• ফুটবল

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বনাম আর্জেন্টিনা সমর্থক

পোস্টটি ৮৮৫৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

শিরোনাম পড়েই হয়ত অনেক পাঠক চক্ষুশূল দিয়ে আমায় বিধতে চাইবেন । আবার অনেক পাঠক খুব সঙ্গত কারণেই আগ্রহ নিয়ে পড়বেন ।   যারা আর্জেন্টিনা সমর্থক এবং রোনালদোকে প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতি নিয়তই ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেই যাচ্ছেন , আমার এই লেখাটি মূলত তাদের জন্যই । জানি না কতটুকু পারব কিন্তু সাধ্যমত চেষ্টা করব এবং বাকিটুকু পাঠকদের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি । তবে প্রথমেই বলে নিচ্ছি , এই অধম একজন আর্জেন্টিনা সমর্থক ।

ফুটবলে তারার সংখ্যা নেহায়েত কম নয় । প্রতিটি সময়েই আমরা এমন বিশ্বয়কর কিছু ফুটবলারের আগমন দেখেছি ,যাদের খেলা দেখা ছিল বেশ সৌভাগ্যের । পেলে , পুসকাস , ক্রুইফ ,বেকেনবাওয়ার , ডি স্টেফানো , ম্যারাডোনা , জিদান , মালদিনি , রোনালদো লিমা সহ আরো অনেকে সেই তালিকায় রয়েছেন । সময়ের দাবীতে এখন বর্তমানে আছেন এমন দুজন ফুটবলার যাদের খেলা দেখতে পারাটা ছিল আমাদের জন্য খুবই সৌভাগ্যের বিষয় । আমাদের আগের প্রজন্ম সবসময়ই তাদের প্রজন্মের খেলোয়াড়দের প্রশংসা করে গেছেন, তাদের চোখে সেসময়ের প্লেয়াররাই হয়তো সেরা কিন্তু এটা সবাই বলতে বাধ্য ফুটবল বিশ্বে এমন তুখোড় প্রতিদ্বদন্দ্বীতা পূর্ণ দুজন সমসাময়িক ফুটবলারকে  আগে কখনই দেখা যায়নি । হয়তো ভবিষ্যতে এরকম দুজন তারকার মধ্যে সেই প্রতিদ্বন্দীতার ঝাঁঝ খোজা হবে ,কিন্তু সেটা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে ।  

                                                                                                                             52cf0b1d97146b28f67dd3cc5ee85088235f3a64                                                       

সেই দুইজন তারকার একজন তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আমার আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় । ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দস সান্তোস এভেইরো । পর্তুগালের মাদেইরার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মানো ক্রিশ্চিয়ানোকে জন্ম না দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন তার মা । কিন্তু শেষ পর্যন্ত চার নম্বর সন্তান হিসেবে জন্ম নিলেন রোনালদো , ফুটবলের ইতিহাসে  জ্বলজ্বলে  এক তারকার জন্মের মাধ্যমে ধন্য হল ফুটবল বিশ্ব । ছেলেবেলা থেকে পরিশ্রম শব্দটা যেন হয়ে গিয়েছিল জীবনের অনবদ্য অংশ । বাবা ছিলেন মালী ,প্রচন্ড মদ্য পান করতেন । ২০০৫ সালে যখন বাবা মারা যান , রোনালদো শপথ নিয়েছিলেন কখনও অ্যালকোহল পান করবেন না । ফুটবলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জিং শপথ মেনে চলার সাথে সাথে এই শপথটাও মেনে চলেছেন এখনও পর্যন্ত । সবসময়ই ছিলেন প্রচন্ড উদ্যমী , হার না মানা মানসিকতা ছিল তার রক্তে ।  ক্যারিয়ারের বয়স ১৪ বছর , যখন খেলা শুরু করেছিলেন তারপর থেকে পেছনে তাকাতে হয়নি একবারও । টানা ৯ বার বিশ্বের শীর্ষ তিন ফুটবলারের মধ্যে  থাকা , ৪ বার ব্যালন ডিঅর , ২২ টি ট্রফি জেতাই বলে দেয় কোন মাপের খেলোয়াড় তিনি । এই ৩২ বছর বয়সেও যেভাবে খেলে যাচ্ছেন ,তাতে বয়স কথাটাকে যেন টাইমলাইনে স্লো করে আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন ডিসি কমিকসের জনপ্রিয় চরিত্র ফ্ল্যাশের  মত ।

                                                                                                                                Portugals-forward-Cristiano-Ronaldo-loo

কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে রোনালদো জীবনে তার সাফল্যের জন্য যতটা না আলোচনায় এসেছিলেন , তার চেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন বোধয় তার সমালোচনার জন্য । সবসময়ই ছিলেন খুব বেশি বাস্তববাদী । তাই সময়ের উচিত কথা সময়েই বলে দিতে পছন্দ করেন । তার আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী , সেই আত্মবিশ্বাসের জোরেই তিনি ঘোষণা দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে দল ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরের লেগেই নিজেই হ্যাট্রিক করে  পরের পর্বে উঠিয়েছিলেন । ঘোষণা দিয়েই জিতেছিলেন ইউরো । দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় জ্বলে ওঠা যেন তার নিত্য নিমিত্ত ব্যাপার । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার সমসাময়িক আরেকজন তারকা হচ্ছেন  লিওনেল মেসি । তারকা থাকতেই পারে , সেটা কোনো সমস্যা নয় । সমস্যা হচ্ছে সেই তারকার ফ্যানবেজ । মেসি রোনালদোকে অথবা রোনালদো মেসিকে কোনো ক্ষেত্রে এতটুকুও অসম্মান করে কিছু বলেছেন এমন কখনই শোনা যায়নি  কিন্তু তাদের ফ্যানবেজ প্রতিনিয়তই সেটা করেই চলেছে বললে ভুল হবে, সেটাকে যেন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে । এখানে রোনালদোর বিপক্ষে কথা বলা দুই পক্ষকে দেখা যাচ্ছে , এক পক্ষ হচ্ছে বার্সেলোনা সমর্থক এবং আরেক পক্ষ আর্জেন্টিনা সমর্থক । রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদে খেলেন বিধায় বার্সেলোনার চক্ষুশূল  হতে পারেন কিন্তু আর্জেন্টিনা সমর্থক কেন তাকে অযৌক্তিক সমালোচনা করবে সেটা আমার বোধগম্য নয় । আপনার পছন্দের খেলোয়াড় মেসি হতেই পারে , কিন্তু তাই বলে কি রোনালদোকে হেট করতে হবে ? তাছাড়া ম্যারাডোনা বা পেলে যেভাবে কথায় কাদা ছোড়াছুড়ি করেছেন , তাতে নাহয় ধরে নিলাম  তর্কের খাতিরে  তাদের ফ্যানবেজও সেটা করল কিন্তু রোনালদোকে হেট করার কারণ কি ? অনেকে হয়তো বলে থাকবেন সেটা হচ্ছে রোনালদোর ফ্যানবেজের জন্য । আপনি নিজের কথাই নিজের কানে শুনেছেন কি ? আপনি দেখবেন খেলোয়াড়ের খেলা অবশ্যই তার ফ্যানবেজ নয় । আর যদি ফ্যানবেজই দেখেন তাহলে খুব সম্ভবত আপনি প্রকৃত ফুটবল ফ্যান না । আপনি ফুটবল ফ্যান হলে কখনই রনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আক্রমণাত্বক কথা বলবেন না  । আপনি কখনই তার ফ্যানবেজ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না । আপনি অবশ্যই তার খেলা আগে দেখবেন এবং সেটা নিয়ে মন্তব্য করবেন ।

                                                                                                                                  B8ibptTCUAIc56d

রোনালদো  জাতীয় দলে সাফল্য পান না বলেও কথা উঠেছে , তাকে এটা নিয়েও যথেষ্ট সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে । ২০১৬ সালে ইউরো জয়ের মাধ্যমে সেই জবাবও সমালোচনাকারীদের তিনি দিয়েছেন । এইবার রোনালদোর সমালোচকদের কিছু খোঁড়া যুক্তির কথা বলি । ২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে সুইডেনের সাথে ৪ টি গোলের সবগুলোই করে দলকে বিশ্বকাপে তুলেছিলেন রোনালদো । কিন্তু বিশ্বকাপের মূল পর্বে এসে প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়তে হয় পর্তুগালকে । এই রোনালদোকে কিন্তু ইউরো জেতার পরও ফাইনাল না খেলার জন্য কিভাবে তিনি ইউরো জিতলেন , কিভাবে ইউরো জেতায় তার অবদান ছিল সেটা নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে কিন্তু সেই ২০১৪ বিশ্বকাপে তার দল বাদ পরার জন্য কটুক্তি কিন্তু শুধু তাকেই করা হয়েছিল পুরা দলকে সেই দায়ভার দেয়া হয়নি । এমনকি মাত্রই যে কনফেডারেশন কাপ শেষ হল সেটার সেমিফাইনালে কেন রোনালদো পেনাল্টি নেয়নি সেটারও সব হাস্যকর যুক্তি শোনা যাচ্ছে । কেউ বলছেন ভয়ে নেয়নি , কেউ বলছেন দায়ভার এড়িয়েছেন এমনকি এই পেনাল্টি না নেওয়ার জন্য তিনি ম্যান অফ দা ম্যাচ পাবেন কিনা এটাও নাকি একটি ট্রলের অংশ !! স্বভাবতই রোনালোদো আগের ম্যাচ গুলোতে ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়েছিলেন ,এই কথার মাধ্যমে সেটাকেই কটাক্ষ করা হয়েছে । এই ব্যাপারগুলো থেকেই বোঝা যায় তাকে কতটা যুক্তিহীন  বাজে ট্রলের শিকার হতে হয় ।  তবে আমার সত্যিই জানা নেই আর্জেন্টিনা সমর্থকরা কেন রোনালদোকে ট্রলের পেছনে এত বাজে সময় নষ্ট করেন । জিদান ভাল খেলোয়াড় ছিলেন , জার্মানির ওজিল নয়ারকে আপনারা ভাল খেলোয়াড় মানেন , স্পেনের ইনিয়েস্তা  জাভি  ক্যাসিয়াস রাউল , ইতালির বুফনকে সেরা মানতে আপনাদের আপত্তি নেই কিন্তু রোনালদোকে কেন ? মেসির সমকক্ষ বলে ? আপনি মেসির সমর্থক নাকি আর্জেন্টিনার ? বাতিস্তুতা তো আরও অনেক তারকার সঙ্গে খেলে গিয়েছেন , রিকুয়েলমের সময়েও জিদান ছিল কই তাদের তো এভাবে কটুক্তি করেননি । তাহলে এখন কেন রোনালদোকে সেটা করছেন ? ব্রাজিল অনেক ফ্যান রোনালদোকে পছন্দ করতেই পারে , তারা রোনালদোকে নিয়ে মেসির বিপক্ষে কথা বলতেও পারে কিন্তু সেজন্য রোনালদোকে কেন কটুক্তি করতে হবে ? ব্রাজিল সাপোর্ট যারা করে তারা রোনালদোকে নিয়ে কথা বললেই কি রোনালদো ব্রাজিলিয়ান হয়ে যাবে ? ব্রাজিল সাপোর্টাররা রাতে ঘুমায় দিনে খায় , তাই বলে কি আপনি সেগুলাও ছেড়ে দিবেন ? এত লেইম হওয়ার মানেটা কি আসলে ?

                                                                                                                                47817ce02d9564a48a8d3cd10a9a728b

আমাদের দলে একজন মেসি আছে , সে অত্যন্ত ভাল একজন খেলোয়াড় । কিন্তু নানা সময়েই দেখা গেছে সে কিন্তু যোগ্য নেতা নয় । এই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিন্তু চোখের সামনে মেসিকে টানা ৪ টি ব্যালন ডি অর  জিততে দেখেছেন , কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি । পর্তুগালের হয়ে ইউরোর সেমিফাইনাল , ফাইনাল ,বিশ্বকাপে বাজেভাবে বিদায় সবকিছুরই সাক্ষী হয়েছিলেন কিন্তু তারপরও হাল ছেড়ে থাকেননি । ঠিকই তার কাজ নিয়মিত করে গেছেন আরও নতুনভাবে আরও নতুন আঙ্গিকে । খর্ব শক্তির দল নিয়েও ইউরো জিতেছেন , দলকে নানাভাবে উজ্জীবিত করেছেন যেটা জানা গেছে বিভিন্ন সময় তার সতীর্থদের কাছ থেকে ।  ইউরোর ফাইনালেও সেটা সরাসরি দেখা গেছে ।   মেসি কিন্তু তিনটি ফাইনাল হারার পর তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি , অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন । দলকে তো তিনি উজ্জীবিত করতে পারেনইনি উলটো আরও অসহায় অবস্থায় ফেলে গিয়েছিলেন আবেগের বশে , যেই ভুল পরে বুঝতে পেরে তিনি ফিরে এসেছিলেন ।  আপনার কেন মনে হয়না মেসিও একজন মানুষ । তারও বিভিন্নদিকে খুঁত আছে । তারও অনেক গুন নেই যেটা রোনালদোর আছে । এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে এত কষ্ট কিসে ? আসলে সবকিছুই দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে । মেসির প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি , আপনি দেখেন রোনালদো ইউরো এর বাইরে বসে হাত পা ছড়িয়ে চিল্লানো একটা একটা খেলোয়াড় যে ফাইনালে না খেলে ইউরো জেতানোতে অবদান রাখেনি আর আমি দেখি এরকম হাত পা ছড়িয়ে চিল্লানো যোগ্য নেতার অভাবেই গত তিন বছরে আমরা তিনটি বৈশ্বিক শিরোপার ফাইনাল হেরেছি , এজন্যই ২৪ বছর ধরে আমাদের শিরোপাখরা কাটেনি ।  আর্জেন্টিনার এই তারকাখচিত দল রোনালদো পেলে কি আজ আর্জেন্টিনার জার্সিতে এ এফ এ লোগোটার উপরে দুটি স্টার থাকত ?! রোনালদোর ক্যারিয়ারে কি বিশ্বকাপ শিরোপা কোপা আমেরিকার শিরোপা যুক্ত হত ? সেই চিন্তার ভার পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম ।