• ফুটবল

ষাট দশক এবং উত্তর ইউরোপের ফুটবল ঘরাণা : টোটাল ফুটবলের প্রথম আভাস...

পোস্টটি ৫৬৩৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

Field position

বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদের ধারণা : স্পেনে এখনো টোটাল ফুটবল খেলা হয়!
প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক যে, বর্তমান ইন্টারনেট যুগে কোনো দেশ টোটাল ফুটবল আর খেলে না। খেলা হয় না। এই প্রথা এখন পুরোপুরি উঠে গেছে। অথচ ঐ বাতিল তালিকায় বনে যাওয়া টোটাল ফুটবল পদ্ধতিতে নাকি বাংলাদেশ (?!) দল টোটাল ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে-কোন্ যুক্তিতে?
বাংলাদেশের কিছু কিছু শহর এলাকায় ক্রীড়া সংগঠক, সাবেক ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়াপ্রেমী তথা দর্শকরা সদম্ভে বলেছেন, সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে স্পেনের মাঠে এখন টোটাল ফুটবল খেলছে। বাংলাদেশও টোটাল ফুটবল খেলছে। হায়রে নিয়তি!! কবে যে টোটাল ফুটবল প্রথার বিলুপ্তি তালিকায় নাম লিখে হাওয়ায় উড়ে গেছে। বাতিল মাল ! এর ফর্মূলা এখন চোখে পরিস্কার দেখা যায় না। এই না বোঝার উপর তাদের কোনো প্রদোষ নেই। তারা সেভাবে জানতেই পারেনি-টোটাল ফুটবলের চেহারা একেবারে নির্মূল হয়ে পত্রপাঠের সূত্রে বিদায় নিয়েছে। এই প্রথার পুরোপুরি বিলুপ্তি বহু আগেই ঘটেছে। মানে বুঝতে হবে-বিশ্বফুটবলের তটে তটে এর খবরে তারা টেরই পায়নি। জানতে পারেনি কখন এই কুক্ষণে ঘটনাটির কুফল ঘটেছে..ঐ হাঙ্গেরীর হল্যান্ডের, পোল্যান্ডের, সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলার পতন নিয়ে...! এবং এখনো ঐ অবগুন্ঠনের মৃতকোষ নিয়ে অচেতন অবস্থায় তারা ধরে নিয়েছে-টোটাল ফুটবল স্পেনেই (?!) হয়।
বোধ করি-অবিমৃশ্যকারী (হঠকারী) ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রকৃত রহস্য জানার চেষ্টা করি...
অনিবার্যতার কারণে লালিত পালিত হওয়া বিশ্বফুটবল খেলার ঘরাণায় সত্তর দশক পূর্বে ষাট দশকে ফিরতে হবে। ফুটবলপ্রেমীদের পূর্ব আলোড়ন সৃষ্টিকারীর মূল আদ্যপান্ত কাহিনী পড়ার ঘটনাটি অনেকের কাছে খুব ভালো লাগতে নাও পারে। তবুও সময় উল্টো¯্রােতের টানে হারিয়ে স্মৃতিকালের গর্ভগুলোর বিশদ বিবরণ আপনার পড়া উচিৎ।
ষাট দশকের শেষার্ধে একটা উত্তরণের লক্ষ্যে ক্রমাগত বিশ্বফুটবল খেলার সম্প্রসারণ শুরু হয়। এই সময়ের মধ্যে উত্তর ইউরোপিয়ানরা নতুন সৃজনশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ধ্রুবতাঁরার মতো উজ্জ্বল নক্ষত্র উত্তুরের ক্রমবিকাশ বিশ্বফুটবলের নতুন পর্দায় এসে হাজির হয়। দলগুলো তখন নতুন সিনেম্যাটিক পর্দার জগতে প্রবেশ করে। গেঁথে গেঁথে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে তৈরি হয়-স্পিড, মবিলিটি, প্রিসিশন, এ্যাকিউরেসি ও স্ট্রেন্থ। বাংলায় এভাবে রূপান্তর করার অর্থ হলো, নয়া পদ্ধতির ৫টি বৃত্তে সংযোজিত রূপসীয় ধারণগুলো হলো এই-দ্রুততম, গতিশীলতা, নিয়মনিষ্ঠা, ভ্রমশূন্যতা ও সামর্থ্য।
উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপিয়ানরা সম্মিলিতভাবে ৫টি বৃত্ত তত্ত্বের উপর নতুন করে ক্রীড়া গবেষণার কাজে নেমে পড়ে। তারা নতুন ফর্মূলা ও সংস্কারপূর্ণকে বাস্তবায়নে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা চালায়। এবং ফলশ্রুতিতে ধারাবাহিকতার পর্বে একই সাথে নতুন তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগে সাফল্য অর্জন করে। সমস্ত ইউরোপিয়ান ক্লাবসমূহ ও আন্তর্জান্তিক স্তরের ফুটবলাঙ্গনে নতুন মাত্রায় সৃষ্টি হয়। নতুন অবকাঠামো তৈরি হয়। যে কারণে ঐ সময়ে নতুন তত্ত্ব হতে সত্তর দশকের প্রথমার্ধে নবপ্রচারিত ‘সমগ্র ফুটবল পদ্ধতি’ বা ‘টোটাল ফুটবল’ এর সোনাখচিত রূপকথার মতো গল্পকাহিনী বেরোয়। এবং সাফল্যের দরজায় প্রবেশ করে।

টোটাল ফুটবল বা সমগ্র ফুটবল পদ্ধতি কি?
১৯৬৫ সাল। বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ফুটবল চিন্তাবিদ রাইনাস মিশেলকে আপনাদের আজীবন স্যালুট করে যেতেই হবে। ফুটবল ভাবুক রাইনাস মিশেল কি মন্তব্য করেছেন, তা আজ অপ্রকাশিত। প্রশ্ন উঠে-টোটাল ফুটবল কি এবং কেন? টোটাল ফুটবল স্টাইলের বাংলা অর্থ হলো-সমগ্র ফুটবল পদ্ধতি। আবার ড. মেইলি মেইসান টোটাল ফুটবলের ধারণাটি প্রথম উদাহরণ তুলে ধরেন। প্রায় তিন দশক আগে তিনি একে হুইল বলেছিলেন। বাংলায় ‘ঘূর্ণি আক্রমণাত্মক’।

টোটাল ফুটবল নয়, প্রথম নাম ছিলো ‘প্রেসিং ফুটবল’
আসলে ভিন্ন অর্থে একে প্রেসিং স্টাইল বলা হয়। এই নাম দিয়েছিলেন স্বয়ং রাইনাস মিশেল। এর বাংলা মানে হলো-আক্রমণাত্মক পদ্ধতি। কিন্তু টোটাল ফুটবল স্টাইলটি উজবুক ক্রীড়া সাংবাদিকরা ইচ্ছা করেই পছন্দের অর্ধ প্রকাশের মাধ্যমে লিখে প্রচারের বিশেষ মাহাত্ম্য বাড়িয়ে তোলেন। ফলত নামটি ঐভাবে ব্যাপৃত হয়।
প্রেসিং স্টাইল বা টোটাল ফুটবল স্টাইলের প্রধান ধর্ম হলো-‘এই এমন একটি খেলা যাতে গোলকিপার বাদে ১০ জন সমানে সামনের দিকে চাপ সৃষ্টি করে খেলবে। সারাক্ষণ বল ধরতে হবে। এমন কি নিজেদের দখলে বল যখন থাকবে না, তখনো পর্যন্ত ঐ কাজটি করে যেতে হবে। যখন নিজেদের দখলে বল থাকবে না, তখনো পর্যন্ত নিজেরা বিপক্ষ সীমানায় আক্রমণ করতে পারবে না ঠিকই; কিন্তু তখন বিপক্ষ সীমানায় বল ছাড়াই খেলোয়াড়টিকে আক্রমণে যোগ দিতে হবে। বল ছাড়া মাঠের যেকোনো জায়গায় প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হয়ে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে করে সেখানেই বলের দখল ফেরত পাওয়া যাবে এবং এখান হতেই একটা ক্রমাগত আক্রমণ ঘনিয়ে তোলা যাবে।’
কিভাবে খেলবে? ছোট ছোট পাস দিয়ে খেলা। দ্রুত নয়, নিজেদের সীমানায় ধীরে ধীরে খেলা। তারপর চলমান প্রক্রিয়া দেখে প্রতিপক্ষের সীমানায় অতিক্রম করা-ঐ ধীরগতির খেলায় খেলে যেতে হবে। তারপর বিপক্ষের ডি বক্সের ভেতরে যাওয়ার মুহূর্তেই বদলে গিয়ে দ্রুত দৌড়ে কুইক পাস খেলা। ওয়ান টাচ নয়, বহু টাচে খেলতে খেলা। গ্রাউন্ড পাস, স্কোয়ার পাস ও ফরোয়ার্ড পাস যথারীতি খেলে যাওয়া-এই হচ্ছে খেলার স্বাভাবিক ধর্ম।

মার্কিংয়ের নির্দিষ্ট ছক ভেঙে দেন রাইনাস মিশেল
রাইনাস মিশেল তত্ত্বকাঠামো আরো স্পষ্ট বক্তব্য করেন-‘মার্কিং ব্যাপারটা দারুণ গোলমালে আসে। জোনাল ও ম্যান মার্কিংয়ের সঙ্গে মিশে একটা পদ্ধতির উদ্ভব যখন হয়। তখন সবচেয়ে নিকটে ওদের বিপক্ষ লোকটাকে ধরে ফেলো। মাঠের চারপাশে দ্রুত তাকিয়ে খেয়াল রেখো। বিপক্ষ দলের কোনো ফাঁকা লোক তোমার বিপদসীমানায় ঢুকতে চেষ্টা করলেই তাকে ধরে ফেলো।’
রাইনাস মিশেল আরো বলেন, ‘বল হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমি ছেলেদের এটার উপর কৌশল প্রয়োগ করতে শিখিয়েছিলাম। কিন্তু মার্কিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট ছক আমি-ই ভেঙে দিয়েছিলাম। আমি জানি, খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত বুদ্ধিবৃত্তির উপর দক্ষতা থাকা চাই এবং এ পদ্ধতির রপ্ত করা চাই। এবং এটা করা খুব কঠিন কাজ। এটা এক বছরের ফলাফল বা প্রত্যাশিত খেলা একদিনে গড়ে উঠেনি। বহুদিনের অভ্যাস, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লেগেছে। দলকে অমানসিক পরিশ্রম, কাঠখোড় পুড়িয়ে ফুটবল স্টাইলের সাধনায় থাকতে হয়েছে। এবং এটাকে রপ্ত করতে পারার দারুণ করুণতম বিপর্যয়, বিপর্যস্ত আর শোচনীয় পরাজয় বরণের মধ্যদিয়ে আমাদেরকে ধ্বংস-স্তুপে যেতে হয়েছে।’
পাশাপাশি টোটাল বা প্রেসিং স্টাইলের বিভিন্ন টেকনিক অভ্যস্ত সম্পর্কে একটা কুফলের আশঙ্কাও আঁচ করতে পেরেছিলেন তবুও রাইনাস মিশেল মন্তব্য করেন-‘অথচ দেখুন, একজন খেলোয়াড় যখন ওদের বিপক্ষের আরেকজন খেলোয়াড়কে মার্ক (কড়া পাহারা) দেয়, তখন এই সম্ভাবনাও বেশি সুযোগ থেকে যায়। যখনোই তখন একদল বল ফেরত যায়, তখনোই সে আগে হতে যাকে মার্কিং রেখেছিলো-সেই খেলোয়াড়টি মার্কারে (আটকে যাওয়া) পরিণত হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বার বার মার্কার হওয়া সত্ত্বেও তারা উপরে যায়, এতে বিপদ বাড়ে। এবং প্রতিরোধের কোনো সুযোগ থাকে না। খুব সামান্য এর বিকল্প থাকে। একটা পদ্ধতিতে এর উপায় বের করতে হয়। সেটা-নিজের দল যখন বল নিয়ে নিজেদের পায়ে দখলে রেখে খেলতে যাওয়া।’

খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বড় কাজ : দূরে সরে যাওয়া ও ফাঁকা জমি খোঁজা...
একজন আধুনিক খেলোয়াড়ের কাজ হলো-‘সরে গিয়ে আরো দূরের জায়গায় গিয়ে ফাঁকা সময় ও জমির খোঁজ করা। এই জমির জন্য ব্যক্তিগত অনুসন্ধান বের করা-একজন খেলোয়াড়ের বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল। যা গোটা দল এমন এক আকর্ষণীয় পদ্ধতির সৃষ্টি হয়, যে দর্শকরা একদম নতুন কিছুর স্টাইল দেখতে পাচ্ছে বলে মনে করা হয়। এবং ফুটবল দর্শকরা একে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলো-‘টোটাল ফুটবল স্টাইল’। ‘প্রেসিং স্টাইল’ পর্যন্ত মিচেল স্বয়ং রেখেছিলেন। কিন্তু স্পোর্টস মিডিয়ার জোরে সেটার নাম পাল্টে বিশ্বের গ্রাউন্ডে গ্রাউন্ডে ‘টোটাল ফুটবল’ লিখিয়ে প্রচারিত হয়ে যায়।
নামের মাহাত্ম্য প্রচার ও প্রসারের পূর্বে এই পর্যায়ে এ যাবত হাঙ্গেরী ইউরো ফুটবলের গতি-প্রকৃতি ও দিক-নির্দেশনার ইঙ্গিত দিয়ে খেলে যাচ্ছিলো। এই চিন্তা-ভাবনার প্রভাব রাইনাস মিশেলের মস্তিষ্কে প্রবলভাবে রূপধারণ করেছিলো। কিন্তু সুবিচারের বেলায় সুনির্দিষ্টরূপে এর ব্যাখ্যা দেয়া সত্যিই কঠিন। এই কারণে যে, মিশেলের দল ফুটবল আরো ভালো হচ্ছিলো এবং আর সেটাই সব কিছু নয়।

এলিস হক
ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার
আদর্শপাড়া, ঝিনাইদহ।
৪.৪.২০১৮