• ফুটবল

জিদানের সেই লাল কার্ড স্মৃতি!

পোস্টটি ১৮৬৬৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০০৬ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে এক ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল ফুটবল বিশ্বকে। ফ্রান্সের কিংবদন্তী ফুটবল তারকা জিনেদিন জিদান প্রতিদ্বন্দ্বী ইতালির এক ফুটবলার মার্কো মাতারাজ্জিকে খেলার মাঠে মাথা দিয়ে গুঁতো দেয়ার পর তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির আর নেই। সেদিনের খেলায় যিনি রেফারির দায়িত্বে ছিলেন, তিনি এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছিলেন ঠিক এভাবেই।


1280x720-yMhবার্লিনের অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি ফ্রান্স ও  ইতালি  ©Daily Motion 

২০০৬ সালের ৯'ই জুলাই। বার্লিনের অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামে ফ্রান্স আর ইতালির মধ্যে বিশ্বকাপের ফাইনাল। ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান এই খেলার মাধ্যমে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানবেন। জিদান ওই প্রজন্মের ফুটবলারদের মধ্যে এক জীবন্ত কিংবদন্তী। ভক্তদের কাছে তিনি পরিচিত জিজি নামে।

"জিদান হচ্ছেন ফুটবলের রাজা। কেউ এ নিয়ে দ্বিমত করতে পারবেনা" এক স্মৃতিচারণের জিদানের ভক্তের মুখে এমন বাক্যই বের হয়ে এল।

২০০৬ সালের এই বিশ্বকাপে জিদান এককভাবে যেন ফ্রান্স কে টেনে এনেছেন ফাইনালে। তার উপর নির্ভর করেই ফ্রান্স এখন শিরোপা জেতার স্বপ্ন দেখছে। অন্যদিকে ইতালি ভরসা করছে তাদের দুর্ভেদ্য রক্ষনভাগের উপর। যে দূর্গ সামলানোর দায়িত্ব পড়েছে ইন্টার মিলানের মার্কো মাতারাজ্জির উপর। বিশ্বকাপের ফাইনাল যেন পরিনত হয়েছে এই দুজনের ব্যাক্তিগত লড়াইয়ে।

zid1এককভাবে জিদান ফ্রান্স কে টেনে এনেছিলেন ফাইনালে © Ronaldo CR7

ওই খেলার রেফারি ছিলেন আর্জেন্টিনার হোরেশিও আলেজান্দ্রো। তার সঙ্গে সহকারী রেফারি হিসেবে আসেন ডারিও গার্সিয়া ও রুডালফো আটারো। সেবারের বিশ্বকাপে রেফারি হিসেবে এটি তাদের পঞ্চম ম্যাচ।



"আমাদের জন্য এটা ছিল একটা চমৎকার চ্যালেঞ্জ। এর আগে আমরা ৪টি ম্যাচের দায়িত্বে ছিলাম, সেগুলো আমরা ভালোই। পরিচালনা করেছি। কিন্তু, সে কথা কেউ মনে রাখেনি। সবাই কেবল মনে রেখেছে ওই ফাইনালের কথা। আমরা এখন ইতিহাসের অংশ। ম্যাচ শুরুর আগে আমি রুডালফো আর ডারিওর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি তাদেরকে বললাম এই ম্যাচেও আমাদের সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে কাজ করতে হবে।"
----এক স্মৃতিচারণে রেফারি হোরেশিও


003 ARBITRO HORACIO ELIZONDO ARGENTINOছবিঃ হোরেশিও আলেজান্দ্রো

কিন্তু খেলা শুরুর ৬ মিনিটের মধ্যই সবার দৃষ্টি রেফারির দিকে। ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডার ফ্রোয়া মালুডাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন ইতালির মার্কো মাতারেজ্জি। মালুডা আঘাত পেয়ে মাটিতে পড় গেছেন। এই ফাউলের জন্য রেফারি হোরেশিও ইতালির বিরুদ্ধে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিলেন।


"ওই মুহুর্তে সেদিকেই আমার মনোযোগটা ছিল। আমার অবস্থান থেকে ঘটনাটি আমি ভালভাবেই দেখেছি। মাতারাজ্জি তার পা দিয়ে ফ্রেঞ্চ খেলোয়াড়কে স্পর্শ করছে। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আপনি কি নিয়েছেন? আমি বলব ফাইনালে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কারন খেলা মাত্র শুরু হয়েছে এবং এটিই ছিল খেলার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত। আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরে বেশ সন্তুষ্ট ছিলাম। একজন রেফারি যখন সঠিক সিদ্ধান্ত দেন সেটা তখন তাকে খেলায় গোল করার মতই আনন্দ দেয়।" 
- স্মৃতিচারণায় হোরেশিও।

ফ্রান্সের পক্ষে পেনাল্টি শটটা নিলেন জিদান।
এবং তিনি গোল করলেন।

429-zidane-gagne-son-faceaface-sur-buffon-article_normal_image-1পেনাল্টিতে জিদানের গোল।


সেদিন বিবিসি চ্যানেলে এই খেলার ধারাবিবরনী দিচ্ছিলেন জন ম্যাটসন। তিনি তার এক স্মৃতিচারণায় বলেন, "জিদান ছিলেন সেদিনকার খেলা মূল প্রান। বল খেলায় তার অদ্ভূত প্রতিভা ছিল। দূরদৃষ্টিও ছিল। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে তার করা দুটি গোলের কথা আমার মনে পড়ছে। ওই সময়টায় ফ্রান্সের অনেক ভালো খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু তাদের সবার মধ্যে জিদান ছিল একেবারেই আলাদা। তার সমকক্ষ আর কেউই ছিল না। কাজেই জিদান যখন পেনাল্টি থেকে গোল করলেন, আমি ভাবছিলাম ফ্রান্স এই খেলায় জিততে চলেছে।"

কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইতালি এই গোল শোধ করে দিল। ইতালির পক্ষে এই গোলটি করলেন আর কেউই না স্বয়ং মাতারাজ্জি! কিন্তু অনেক গোলের সুযোগ তৈরি হলেও ৯০ মিনিটের খেলা শেষে ম্যাচটি ১-১ গোলে অমিমাংসিত রইলো।

খেলা গড়ালে অতিরিক্ত সময়ে। অনেক চেষ্টার পরােও অতিরিক্ত সময়েই কোনো পক্ষই গোল গোল করতে পারল না। তারপর খেলা শেষ হওয়ার মাত্র ১০ মিনিট আগে ঘটল সেই ঘটনা। ভিডিও রিপ্লে তে দেখা যায় মাতারাজ্জি ও জিদান ইতালির পেনাল্টি এরিয়ার পাশে দাড়িয়ে। দুজনকে অল্প সময়ের জন্য কথা বলতে দেখা যায়। এরপর জিদান সেখান থেকে পা ফেলে চলে যেতে শুরু করেন। দুই কদম এগিয়ে তিনি আবার থামেন। ঘুরে দাড়ান। তারপর অসম্ভব জোরে ষাড়ের মত মাথা বাধিয়ে মাতারাজ্জির বুক বরাবর আঘাত করেন। বিশ্বকাপের ফাইনাল দুরে থাক কোনো ফুটবল ম্যাচে এরকম চমকে দেওয়ার মত সহিংসতা এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।

Soccer WCup On This Day.JPEG-0f0f6মাটিতে লুটিয়ে পড়্বে আছে মাতারেজ্জি । © Getty Images


কিন্তু মাঠে অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেল ব্যাপারটা। এমনকি জন মটসনের ও।



"একজন ধারাভাষ্যকার হিসেবে আমাকে সত্যি কথাটাই বলতে হবে। যখন এই ঘটনা ঘটেছিল তখন আমার চোখ ছিল মাঠের অন্য প্রান্তে খেলার দিকে। আমার মনে হয় এ ঘটনা মাঠের অন্য দর্শকদেরও চোখ এড়িয়ে গেছে। স্টেডিয়ামের বড় পর্দাতেও এটা দেখানো হয়নি। কিন্তু পরে যখন আমরা সবাই ওই ঘটনাটা দেখলাম কারোরই তখন সন্দেহ ছিলনা  যে মাতারাজ্জিকে মাথা দিয়ে গুতা দিয়েছেন জিদান। তার আগে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এরপরেই জিদানকে লাল কার্ড দেখানো হল।"
- স্মৃতিচারণায় ম্যাটসন (বিবিসির ধারাভাষ্যকার)

1270534_xbig-lndজিদানের সাথে কথা বলছেন হোরেশিও । © Getty Images

"আমি প্রায় চোখ বন্ধ করেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। কারন আমি তো নিজের চোখে ঘটনাটা দেখিনি। আমি যখন খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দিলাম তখন দেখলাম মাতারাজ্জি উঠে দাঁড়াচ্ছেনা। আমি তখন চিন্তিত হয়ে গেলাম, আমি ভাবছিলাম কি হয়েছে! যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে আমি সেখান থেকে ২৫-৩০ মিটার দুরে ছিলাম। আমি ঘটনাস্থলে দৌড়ে যাই। আমার সহকারী রেফারি ডারিও কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি কিছু দেখেছেন? ডারিও জানালেন, তিনি কিছুই দেখেননি। আরেক সহকর্মী রেফরি রুডালফো বললেন, তিনিও কিছুই দেখেননি। তখনই আমি ৪র্থ জন লুইচ মেডিনার গলা শুনলাম। তিনি বলছিলেন, মারাত্বক গুতো মেরেছে, মারাত্বক গুতো! আমি বললাম, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমাকে বলুন কিভাবে এটা ঘটেছে। ওদের দুজনের কি মাথায় মাথায় ধাক্কা লেগেছিল? লুইস মেডিনা বললেন, না, আমি শুধু জিদানকেই ওর মাথা দিয়ে গুতো মারতে দেখেছি, আপনি আজ হোটেলে গিয়ে ঘটনাটি ভিডিওতে দেখতে পারেন, আপনি নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারবেন না।"
- হোরেশিও

এসব কিছুই ঘটেছিল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। হোরেশিও জানেন এই ঘটনার পর জিদানকে লালকার্ড দেখিয়ে বহিষ্কার করতেই হবে। কিন্তু তিনি এটাও জানেন জিদানের কাছে গিয়ে তাকে লাল কার্ড দেখালে সেটা মাঠের দর্শকদের মধ্যে আরো বেশি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে।

Zidane Fifaজিদাকে পেনাল্টি দেবার দৃশ্য । © Getty Images


"আমি সেখানে যাওয়ার আগেই আমি আমার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছি। আমি জানি জিদানকে বহিষ্কার করতেই হবে। দর্শকরা তখন শান্ত। তারা সেরকম কিছু ঘটবে বলে আশা করছিল না। তার পরেও আমাকে এমন কিছু করতে হলো যাতে দর্শকরা বুঝতে পারে কি ঘাটতে যাচ্ছে। আমি সহকারী রেফারি রুডালফোর কাছে গেলাম। আমি জানতাম রুডালফো কিছু দেখেননি, কিছু জানেননা। আমি তাকে বললাম, খেলার আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি কাজেই খেলার দিকে মনযোগ রাখুন। আমি জিদানের কাছে ফিরে গেলাম। দেখলাম জিদান তার বাহু থেকে অধিনায়কের ব্যাচ টা খুলে ফেলেছেন। জিদান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি জানি কীনা কি ঘটেছে। আমি বললাম, না, আমরা কেবল দেখেছি আপনি কেবল গুতো মারছেন। আমি তাকে বললাম, কি ঘটেছে আমাকে বলুন। তিনি আমাকে কিছুই বললেন না। তিনি ঘুরে দাড়িয়ে মাঠের বাইরে হাঁটা দিলেন।"
- হোরেশিও।

আমার কাছে সেদিন সবচেয়ে মর্মান্তিক মুহুর্ত ছিল জিদান যখন মাঠ থেকে বিশ্বকাপের ট্রফির পাশ দিয়ে হেটে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রফিটা রাখা হয়েছিল ড্রেসিংরুমের করিডোরের বাইরে একটা খিলানের উপর। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিদান হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন এই ট্রফি তিনি আর জিততে পারছেন না।

zinedine-zidane-france-italy-2006-world-cup-final_1fya0xdd5xyjt1o60h8w7z3ya1ট্রফির পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছেন জিদান। © FIFA


জিদানের বিদায়ের পর এই খেলা নির্ধারিত হল পেনাল্টি শুট আউটে। ইতালি ৫-৩ গোলে শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স কে হারালো। তবে এরকম এক সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে জিদানের ক্যারিয়ার শেষ হলেও তার সুনামের উপর এর তেমন কোনো প্রভাব পড়লোনা। বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন হিসেবেই তাকে ভক্তরা মনে রেখেছেন। ফ্রান্সে জিদানের ভক্তরা এই ঘটনা সত্বেও তাকে ক্ষমার চোখেই দেখেছেন।

wcup_2006_ita_2969227kবিশ্বকাপ জয়ে উচ্ছ্বাসিত ইতালি দল। © AFP


"আমি মনে করিনা যে ওই ঘটনায় জিদানের সুনাম পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। তবে এর কারনে সেবারের বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভবনা নষ্ট হয়েছে। এই ঘটনা সবসময় এই কারনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে যেখানে রেফারিকে ঘটনা না দেখেও একজন খেলোয়াড় কে লাল কার্ড দেখাতে হয়েছে।

মাঠে ৩ জন রেফারির একজনও যেখানে ঘটনাটি দেখেননি, তাই লাল কার্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে সেবার অনেক বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু রেফারি হোরেশিও আলেজান্দ্রো মনে করেন সেদিন তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত ই নিয়েছিলেন।