• ফুটবল

অনাবশ্যক ফুটবল : মানুষের জন্য ইতিহাস..

পোস্টটি ৬৯৬৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মানুষের জন্য ইতিহাস এবং ইতিহাসের জন্য মানুষ নয়-এ দু’টি পাশপাশি ইতিহাস অগ্রগতির রূপ সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃত। একে যদি কেউ অগ্রগতিকে মেনে নেন, তাহলে সেই অগ্রগতির পরস্পরবিরোধীর ভিত্তি হতে এর অনেকগুলোই সামনে চলে আসে। শান্তির সময়ে অগ্রগতি এসেছে, এমন কি যুদ্ধের সময়কালীনও। একটি এক্সপ্রেস গতি এক-একেকটি যুদ্ধ হতে আধুনিক ভবিষ্যৎপানে টেনে নিয়ে গেছে, তা হচ্ছে সেই ফুটবল। ফুটবল খেলা দেখে আমাদের পূর্বপুরুষরা বেশি আনন্দ পেতেন না, বরং বর্তমান প্রজন্মের মানুষ তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছেন। ওটা বর্তমান প্রজন্মের জন্য প্রাপ্যই।
হোক না প্রতি প্রজন্মের, প্রতি জীবনার্থের, প্রতি সুখানন্দের, প্রতি দুখাতাশার। নইলে ফুটবল খেলা কবেই উঠে যেতো। এর নাম থাকতো না। এই ফুটবল উঠে গেলে জ্বলজ্বলে প্রজ্জ্বলিত ইতিহাসের পাতায় শুধু স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকতো কিংবা সাক্ষী গোপাল হয়ে জীবন্ত পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকতো। ইতিহাস বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি এমনই। বড় একটা ব্যাপার স্যাপার। যেটাই আসুক না কেন, ঐ অগ্রগতি ফুটবলের সামাজিক, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর ক্রীড়াঙ্গন বহমান আর এটাই উৎকর্ষের চরম নির্দশনসমূহের শেষ পরিণতি।

একটি যুদ্ধই চূড়ান্তভাবে অনাবশ্যক গতির সঞ্চালিত হয় এবং এর শিরোনাম বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো মানুষের নিকট খুব ভয়ঙ্কর ঘটনা। একে সহ্য করাও কঠিন। ফরাসি বিপ্লব নেপোলিয়নের উত্থান ঘটে, একদম যাকে বলে ‘উত্থান ঘটান নেপোলিয়ন’। দু’টির অর্থবোধক পাশাপাশি দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত। উত্থানের শিল্প বিপ্লবকে সংক্রমিত করতে গোটা ঊনিশ শতাব্দীজুড়ে সমাদৃত হয়েছিলো বটে! ফলে ইউরোপিয়ান সভ্যতাকে অবিরাম ক্রমাগত লড়াই করতে হয়েছে। যার সেই লড়াইয়ে হেরে গেছে-ঐ ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের তারই প্রমাণ মেলে।
এই দু’টি বিশ্বযুদ্ধ হতে বুর্জোয়াদের প্রতাপ সংঘটিত হয়-এটা শতভাগ সত্যি। বুর্জোয়াদের বিশ্বায়ন মহোৎসব হতে বিশ্ববিজয়ের প্রবল আকাক্সক্ষা পেয়ে বসে। প্রভূত্বের রাজত্ব সৃষ্টি করতে নাইভ ইতিহাসের আসন হতে প্রতিফলিত হয়, ফলত প্রভূত্বের প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। যুদ্ধবাজের তাড়নায় অমানবিক যুদ্ধ বিকৃত জয়ের সমাহার ঘটে যায়-একটি বৈজ্ঞানিকের, একটি প্রযুক্তির, একটি অনুসন্ধিৎসুর দরজায়..। একই সাথে ঐ প্রভূত্বের শাসন হতে একটি ভয়াবহ মারণাস্ত্র, একটি যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুভূত সৃষ্টি হয়। নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বিনির্মাণ গড়ে উঠে। নতুন উৎপাদনের উৎকর্ষতা এবং নতুন ইকোনো মার্কেট গড়ে উঠে। নতুন প্রতিযোগিতার সৃজনশীল দ্রুত তর তর করে বেড়ে উঠে। যন্ত্রের সমাহার আরো উন্নতির সোপানে পৌঁছে যাচ্ছিলো। সব মিলিয়ে এখান হতে বুর্জোয়াদের রমরমা সাফল্য চলে আসে। অবশেষে ঠিক সেই মুহুর্তে প্রচন্ড যুদ্ধের বিস্ফোরণ ঘটে যায়। ধুরুম...ঠাড়াশ...ট্রা..ট্রা..ট্রা..! বলা চলে-একটি কনটিনিউয়েশন চ্যাপ্টার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিফলনেরই দ্বিতীয় যুদ্ধ।

মাত্র ২০ বছরের ব্যবধান প্রথম যুদ্ধের পরবর্তীকাল। বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্মম ভয়াবহ। এর ছায়ায় প্রতিবিম্বিত হয় প্রচন্ড রকমের ফেটে পড়ে। নতুন ঘৃণা প্রকাশে তাদের প্রতিশোধ স্পৃহায় জেগে উঠে। তখনো পর্যন্ত বুর্জোয়ারা ধনতন্ত্রের অমানিশা ছাড়তে পারেনি। পশ্চিমী দুনিয়ায় তখন নিজের নিয়মে চলে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ মানবিক কারণে দুই হাতে শান্তির কপোত বা পায়রা উড়িয়ে দেয়। সাদা মিশনের সংকেত জানায়। ফলে এখান হতে মানুষের আর্ট ও এন্টারটেইনমেন্ট আসতে শুরু করে। নতুভাবে জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু ততোদিনে ফুটবল খেলার জোয়ার আসতে খুব বেশি দেরি করেনি। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো-প্রফেশনাল যুদ্ধ পরবর্তী ফুটবলের সংগঠন গড়ে উঠার বিষয়টি। ফুটবল খেলাকে খুব আপন করে নেয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলকে আন্তর্জাতিক রূপকার মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করানো হলো। কিন্তু বড়ই দুঃখের কথা-বিশ্ব ফুটবলের ‘টেকনিক্যাল স্কিল’ প্রচন্ড ক্ষতি হয়ে গেছে।

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যারা নতুনরূপে খেলতে নিয়ে যায়। নতুন প্রজন্মরা বলদক্ষতা নিয়ে পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় দারুণভাবে গতিশীলতা সৃষ্টি করে। সুতরাং বলতে কোনো বাঁধা নেই-গণমানুষের অবসর বিনোদনকে যুদ্ধই হরণ করে নিয়েছিলো। এর ফলে শুধু শঙ্কা-উৎকন্ঠার অস্তিত্ব ঘটনার বিনিময়ে উপহার দেয়। সেটা কিন্তু বড় বেশি তিক্ততা রকমেও। এ সময় চারপাশে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পরবর্তী নতুন চেহারার বদল ঘটে। প্রধান সম্পদ জীবিকার সন্ধান ও তাগিদ-এই দু’টোই ফুটবল হতে এসেছিলো। শয়ে শয়ে তরুণ প্রজন্মরা এতো সম্ভাবনার, এতো গতিশীলতার দিকে ঝুুকে পড়ে এবং ঐ খেলাকে আকৃষ্টবোধ করে।
চরমতম অনেক বেশি টাকা পয়সার ফ্লো ইউরোপে ছিলো। সঙ্গত কারণে ইউরোপেই ইতালীয় কাত্তানেচ্চিওকে যদি ধরতে হয়, তবে ঐ হল্যান্ডর টোটাল ফুটবলকে প্রাধান্য ও মূল্য দু’টোই দিতে হবে। ল্যাটিন আমেরিকায় ও উরুগুয়ের নেতিবাচক খেলা ধরা হলে ব্রাজিলীয় শিল্প-ছলা-কলাকে ফুটবলের আধুনিক আনন্দময়ী প্রকাশ হতে একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। এটই ধ্রুব সত্যি! এখনো ‘গ্রেটেস্ট গেইম আন্ডার দ্য সান’ হিসেবে দীর্ঘদিন যাবত টিকে আছে।
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, এদের খেলা দেখে বর্তমান প্রজন্মের দর্শকরা পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে এবং এতো দূর হতে ফুটবল নিয়ে দর্শকরা এতো দূরে দিয়ে-নিয়ে যেতে পারেন আর ঐ ফুটবল খেলা হতে তারা ততোটাই বেশি দিয়ে গেছে। আসলে ফুটবল খেলা দেখা মানে তো-কল্পনার সাথে বসবাস করা। বাস্তবে এটা কিন্তু আদৌ সত্যি নয়। ধরতে হবে-এটি একটি বোঝাপড়ার ফসল। এর বেশি বৈ আর কিছু হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি স্টাইলগত বৈচিত্র সমাহার এটি সারা পৃথিবীর ফুটবল খেলাকে দিয়েছে, পেশাদার সাফল্যের প্রকোপ প্রতিটি দেশে পড়েছে এবং একই সঙ্গে জাতীয় চরিত্র ‘খেলা’ নিয়ে প্রতিটি দেশের ফুটবল উন্নতির মহীসোপান নিয়ে শুরু করেছে। যদিও দুর্দমনীয় গতির মাধ্যমে সাফল্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চূড়ান্ত টপফর্মে পৌঁছে যায়। ফলে একেকটি ঘরাণার একেকটি বিকাশমান হতে ক্রমশ একেকটি দেশের ভৌগোলিক প্রভাব ও মানবগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন এবং মন-মানসিকতার উপর জাতীয় চরিত্রকে ভিত্তি করে বের হয়ে আসে।

বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দশকে এ ধারায় সম্পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠে। খুব উৎসাহের সাথে ফুটবল ঘরাণায় একেকটি দেশের কংক্রিট স্বয়ংসম্পূর্ণতার ফর্ম হিসেবে উঠে আসতে থাকে।
৪টি ফুটবল ঘরাণার রূপ বাস্তবে এখান হতে দেখা যায়-
১. উত্তর ইউরোপিয়ান ঘরাণা
২. দক্ষিণ (ল্যাটিন) ইউরোপিয়ান ঘরাণা
৩. স্প্যানিশ আমেরিকান ঘরাণা
৪. ব্রাজিলিয়ান ঘরাণা
প্রথম ২টি ইউরোপের এবং পরের ২টি দক্ষিণ আমেরিকার।
পেশাদার সাফল্য উপাদানের উন্মাদনায় একেবারে ট্যাকটিক্যালি-স্ট্র্যাটেজিক্যালির প্রথাগতভাবে তৈরি। সেখানে বলস্কিল্ড ফুটবল খেলোয়াড়দের মেরে-টেরে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা চালায়। প্রাসঙ্গিক বিষয়ভেদে কিছু কিছু বৈচিত্র হতে এভাবে সাফল্য পাওয়া যায়, কিন্তু এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো-বড় ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার জন্য অখেলোয়াড়ীপনা যতো বেশি চেপেছে, তার চেয়ে ততোবেশি আরো দুর্দান্ত ও প্রাণবন্ত গড়ে তুলতে চেয়েছে। এটাই ‘আয়রনি অব মডার্ন টাইম্স’। ফলে বিশাল পাঁকক্ষেত্র হতে তৈরি হয়েছে অপূর্ব শাপলার প্রতীক।

এক সময় এগিয়ে-পিছিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কৌশলগত প্রভাব গুলিয়ে যায়, আবার সেভাবে অপ্রতিরোধ্যগতিতে ভরবেগে এগিয়ে যায় এবং আপাতত আজকাল এখনো পৃথিবীর সব দেশে অপ্রতিরোধ্যভাবে ফুটবল খেলার উৎসব চলছে। সাম্প্রতিক কালে আবহমান ফুটবল খেলার বৈচিত্র একই রকম মনে হলেও প্রকৃতির কৌশলে ভিন্ন ধাঁচে ফুটবল দৃশ্যপটে দেখা যায়।
একবার একদা ব্রায়ান গ্ল্যানভিল নামে এক ভদ্রলোক কিছু পুরোনো কাটফিল্ম দেখে লিখে ফেলেন-‘বেশ ভালো লাগে, বলপ্লেয়ারদের খেলা দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু একটা ব্যাপারে ট্যাকটিক্যাল এতো কম, এতো কম স্পিড, এতো কম আন্কাভার্ড গেইম্স, এতো কম উইক মার্ক্ড মডার্ন প্লেতে প্রচন্ড নাভিশ্বাস দর্শকদের নিকট ঠেকছিলো।’
বিশ্বায়ন ফুটবল খেলার ট্যাকটিক্স নিয়ে বিজ্ঞান ভাবনার কোনো শেষ নেই। তবে সেখানে প্রাথমিক স্তর হতে কিছু কিছু লক্ষণ ধরা পড়ে, এখানে ‘সোমাচ কমপ্যাক্টের’ বিনিময়ে সৌন্দর্য প্রকাশ পাওয়া যায়। যদিও একে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, সেটি কিন্তু আসলে তা নয়। গড়পড়তা যোগ্যতাকে ঢাকা যায় না। যায়ওনি এবং এ কথা সত্যি ও প্রমাণিত। ফুটবল খেলা হতে বার বার সব প্রতিরোধ ভেঙে নতুন করে জয়-জয় করায়ত্বের সৃষ্টি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে..।

এলিস হক
ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার
আদর্শপাড়া, ঝিনাইদহ
১.৪.১৮

The_Unrestricted_Dumping-Ground._Louis_Dalrymple