• ফুটবল

নান্দনিক ফুটবলের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন

পোস্টটি ৩৯৫০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

উত্তর ইউরোপের এক দেশ। নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নাম এখন আর নেই বললেই চলে। শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার নামেই এখনকার বিশ্বে সমধিক পরিচিত। অতুল শক্তিধর রাশিয়া, খেলাধুলার জগতে এক বিপুল বিস্ময়। ওদের সবচেয়ে বড় সাফল্য সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আয়োজন বিশ্ব অলিম্পিক গেমস। সেখানে রাশিয়ার যেকোনো সাফল্যের সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের তুলনা করা যেতে পারে।

সোভিয়েত রাশিয়া শ্রেষ্ঠ আদর্শ, স্বাস্থ্যবান জাতি ও সুখী-সমৃদ্ধ পরিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্ম নিতে পারা-ক্লেদ্যজ কুসুম ফুটবলের অবিস্মরণীয় মুহূর্ত এমন কিছু, অথচ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কাছে এসব বিচিত্র কারবারের ধারে কাছেও কিছুই নয়। অন্য সব খেলার চেয়ে তাদের ফুটবলের জিৎ পারতপক্ষে এটা আদৌ মনে রাখার মতো এমন কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না।
আবার একে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও পরীক্ষা যাবে না, এমনকি পরিমাপ দিয়েও নয়। এর কারণ, এদের খেলাধুলার শিকড় অনেক গভীর, একেবারে বায়বীয় সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মতো গভীর।

রাশিয়ার দল বহুদিন ধরে ফুটবল খেলছে। ৫-৬টি দেশ বিশ্ব ফুটবলখ্যাত এলিট স্তর জায়গায় দিনকে দিন খেলে আসছে এবং সোভিয়েত রাশিয়া তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক শক্তিধর দল। রাশানরা উত্তরীয় ফুটবল ঘরাণার অধিকারী এবং এদের সার্বিক বল খেলার প্রতি পূর্ব ইউরোপিয়ানের যত প্রভাব এবং খেলার প্রতি যথেষ্ট টান রয়েছে।
তবে একটা লক্ষণীয় বিষয়, ঘটার মতো কিছু পরিস্থিতি, কিছু নেতিবাচক আচরণ রাশিয়ানরা আগে কখনো এই ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়নি বা কখনো আশ্রিত হয়নি কিংবা তাদের চরিত্রের মধ্যে ছিল না। অথচ রাশিয়া সেই সংকীর্ণ পথ মাড়িয়ে চলার এমন দুঃসাহস দেখিয়েছে, যা কোনো দেশের মধ্যে তাও নেই। অত্যন্ত স্পর্শকাতর অথচ বিয়োগান্তক ঘটনা নানা সময়ে বহুবার ঘটেছে, এই রকম কোনো মানে যুক্তি থাকতে পারার কথাও নয়। কারণ, পৃথিবীজুড়ে ধুরন্ধর অভিনয় ভরে গেছে, কেউ যদি ইতিবাচক আচরণ করতে চায়, তাতে দোষের কিছু হবে না।

যেমন-১৯৮৫ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের একটি ম্যাচের কথা ধরা যাক-কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত রাশিয়া-ডেনমার্কের মুখোমুখি হয়, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার মান ও শক্তি যাচাই করতে সেই গ্রুপেরই আরেকটি দল সুইজারল্যান্ডের কোচ কোপেনহেগেনে উড়ে যান। ঐ কোচ রাশিয়াদের খেলা দেখলেন বটে, খেলা শেষ হলে তিনি স্বয়ং এই ম্যাচকে ‘ভয়াবহ’ বলা ছাড়া আর কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি। তারপর তার কন্ঠে একটা অস্ফূট উচ্চারণ-‘ফুটবলে এটাই সেরা’।

সারাক্ষণ খেলায় ড্যানিশ ২৩ বার এবং রুশীয় ১৭ বার শট গোলবারে বল উড়িয়েছে। থ্রো-ইন, গোলকিক, ফ্রি-কিক কিছুই বাদ যায়নি, খেলাও থামেনি। স্বয়ংক্রিয় টানা শ্বাসরুদ্ধ খেলা। এই নির্বিঘœ লড়াইয়ে রেফারিকে মাত্র ৩ বার ফাউলের বাঁশি বাজাতে হয়েছে। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য তাদের ইতিবাচক খেলা!! এমন ইতিবাচক খেলা কদাচিৎ দেখা যায় না।

রাশিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়া ঐভাবে কখনো সম্ভব নয়। ৪-২ গোলে রাশিয়া পরাজিত হয়, যদিও সেটা বড় বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো-ফলাফল তুচ্ছ, সাধনাই ফুটবলের আসল কথা। রাশিয়া বহুদিন মনে-প্রাণে তাই বিশ্বাস করে আসছে এবং ফুটবল সাধনার জন্য রাশিয়ানদের ট্যাকটিক্স ও স্ট্র্যাটেজির ইতিবাচক মনোভাব সব সময় খেলার ভেতরে ও বাইরে একই কাতারে থেকেছে।

শুধু তাই নয়, রাশিয়ানদের আরেকটি পরিচয় আছে, সেটা হচ্ছে-‘খেলোয়াড়ী ভদ্রতা’। ওরা এই ভদ্রতাবোধকে সবচেয়ে দামি সম্পদ বলে মনে করে থাকে। ভদ্রতা মাঠের বাইরে ও ভেতরে কখনো ঢোল খায় না। তাদের খেলা দেখে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হবে। পূর্ণ ব্যবচ্ছেদে একটা সপ্রতিভ দল।
রাশিয়া বাদে অন্য দেশগুলোর দল খেলাচ্ছলে ছোট লোকমি খেলতে ও দেখতে অভ্যস্ত। ভদ্রতার সাধনা আয়ত্তে আনা কঠিন বৈচিত্র্য কিছু নয়। ফুটবলীয় পরিবেশ সাধনার ব্রতী অর্জনে ওদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে-এটাই ওদের নৈতিকতার দর্শন। কী গভীর মানবিক মূল্যবোধ তাদের মনে। ঐভাবে তারা গড়ে তুলেছে অগাধ আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে। খেলার মাঠ বলেই নয়, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে ওরা এমনিতেই পারদর্শী। ভদ্রতার গহীনে সব কিছু সেভাবেই তারা তৈরি করে নিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক-১৯৮৬ সালে মেক্সিকো গ্রাউন্ড, বিশ্বকাপ প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালকে কেন্দ্র করে একটা ঘটনা। এখানে রাশানদের খেলোয়াড়ী ভদ্রতার নির্দশন আরেকবার খুঁজে পাওয়া যায়। রাশিয়া প্রথমে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকলেও বেলজিয়াম পরে ২টি গোল শোধ করে সমতা আনলো। ২-২, ব্যস! আর কিছু ভাবতে হবে না। বেলজীয়দের দেয়া ঐ ২টি গোল উপস্থিত দর্শকদের কাছে পরিস্কার অফসাইড মনে হয়েছে। অফসাইড থেকে গোল হয়, যেটার প্রবিধান আইনে কোথাও লেখা নেই। রেফারির সদ্যসিদ্ধ আইনই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।

নীতিগতভাবে ফুটবল খেলা রচিত আইন সব খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সমান ও নিরপেক্ষ। নীতিবাগীশ আর না হোক, খেলোয়াড়ের অপরাধ ব্যতিরেকে পরিশুদ্ধ গোল হলেই সে পরিস্কার গোল হয়েছে বলে এটা ধরে নেয়া যায় কিন্তু শুদ্ধ গোল হলেও গোল হয়েছে এমন কথা কেউ যদি ভাবেন, তাহলে তা হবে নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ।
আইনকে পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে দেখা যায়, ভুল জায়গায় অপারেশন করছে ডাক্তাররা। ডাক্তার তো আর মৃত বা জীবিত রোগীর এহেন কার্যকলাপে ভুল করতে পারেন না। নির্ভুল অপারেশনটা আসল কাজ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তাররা কখনো ফেরেশতা নন। তাছাড়া তারা নির্ভুুল কাজ করতে পারবেন, সেটার নিশ্চয়তা কী? যে চাইলেই সবকিছু হাতে পাওয়া হয়ে যাবে না। পোস্টমর্টেমের এক ফালি দাগও আগে-পরে এমন কিছু দৃষ্টান্ত নেই।

সবচেয়ে বড় কথা-রাশিয়া খেলার আইনকে চিরকাল শ্রদ্ধা ও সদ্ভাব প্রদর্শন করে আসছে এবং আজও। এটাও ওদের দেশে মজ্জাগত অভ্যাস। তবুও শেষ অবধি প্রতিপক্ষের কাছে ইনজুরি টাইমে রাশিয়া ৩-৪ গোলে হেরে যায়। কী ভীষণ সাংঘাতিক ঘটনাই বটে! একটা অভাবনীয় কান্ড কী করে হয় তা ভাবতেও গলদঘর্ম হয় আর কী! যা কিছু ঘটেছে তা অস্বাভাবিক প্রত্যাশিত খেলা। সেটা আবার কী রকম? এই যে রাশিয়া ৪ গোল খেয়েও রেফারিকে ঘিরে ধরেনি, মাজায় বা কোমরে হাত তোলেনি, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেনি, এমনকি মৃদু প্রতিবাদও করেনি, তাহলে? কী চূড়ান্ত প্রতিবাদহীন ভাষা!
বিরক্তের দল বলে সোভিয়েতের অভিধানে নেই। শুধু একটা জায়গায় বিদ্যমান সংবাদ সম্মেলনে ওরা স্বল্প কথা বলেই শেষ করলো। রাশিয়ার টিম ম্যানেজার মৃদু স্বরে বললেন-‘একটা গোল বোধ হয় অফসাইড ছিল’।

এবার ভাবুন তো অন্য কোনো দেশের কথা হলে কী অবস্থা দাঁড়াতো? উত্তর-দক্ষিণ ইউরোপের কথা তো কোন্ ছার! লেখা যাক-বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ঢাকা মুক্তিযোদ্ধা-মোহামেডান ও ব্রাদার্স-রহমতগঞ্জের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্লাবের কর্মকর্তা, বয় বেয়ারা অবধি রেফারিকে উদ্দেশ্য করে খিস্তি-খেউর করছে। তার স্বরে চিল্লাচিল্লি করছে, পারলে তাকে অপমান করছে। তাতে কেউ না কেউ বলেই ছাড়তো-‘এটা আলবৎ অফসাইড গোল’। রেফারি কী আর করবেন? বাই লজে যা উল্লেখ আছে, সেটাই মেনে চলছেন রেফারি। কিন্তু ওরা? রেফারির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে খেলোয়াড়রা মাঠের বাইরে চলে যান, ১৫-২০ মিনিট খেলা বন্ধ থাকে। কী সুন্দর নমুনা বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর খেলোয়াড়দের!

ফুটবল আইন পড়েননি-এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা বোধ করি ভুরি ভুরি। এই সময় নষ্ট দুই-ই মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এমন অজ্ঞই চূড়ান্ত সর্বনাশের মূল কারণ। নষ্ট যেমন হচ্ছে, অশ্রদ্ধাও তেমনি করে বাড়ছে। প্রতিকার চেয়ে প্রতিবাদ করে কী-বা লাভ হয়! জানা নেই।


এলিস হক
ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ লোকাল স্পোর্টস কমেন্টেটর্স এসোসিয়েশন, ঢাকা।
৭.৫.১৮

 

urss-cccp-cup-1966