• ক্রিকেট

টি-টোয়েন্টি লিগ নাকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট?

পোস্টটি ৮৫৭৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৭ ফেব্রুয়ারি,২০০৫। অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির যাত্রা। সেদিন কে জানত, ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্রতম সংস্করণটিই একদিন বিশ্ব ক্রিকেটকে দুই সারিতে দাঁড় করাবে। প্রথম টি টোয়েন্টির ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ২০০৭ সালে আইসিসি টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তা দেখে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজন করে। বিশ্বকাপটির ফাইনাল ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দিয়ে শেষ হওয়ায় আইসিসির ভালোই পকেট গরম হয়েছিল সে বছর। বিশ্বকাপটির সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা টি-টোয়েন্টির বাণিজ্যিকীকরণ করতে আগ্রহী হয়। তবে নাটের গুরু ছিলেন লোলিত মোদি। তার মস্তিষ্ক থেকেই সর্বপ্রথম জন্ম নেয় আইপিএলের ধারণা। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৮ সালে ক্রিকেটের নবজাগরণ ঘটিয়ে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে আইপিএলের প্রথম আসর। আইপিএলের বিস্ময়কর সাফল্য দেখে অন্যান্য দেশগুলোতেও চালু হতে থাকে এসব টি-টোয়েন্টি লিগ। আইপিএলের ধারাবাহিকতায় অস্ট্রেলিয়ায় চালু হয় বিগ ব্যাশ লিগ, বাংলাদেশে বিপিএল,ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল, পাকিস্তানে পিএসএল ইত্যাদি।

PicsArt_11-13-03.20.11

ধীরে ধীরে যেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেরই সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক এসব ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। দর্শকের উপভোগের কথা চিন্তা করে এসব টুর্নামেন্ট বছরের বিভিন্ন সময়ে আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে প্রায় সারাবছরই এসব টুর্নামেন্ট দেখার সুযোগ পান  ক্রিকেটামোদীরা। টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর তুলনার বিচারে নিঃসন্দেহে সবার ওপরে থাকবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল। বলিউডি গ্ল্যামার থেকে শুরু করে আতশবাজির ঝলকানি কি নেই এতে! ক্রিকেট বাণিজ্যের তীর্থভূমি ভারত গত ১০ বছরে আইপিএল কে নিয়ে গেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বীর চূড়ায়। আইপিএলের সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বের শক্তিশালী দলগুলোর ক্রিকেটারদের শতভাগ উপস্থিতি। শুধুমাত্র পাকিস্তান দলের ক্রিকেটারদের বাদ দিলে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ থাকে আইপিএলে। আইপিএলের সময় তাই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ প্রায় বন্ধই থাকে।বিশেষ করে ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া,নিউজিল্যান্ড,দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা তাঁদের নিজ নিজ বোর্ডকে আইপিএলের মৌসুমে দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সূচি না ফেলতে রাজি করায়। এসব দেশের বোর্ডও খেলোয়াড়দের আইপিএলের দুই মাস স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দেয়। আর আইপিএলের সুবাদে তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো সংগঠিত দলের ক্রিকেটাররা রীতিমতো 'ভবঘুরে' বনে গেছেন। বিশেষ করে আইপিএলের সমান্তরালে বেড়ে ওঠা অন্যান্য লিগগুলোর কাছে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের আকাশচুম্বী চাহিদা থাকায় তাদের বেশিরভাগই জাতীয় দল থেকে ব্রাত্য হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলে বেড়াচ্ছেন। আইপিএলের মত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও বিপিএল, সিপিএল,পিএসএল,বিগব্যাশ জনপ্রিয়তার দিক থেকে পিছিয়ে নেই মোটেও। একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে দিন দিন উন্নতি করছে এসব লিগ। সবমিলিয়ে লিগভিত্তিক এসব টুর্নামেন্ট দর্শকদের কাছে এমন একটা গ্রহণযোগ্যতায় পৌঁছেছে যে,স্বয়ং আইসিসিও এটির ওপর আর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না।     

icc

এদিকে টি-টোয়েন্টি লিগ গুলো দিন দিন যতটা আকর্ষণীয় ও বর্ণময় হয়ে উঠছে ততটাই যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। টি টোয়েন্টি লিগগুলোর ব্যাপক প্রসারে প্রভাব পড়ছে টেস্ট ও ওয়ানডের ওপর। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট।বিশেষত: টি-টোয়েন্টির যাঁতাকলে পড়ে রীতিমতো নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় টেস্ট ক্রিকেটের। টি-টোয়েন্টি উন্মাদনায় দর্শকেরা আজকাল ক্রিকেটের আদিতম সংস্করণটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।একমাত্র ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট সিরিজ (অ্যাশেজ) বাদে অন্যান্য টেস্ট সিরিজগুলো তেমন দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে না। অধিকাংশ সিরিজের টিআরপি দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে। জিম্বাবুয়ে টেস্ট সিরিজ খেলে লাভ হওয়ার পরিবর্তে উল্টো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় যথাসম্ভব কম টেস্ট খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টেস্ট খেলতে যাতে কম সময় লাগে সেজন্য  দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসিকে চার দিনের টেস্ট খেলার জন্য সুপারিশও করেছে। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ছে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। টেস্ট ক্রিকেট যেন আজকাল খেলাই হচ্ছে আইসিসির তৈরি করা এফটিপি রক্ষার্থে! শুধু বাণিজ্যিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না টেস্ট ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আক্রমণাত্মক মানসিকতার ছাপ পড়ছে টেস্ট ক্রিকেটেও। পাঁচদিনের টেস্ট চারদিনে এমনকি তিনদিনেও শেষ হয়েছে যাচ্ছে। প্রকৃতির হস্তক্ষেপ না থাকলে টেস্ট ড্র হওয়াটা যেন এখন বিরল ঘটনা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

বদল এসেছে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটেও। রঙিন পোশাকের এ ক্রিকেট ধীরে ধীরে যেন এর সব রঙ টি-টোয়েন্টিকে ঢেলে দিচ্ছে। একমাত্র আইসিসি টুর্নামেন্টগুলো (বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) বাদ দিলে দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজের স্পন্সর ভ্যালু হ্রাস পাচ্ছে। টি-টোয়েন্টি মত বাণিজ্যিক দিক বিবেচনায় ওয়ানডে ম্যাচের বেশির ভাগ পিচই বানানো হচ্ছে ব্যাটসম্যানদের উপযোগী করে। ফলে তিনশ,সাড়ে তিনশ, এমনকি চারশ রানও সহজেই তাড়া হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট খেলাটা ভারসাম্য হারিয়ে এখন ধীরে ধীরে ব্যাটসম্যানদের খেলায় পরিণত হচ্ছে। বোলারদের জন্য বিশেষত: স্পিনারদের জন্য বোলিং করাটা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বোলারদের আক্রমণাত্মক বোলিং করার পরিবর্তে ব্যাটসম্যানদের রান আটকানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টি যে শুধু ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটে ফাটল ধরিয়েছে তা নয় বরং অনেক ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট আয়োজন করাও হুমকির মুখে পড়ে গেছে।এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এশিয়া কাপ টুর্নামেন্ট এতদিন যাবৎ দুই বছর পরপর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কিন্তু ঐ সময়ে পাকিস্তান নিজেদের একটি ফ্রাঞ্চাইজি লীগ টুর্নামেন্ট পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) আয়োজন করায় এশিয়া কাপের মতো 'হটকেক' টুর্নামেন্টের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর ও দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সাংঘর্ষিকতায় স্লট না পেয়ে আইসিসি ২০১৮ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এছাড়া অনিশ্চয়তায় আছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ভবিষ্যৎও।আইসিসির পক্ষে বিশ্বকাপ এর জন্য সিডিউল কেবল ফাঁকা আছে বছরের জুন-জুলাই সময়টায়।এই সময়টা যদি শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড তাদের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ (এসএলপিএল) চালু রাখতো তাহলে বোধ হয় বিশ্বকাপ আয়োজন করাই কঠিন হতো। টি-টোয়েন্টি লিগ গুলোর কারণে খেলোয়াড়েরা যেন 'টাকার পুতুল' হয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন দেশের ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগে খেলার জন্য অনেক খেলোয়াড়ই জাতীয় দলকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। কেউবা টেস্ট থেকে অবসর নিচ্ছেন। এছাড়া অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কথা চিন্তা করে অনেক দেশের নামী খেলোয়াড়েরা হয় পূর্ণ অবসরে যাচ্ছেন অথবা দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারদের মতো 'কোলপ্যাক' চুক্তি করছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য আরও বড় দুঃসংবাদ এই যে, সামনের দিনগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড তাদের নিজস্ব ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু করতে যাচ্ছে। এভাবে সবগুলো দেশ যদি তাদের নিজস্ব টি-টোয়েন্টি লিগ চালু করতে থাকে তাহলে টেস্ট আর ওয়ানডে ক্রিকেট বিলুপ্ত হতে বুঝি খুব বেশি সময় লাগবে না!সবকিছু ছাপিয়ে এখনকার বড় খবর এই যে,চলতি বছরের ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব অমিরাতে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বসতে যাচ্ছে ফ্র্যাঞ্চাইজি  ভিত্তিক ১০ ওভারের 'টি টেন ক্রিকেট লিগ' টুর্নামেন্ট।ফুটবল ম্যাচের মতো ৯০ মিনিট সময়সীমার এ ক্রিকেট একদিন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেই 'অরুচি' ধরিয়ে দেবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।