকে। রিভেলিনো একজন প্লেয়ার ড্রিবল করে দ্রুত বল দিয়ে দেয় ৮ নাম্বার জার্সি পরিধানত জারসন কে। জারসন বলটা রিসিভ করে একটু এগিয়ে গিয়ে ডি-বক্সের বাহির থেকে বা পায়ের জোড়ালো শটে দুই দুইজন ইতালীর প্লেয়ারদের মাঝখান দিয়ে অসাধারন একটা কার্ভ গোল করে..!

ব্রাসিল ২-১ এ এগিয়ে। জারসনের দুই হাতে তুলে কি সেই দৌড়..!

খেলার ৭০ মিনিট
মাঝমাঠে একটা ফ্রিকিক পায় ব্রাসিল। মাঝমাঠ থেকে জোড়ালো ফ্রিকিক নিলে বল গিয়ে পড়ে ডি-বক্সের মধ্যে থাকা পেলের কাছাকাছি। পেলে সেই উড়ন্ত বলকে হেডের মাধ্যমে এসিস্ট করে জায়েরজিনহোকে..!

বিশ্বকাপের প্রতিটা ম্যাচে গোল করা জায়েরজিনহো এই ম্যাচে গোল না করলে কিভাবে হয়? সেই এসিস্ট থেকে গোল করে জায়েরজিনহো আর করে ফেললেন এক ইতিহাস..!

ব্রাসিলের হয়ে একমাত্র প্লেয়ার যে কিনা বিশ্বকাপের প্রত্যেকটা ম্যাচে গোল করার গৌরব অর্জন করে..! ব্রাসিল ৩-১ এ এগিয়ে..! ইতিহাসের রেকর্ড ব্রাসিলকে হাতছানি দিয়ে জোড়ে জোড়ে ঢাকছে..!

খেলার ৮৫ মিনিট।
এই একটা গোল, যেই গোলটা হতে ব্রাসিলের ৮ জন প্লেয়ারের পায়ের স্পর্শ পায় যেখানে কোন ইতালীয়ানের পায়ের স্পর্শ লাগে নাই, বল নেওয়া ত দুরের কথা..!

ইতালীর ল্যাফট উইং দিয়ে ইতালীয়ানরা বল নিয়ে এগিয়ে গেলে পিয়াজ্জা সেটাকে ছোঁ মেরে বল নিয়ে ডিফেন্ডার ব্রিত্তোকে দেয় (১), ব্রিত্তো পাস দেয় রিভেলিনোকে (২), রিভেলিনো সাথে সাথে বল দেয় জার্সোনকে (৩), জার্সোন ও সাথে সাথে পাস দেয় ক্লোডোলাল্ডোকে (৪)। ক্লোডোলাল্ডো দেয় আবার রিভেলিনোকে। রিভেলিনো চার চারটে প্লেয়ারকে একই ভঙ্গিমায় ড্রিবল করে (যার মধ্যে দুটি ছিলো এলাস্টিকো) বল দেয় ল্যাফট ব্যাকে থাকা এভারাল্ডোকে (৫) এভারাল্ডোর লং পাস ল্যাফট উইং এ থাকা জায়েরজিনহোর কাছে (৬) ডি-বক্সের বাহিরেই জায়েরজিনহো একজন প্লেয়ারকে ড্রিবল করে পাস দেয় ডি-বক্স বরাবর স্যার পেলেকে(৭) পেলে একদম আলতো থ্রু পাস দেয় রাইট উইং থেকে দৌড়ে আসা অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তোকে (৮)। আলবার্তোর ওয়ান টাচ জোড়ালো শটে ইতালীর জালে বল জড়িয়ে গেলো।

ওহ, কি উচ্ছ্বাস, কি উদযাপন। ব্রাসিল ৪-১ এ এগিয়ে। এই গোল হওয়ার সময় বলটি ব্রাসিলিয়ান ৮ জনের স্পর্শ পেয়েছে কিন্তু বিশ্বাস করুন সেই ডিফেন্স থেকে এগিয়ে আসা বলটিতে একজন ইতালীয়ানের ছোঁয়াও লাগে নাই..!

পেলের ১৮মিনিট, ৬৬ মিনিটে জারসন, ৭১ এ জায়েরজিনহো আর ৮৬ মিনিটে কার্লোস আলবের্তোর গোলে ইতালীর জালে ৪ চারটি গোল ঢুকিয়ে দিয়ে তৎকালীন রেকর্ড সংখ্যক বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় সেলেসাওরা..!

সেদিন মাঠে উপস্থিত থাকা ১ লক্ষ ৭ হাজার ৪২ জন দর্শক দেখেছিলো নানা ইতিহাস আর সর্বকালের সেরা দল, সর্বকালের সেরা স্কোয়াডের নান্দনিক বিশ্বজয় যারা গ্রুপ পর্ব হতে ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচ জিতার এক গৌরব অর্জন করে..!

ফুটবলকে "বিউটিফুল গেইম" বা "জোগো বনিতা" উপাধী দিয়েছে ত এই দলই..!

রিভেলিনোর পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে চোখ ধাঁধাঁনো এলাস্টিকো মুভ, গ্রুপ পর্ব হতে ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচে জায়েরজিনহোর গোল করার মাধ্যমে ইতিহাস, প্লেয়ার হিসেবে স্যার মারিও জাগালোর দুইটি বিশ্বকাপ আর কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপ জিতার এক অনবদ্য ইতিহাস করা, পেলের নামের পাশে তিনটি বিশ্বকাপ আর সর্বকালের সেরা প্লেয়ার হওয়ার তকমা, পেলের গোল্ডেন বল, জার্ড মুলারের গোল্ডেন বুট, ইতালীর দীর্ঘ ৩২ বছর পর ফাইনালে যাওয়া, কার্লোস আলবার্তোর বিশ্বকাপ মাথায় তুলে নেওয়া, পেলেকে সবাই কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়ানো আর ব্রাসিলের রেকর্ড সংখ্যক (৩ বার) বিশ্বকাপ জিতে তা একেবারে নিজেদের করে নেওয়ার মাধ্যমে শেষ হয় বিশ্বকাপের চাঞ্চল্যকর নবম আসর..!

নানা ইতিহাস গড়ার মাধ্যমে শেষ হয় ১৯৭০ এর বিশ্বকাপ। অসাধারন খেলা প্রদর্শনের জন্য এই ৭০ এর দল সর্বকালের সেরা দলে পরিনত হয়..!

আর আমরাও গর্বিত এমন দলের সাপোর্টার হয়ে যেই দল থেকেই শুরু হয়েছে ছন্দময় নান্দনিক খেলা। যে দলের কারনে ফুটবল পেয়েছে তার অবিরাম সৌন্দর্যের রূপ। যেই দল করেছে বিশ্ব ইতিহাস..! যেই দলে রয়েছে ছন্দ দিয়ে ফুটবল শাসন করা কিংবদন্তি প্লেয়ারগন..

                                                                             আপনাদের স্যালুট স্যার..!