• ফুটবল

কামব্যাকের রাজা বার্সেলোনা

পোস্টটি ৮৩১৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কি ভাবছেন, পিএসজি এর সাথে কামব্যাকের গল্প শুনাবো???

নাহ, এখন বলব ২০১৩ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেরা কামব্যাকের গল্প, তথা তখনকার সেরা কামব্যাকের কথা

সেবার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এর শেষ ১৬ তে বার্সার বিপক্ষে লটারিতে নাম পরল তখনকার ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান।

সবাই প্রায় সিউর বার্সা কোয়াটার ফাইনাল নিশ্চিত করছে, কারন তখন বার্সা দুর্দান্ত ফুটবল খেলত টিকি-টাকার মিশেলে আর দলে ছিল জাভি-ইনিয়েস্তা-মেসি ত্রয়ী।

তাই, বার্সাকে হারিয়ে কোয়াটারে যাবে এসি মিলান এটা অনেকের কাছেই সন্দেহ ছিল।

কিন্তু, প্রথম লেগেই ঘটল অঘটন। বার্সা প্রথম লেগ খেলতে গেল এসি মিলানের মাঠ সান সিরোতে, আর সেখানেই ধরাশায়ী হল প্রতাপশালী বার্সেলোনা। সান সিরোতে কোন গোল করতে পারলোই না, উল্টো ২ টা গোল হজম করতে হল বার্সা-বাহিনীকে।

খেলার ৫৭ মিনিটে এসি মিলান প্লেয়ার কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং এর শট আটকাতে পারে নি বার্সা গোলকিপার। ফলে, ১-০ এ এগিয়ে যায় অ্যালেগ্রি বাহিনী। তারপরই, জোরালো আক্রমণ শুরু করে বার্সেলোনা, কিন্তু ফল কিছুই পায় নি,বরঞ্চ খেলার ৮১ মিনিট এর সময় ২৫ মিটার দূর পাল্লার ভলি করে সুলে মুন্তারি, যেটি আটকাতে ব্যার্থ হয় বার্সার গোলকিপার। হোম ম্যাচে ২-০ গোলের বিশাল জয় পেয়ে যায় এসি মিলান।

২য় লেগ ছিল, ১২ই মার্চ ২০১৩

তখনকার সময়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ১৬ তে ২-০ তে হেরে, কামব্যাকের ইতিহাস ছিল না কোন দলের। তাই, সবাই একরকম ধরেই নিয়েছিল শেষ ১৬ থেকে বিদায় নিচ্ছে জায়ান্ট বার্সেলোনা। আবার, এসি মিলান ইতালিয়ান ক্লাব অথার্ৎ ডিফেন্স যাদের রক্তে মিশে রয়েছে, তাদেরকে এরকম অবস্থায় পরে ৩ গোল দেয়াটা যে কতটা কঠিন ছিল সেটা বুঝতেই পারছেন, সাথে ছিল বর্তমান জুভেন্টাস কোচ অ্যালেগ্রি, তখনকার এসি মিলান কোচ ছিলেন তিনি, যিনিও একজন ইতালিয়ান, তাই তাদের গোলবার ৩ বার দুর্ভেদ্য করা বার্সার কাছে পাহাড়সমই কাজই ছিল।

কিন্তু, না দলটার নামই হচ্ছে বার্সেলেনা, যারা খেলা শেষ হবার আগে হার মানবার পাত্র নয়, নিজেদের দুর্গ নু ক্যাম্পে তো আরো নয়, সাথে ছিল তখনকার বার্সা বস টিটো ভিলোনোভার অসুস্থতা, তাই দলের মনোভাব এমনিতেই ভেংগে ছিল। ফলে, একটি কামব্যাকই পারতো পুরোনো মনোভাব ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু, খেলা শুরু হবার পুর্বেই শুনতে হল দলের অধিনায়ক কার্লোস পুয়োল দলের সাথে থাকছে না, পুয়োলকে ছাড়াই খেলা শুরু করতে হল।

প্রথম থেকেই বল নিজেদের নিয়ন্ত্রনে এনে ছন্দময় পাসিং ফুটবল খেলতে শুরু করল বুস্কেটস-আলবা-পেদ্রোরা। খেলার মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় বার্সার মাঝমাঠের কান্ডারি জাভির কাছে বল আসল, জাভি আস্তে করে সেটি ডি-বক্সের ঠিক বাইরে থাকা মেসির দিকে এগিয়ে দিল, মেসি বল রিসিভ করেই সামনে তাকাল আর বল জালে। বার্সা ৫ মিনিটেই ১-০ গোলে এগিয়ে গেল। ৫ জন ডিফেন্ডার সাথে গোলকিপার তো ছিলই, আর মেসিকে কড়া মার্কিং এ রেখেছিল এসি মিলান ডিফেন্ডাররা, তবুও ঠিক ডি-বক্স লাইন থেকে বল রিসিভ করার পর মেসি তার আলতো বাকানো শটে বল পাঠিয়ে দিল গোল পোস্টের ঠিক টপ কর্নার দিয়ে জালের ভেতরে, এসি মিলান গোলকিপার এব্বিয়াতির সেটি দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এই গোলের মধ্যে দিয়ে মেসি রিয়াল মাদ্রিদ আর ম্যান ইউনাইটেড লিজেন্ড স্ট্রাইকার রুড ভ্যান নিস্ত্রলরয় এর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের তখনকার ২য় সর্বোচ্চ গোল ৫৬ তে পৌছেছিল, আর ১ টি গোল করতে পারলেই ২য় সর্বোচ্চ গোল স্কোরার হবে লিওনেল মেসি। প্রথমেই এগিয়ে যাওয়ায় বার্সা, এসি মিলানকে আরো চেপে ধরে, এবং একের পর এক আক্রমন করতে থাকে।Placed-to-perfection

খেলার ১৬ মিনিটে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার দুরপাল্লার শট, কিন্তু এসি মিলান গোলরক্ষকের আলতো পুশে ক্রসবারে লাগে, ফিরতি বলে মেসি হেড করলেও তা গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যায়। এভাবেই কাতালান আক্রমণ এ খেলা চলতে থাকে। কিন্তু, ৩৮ মিনিটে বার্সা ডিফেন্ডার মাশচেরানোর মিসজাজিং হেডে বল চলে আসে এসি মিলান প্লেয়ার নিয়াং এর পায়ে, সামনে তখন শুধু ভিক্টর ভালদেস। নু ক্যাম্পে ৯০ হাজার এর উপর দর্শক সাথে পৃথিবীর অগনিত কিউল সবার চোখ যেন আটকে যায় সে মুহুর্তে। এরকম চাপের ম্যাচে গোলকিপারকে একা পেয়ে জোরালো শট নিতে ভুল করেন নি নিয়াং, কিন্তু বল গোলকিপার অতিক্রম করলেও জালে জড়াতে পারে নি, বল গিয়ে আঘাত পায় পোস্টে। ফলে, হাফ ছেড়ে বাচে কিউলবাসী, গুরুত্বপূর্ণ সহজতম অ্যাওয়ে গোল মিস করে এসি মিলান, সাথে কি কোয়াটার ফাইনালে উঠাও???2nd-goal

জানতে হলে সাথেই থাকুন

ঠিক ২ মিনিট পর গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পরে পুরো নু ক্যাম্প, কারন তখন বার্সা এগ্রিগেটে ২-২ করে ফেলেছে। মাঝমাঠের আরেক কান্ডারি ইনিয়েস্তা এবারের গোলের অ্যাসিস্টদাতা, আর গোল করেছে বার্সার ম্যাজিকম্যান লিও মেসি। সেসময় মেসিকে নিয়ে গুঞ্জন উঠেছিল মেসি নাকি বিগ ম্যাচের প্রেসার নিতে পারে না, বিগ ম্যাচের সময় দলকে সাহায্য করতে পারে না, এমন গুঞ্জন থেকে মুক্তি পেতে এমন ম্যাচকেই বেছে নিলেন মেসি। ইনিয়েস্তার পাস থেকে বল মেসির পায়ে, এবার আর টপ কর্নার নয়, জোরালো শটে বল জালে জড়ালেন গড়িয়ে গড়িয়ে, এবার হয়ত গোলকিপার ঝাপ দিয়েছিলেন দলকে রক্ষা করতে, কিন্তু মেসির শটের কাছে এবারো পরাস্ত। হাফ টাইমে ৭৬% বল দখলে রেখে ২-২ এগ্রিগ্রেট রেখে টানেলে ফিরল ভিলানোভার শিষ্যরা।

বার্সাকে কোয়াটারে যেতে আর মাত্র ১ টি গোল দরকার, পারবে কি বার্সা ইতিহাস পাল্টাতে???

এই অবস্থায় আবারো খেলা শুরু হল, সাথে বার্সার পাসিং ফুটবলের নান্দনিক শো। কিন্তু, গোল না হলে এসব শো করে কিছুই হবে না, তাইতো গোলের জন্য ঝাপিয়ে পরল বার্সাবাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় হাফ টাইমের মাত্র ১০ মিনিট পর জাভির বুদ্ধদীপ্ত পাস ডেভিড ভিয়ার পা খুজে নেয়, আর বল খুজে নেয় তার প্রিয় গন্তব্যস্থল জাল। গর্জে উঠে নু ক্যাম্প, গর্জে উঠে পুরো পৃথিবীর ফুটবল ফ্যানরা। ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মত ২-০ তে হারার পরেও স্বপ্নের কামব্যাক তখন সত্যিতে রুপান্তরিত হবার দ্বারপ্রান্তে।163572497.0

কিন্তু, তখনো খেলার আধা ঘন্টার বেশি বাকি। এবার খেলার চাল পাল্টে গেল, এসি মিলান এর দরকার গোল, এবার ডিফেন্স দরকার বার্সার। ডাবল চেঞ্জ করে ফেলল অ্যালেগ্রি। তবুও, বার্সার আক্রমনের ধার কমল না, ৬২ মিনিটের দিকে মেসি হ্যাট্রিক প্রায় করেই ফেলেছিল, কিন্তু তার শট অল্পের জন্য ক্রসবারের উপর দিয়ে চলে যায়। ৭০ মিনিটের পর প্রেসিং করা কমিয়ে দেয় বার্সা, মাসচে এর বদল মাঠে নামে দলের অধিনায়ক পুয়োল, ডিফেন্সকে আরো শক্তিশালী করতে। বার্সার প্রেসিং কমায়, সুযোগ খুচ্ছিল অ্যালেগ্রির শিষ্যরা, কিন্তু বার্সার জমাট ডিফেন্স এ কোনমতেই আঘাত হানতে পারছিল না। হটাৎ, এসি মিলান প্লেয়ার বোজান খুজে পায় রবিনহোর পাস, রবিনহোর শট নিতে যাবে তখনি অসাধারন চ্যালেঞ্জ করে কর্নারের বিনিময়ে সেবারের মত রক্ষা করে জর্দি আলবা।

এবার, জর্দি আলবার নায়ক হবার পালা। ইঞ্জুরি সময়ের খেলা চলছে, আক্রমনে এসি মিলান, মেসি দারুন ভাবে বল কেড়ে নিল, চারিদিকে দেখে নিতে নিতে সামনে এগোচ্ছে, কিছুক্ষন পর বল দিল সানচেজ এর কাছে, এদিকে ডিফেন্স থেকে অসাধারন দৌড়ে ডি-বক্সের ভিতর আলবা, পাস আসল সানচেজ এর কাছ থেকে, দুর্দান্ত শট এবং গোওওওওওল।

ইতিহাস হয়ে গেল নু ক্যাম্পে, নতুন ইতিহাস তৈরি হল ফুটবলের পাতায়, হাজার-হাজার দর্শক নু ক্যাম্প এ দেখল জাদুকরী কামব্যাক, আর পুরো পৃথিবী দেখল হার না মানা লড়াই।

ফলাফল:

বার্সেলোনা-৪-০-এসি মিলান ( ফুল টাইম)

বার্সেলোনা-৪-২-এসি মিলান ( এগ্রিগেট)

কোয়াটার ফাইনাল নিশ্চিত করল টিটো ভিলানোভার শিষ্যরা।

বার্সা এমন একটি দল যারা কখনো হারার জন্য মাঠে নামে না, যাদের রক্তেই রয়েছে শত শোষন-পীড়ন সহ্য করে নিজেদের লক্ষ্য পৌছানোর শক্তি। যারা একবার হারলে, শতবার মাথা উচু করে ফিরে দাড়ায়। এভাবেই, বার্সা ইতিহাস তৈরি করে কোয়াটারে গেল, সাথে সাথে আমার মত কোটি কোটি কিউলের জন্য কামব্যাকের জ্বলন্ত উদাহরন সৃষ্টি করে গেল।