জুভেন্টাসঃ তুরিনের সেই বুড়ির গল্প
পোস্টটি ৬৩১১ বার পঠিত হয়েছেমে ২০০৬, Calciopoli scandal এর কারণে আরো ৪ টি ক্লাবের সাথে ইটালিয়ান ফুটবল লীগের 'সিরি বি' তে অবনমন ঘটে ইটালিয়ান লীগের সবচেয়ে সফল ক্লাব জুভেন্টাসের। ইউরোপের অন্যতম অভিজাত একটি ক্লাবের ম্যাচ পাতানোর দায়ে ২য় বিভাগে নেমে যাওয়াটা আত্মসম্মানে লেগেছিলো ক্লাবের কয়েকজন স্টার প্লেয়ারের। ফ্যাবিও ক্যানাভারো, লিলিয়ান থুরাম, ইব্রাহিমোভিচের মতো খেলোয়াড় রা জুভেন্টাস ছেড়ে পাড়ি জমান অন্য নামিদামি ক্লাবে। থেকে যান আলেসান্দ্রো ডেল পিয়েরো, জিয়ানলুইজি বুফন, ডেভিড ত্রেজেগে আর পাভেল নেদভেদের মতো সুপারস্টার রা।
জুভেন্টাসের 'সিরি আ' তে ফিরে আসার একটাই উপায় ছিলো, ২০০৬/০৭ মৌসুমে সিরি বি তে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। জুভেন্টাস চ্যাম্পিয়ন হয়েই সিরি আ তে ফিরে আসে। ডেল পিয়েরো হন সিরি বি এর সেই মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
২০০৭/০৮ মৌসুমে লীগে ৩য় হয় জুভেন্টাস। সেই মৌসুমে সিরি আ'র সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ডেল পিয়েরো। ২য় সর্বোচ্চ গোলদাতা তারই সতীর্থ ডেভিড ত্রেজেগে। সুযোগ হয় চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার। গ্রুপ পর্বে ২ লেগ মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ কে হারিয়েও নক আউট পর্বে চেলসি তাদের 'নক আউট' করে দেয়। সেই সময় সিরি আ তে ছিলো ইন্টার মিলানের একচ্ছত্র আধিপত্য। পরের মৌসুমে ইন্টার মিলানের ঠিক পিছনে থেকে লীগ শেষ করে জুভেন্টাস। আবারো সুযোগ হয় চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার। এবার গ্রুপ পর্বেই তাদের বিদায়। পরের মৌসুমে সিরি আ তে ৭ নাম্বারে থেকে লীগ শেষ করে জুভেন্টাস। নেমে যায় ইউরোপা লীগে। সেখানেও গ্রুপ পর্বেই বিদায়। সিরি আ তে পরের মৌসুমটা ভালো কাটেনি জুভেন্টাসের। এবারো লীগে ৭ম।
২০১১-১২ মৌসুমে ঘুরে দাঁড়ায় তুরিনের বুড়ি। নতুন কোচ আর সাবেক খেলোয়াড় এন্টোনিও কন্তের অধীনে শুরু হয় জুভেন্টাসের নতুন দিনের সূচনা। ওই মৌসুমে দলে যোগ দেন "রেজিস্তাদের রেজিস্তা" আন্দ্রে পিরলো। ৩৮ টি লীগ ম্যাচের ২৫ টি জয় আর ১৫ টি ড্র। পুরো লীগে একটিও ম্যাচ না হারার নতুন রেকর্ড গড়ে জুভেন্টাস। পরের সিজনের চ্যাম্পিয়নস লীগে গ্রুপ সেরা হয়ে নক আউট পর্বে দুই লেগ মিলিয়ে সেল্টিক কে ৫-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হয়ে যায় সেবারের চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখের সাথে। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-০ তে হেরে সেই যাত্রা থেমে যায়।
২০১১-১২ মৌসুমে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শুরু। ২০১৬-১৭ মৌসুম পর্যন্ত টানা ৬ টি লীগ শিরোপা জিতে নতুন রেকর্ড গড়ে জুভেন্টাস। লীগে আধিপত্য ধরে রাখলেও চ্যাম্পিয়নস লীগে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলো না। ২০১২-১৩ মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনালে গেলেও ১৩-১৪ মৌসুমে গ্রুপ পর্বেই বিদায়। ২০১৪-১৫ চ্যাম্পিয়নস লীগে গ্রুপ রানার আপ হয়ে পরের রাউন্ডে গিয়ে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড কে দুই লেগে মিলিয়ে ৫-১ গোলে হারিয়ে দেয় জুভেন্টাস। কোয়ার্টার ফাইনালে মোনাকোর বিপক্ষে জয় ১-০ গোলে।
ম্যানেজার কন্তে তার আসল কৌশল টা মনে হয় সাজিয়ে রেখেছিলেন সেমি ফাইনালের জন্য। প্রতিপক্ষ আগের বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ। তারকায় ঠাসা রিয়ালের বিপক্ষে জুভেন্টাস কয় গোলে হারে সেটাই ছিলো দেখার বিষয়। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রিয়াল কে ৩-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় জুভেন্টাস। ফাইনালে ৬৮ মিনিট পর্যন্ত ১-১ সমতায় থেকেও সুয়ারেজ আর নেইমারের গোলে ফাইনালে স্বপ্ন ভঙ্গ হয় জুভেন্টাসের।
ততদিনে বোঝা হয়ে গেছে এই জুভেন্টাস আর ১০ বছর আগের জুভেন্টাসের মাঝে বিস্তর ব্যবধান। এন্টোনিও কন্তের কৌশল আর বুফনের অধিনাকত্বে জুভেন্টাস ক্রমেই ইউরোপের অন্যতম সেরা দলে পরিণত হয়েছে। মাঝে কন্তের ইটালি জাতীয় দলের দায়িত্ব নেয়া, পিরলো, পগবার দলবদলের পর মনে হচ্ছিলো জুভেন্টাসের সাফল্যে হয়তো এবার একটু ভাটা পরবে। সেটাও হয়নি। বরং পরের মৌসুমে জুভেন্টাসের দাপট আরো বেড়ে যায়। ৯১ পয়েন্ট নিয়ে ৩৩ বারের মতো "স্কুডেট্টো" জিতে নিলো। ৩ বছরের মধ্যে ২য় বার চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে গেলো। আর সেখানে আসল খেলাটা জমিয়ে রেখেছিলো বার্সেলোনার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে। দুই লেগ মিলিয়ে ৩-০ তে জয়, ৩ গোলই প্রথম লেগে। ২য় লেগে ন্যু ক্যাম্পে তেতে থাকা বার্সা কে রুখে দিয়েছিলো বনুচ্চি, বারজাগলি আর কিয়েল্লিনি কে নিয়ে গড়া দেয়ালসম ডিফেন্স। সেমিতে মোনাকো কে ৪-১ গোলে উড়িয়ে ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদ। মাদ্রিদের সামনে টানা ২ বার চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতার হাতছানি আর জুভেন্টাসের সুযোগ ১৯৯৬ এর পরে আবারো চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতা। এবার জুভেন্টাস কে নিয়ে আশাবাদী মানুষের সংখ্যা ছিলো বেশি। ফাইনালের আগে তাদের পারফরমেন্সের জন্য তারাই অনেকটা এগিয়ে ছিলো। লড়াইটা ছিলো রিয়ালের আক্রমণ বনাম জুভেন্টাসের রক্ষণ। কিন্তু রিয়ালের ছিলেন একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। ফলাফল রিয়াল মাদ্রিদ ৪ জুভেন্টাস ১।
সেই ২০০৬ এ ম্যাচ পাতানোর কলঙ্ক নিয়ে ২য় পর্যায়ে নেমে যাওয়া একটা ক্লাব এখন ইউরোপের পরাশক্তি। আর এই পরাশক্তি হওয়া সম্ভব হয়েছে ক্লাবের জন্য নিবেদিত প্রাণ কয়েকজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের ক্লাবটির জন্য ভালোবাসার জন্যই। বুফন, ডেল পিয়েরো, পাভেল নেদভেদ কিংবা ডেভিড ত্রেজেগে রা চাইলেই কয়েক মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি তে অন্য যেকোনো ক্লাবে যেতে পারতেন। কিন্তু ক্লাবের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা তাদের যেতে দেয়নি। আর ফলাফল তো সবার চোখের সামনেই।
জুভেন্টাস, ভালোবাসা অবিরাম।
- 0 মন্তব্য