প্রথম বিশ্বকাপ সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?
পোস্টটি ৬৬৮৭ বার পঠিত হয়েছেসময়ের স্রোতে ভেসে ফিফা বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ১৯ টি আসর, রাশিয়া ২০ তম আয়োজক।
গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ...সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে আবেগের খেলার বৃহত্তম আসর।
টিভির পর্দায় খেলা, ফেসবুকের পর্দায় অম্ল মধুর লড়াই। প্রিয় দলকে ভালোবেসে অপর দলকে ভার্চুয়াল কাঁদা বর্ষণ ...রাশিয়া আসরে মোটামুটি এই হচ্ছে আমাদের দেশের হাল হকিকত। আগের আসরের অনেক দ্রষ্টব্য খেলোয়াড় অনুপস্থিত। নেদারল্যান্ডস, ইতালি শেষ ৩২ এর টিকিট কাটতে পারেনি। অবসর ভেঙে মেসি ফিরে এসেছেন, রোনালদো বুড়িয়ে যাওয়াকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একেবারে রোমান যোদ্ধার মত। রাশিয়ার সাথে সময়ের ব্যবধান কাছাকাছি হওয়াও ঈদের মৌসুমে বাঙালি জুতসই সময়ে খেলা দেখতে পেরে যারপরনাই খুশি। আচ্ছা, কখনও ভেবে দেখেছেন কী, প্রথম বিশ্বকাপের আসর কীভাবে হয়েছিল? নিজে জেনে খুব আনন্দ পেয়েছি, আপনাদের জানাতে চাই সেই ঐতিহাসিক প্রথম আসর সম্পর্কে। ছোট পরিসরের এই লেখায় চেষ্টা করেছি যতটুকু সম্ভব তুলে ধরার।
যাত্রা হলো শুরু
১৯৩০ সাল। এ বছর বিশ্বের খেলাধূলার জগতে অবিস্মরণীয় একটি দিন। অলিম্পিকে ইতিমধ্যে ফুটবল অফিসিয়াল খেলার মর্যাদা পেয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন স্রেফ ফুটবল নিয়ে এমন একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, যাতে অলিম্পিকের সাথে টক্কর দেয়া যায় সার্বজনীনতা ও জনপ্রিয়তার বিচারে। ফিফা কর্তাদের তাই এক দাবী এক লক্ষ্য, ১৯৩০ সালেই হবে বিশ্বকাপের প্রথম আসর। তা সেই মহাযজ্ঞের ভার নেবে কোন দেশ? মানে একটা দেশকে তো গুরুদায়িত্ব নিতে হবে প্রতিযোগিতা পরিচালনার জন্য। নানা দেশের খেলোয়াড় এসে ভিড়বেন সে দেশে। এক দেশের সীমানার ভেতর একাধিক মাঠে হবে বিশ্বকাপ। চাট্টিখানি কথা? তৎকালীন ফিফা প্রধানের নাম জুলে রিমে। জাতে তিনি ফরাসি। তার কাছে পাঁচটি দেশের আবেদনপত্র এসেছে। দেশগুলো হলো সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, হাঙ্গেরি ও উরুগুয়ে। প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক হতে চায় তারা। বেছে নিতে হবে একটি দেশকে। জুলে রিমে ভেবে দেখলেন, উরুগুয়ে দলটা সময়ের সেরা ফুটবল খেলুড়ে দেশ। সর্বশেষ অলিম্পিকে তারা স্বর্ণজয়ী। তাছাড়া ১৯৩০ সাল উরুগুয়ের জাতীয় ইতিহাসে গুরুত্ববাহী, সে বছর নিজস্ব সংবিধানের শত বর্ষপূর্তি উদযাপন করবে তারা। অর্থাৎ স্বাধীনতার এক শতাব্দী। উরুগুয়ের হাতে বিশ্বকাপ আয়োজকের ভার দিলে সে দেশের আনন্দের উপলক্ষকে দ্বিগুণ রাঙিয়ে দিতে পারবে ফিফা। প্রথম আসর হিসেবে নজর কাড়ার সুযোগটাও পোক্ত হবে। তাই জুলে রিমে মশাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত দিতে দেন উরুগুয়ে হবে বিশ্বকাপের আয়োজক। উরুগুয়ে খুশি স্বাধীনতার শতবর্ষে বিশ্ব ফুটবল সারথীদের আতিথেয়তা দেবার সুযোগ পেয়ে, কিন্তু বাকি যারা আয়োজক হতে চেয়েছিল তাদের কী হবে? বাকী চার দেশ, তারা নিশ্চয়ই মনঃক্ষুন্ন হবে? একটু আধটু অভিমান করা তাদের সাজে, উরুগুয়ে যে তাদের আরাধ্য সুযোগ পেয়ে গেল!
উরুগুয়ের ফুটবল সংস্থার প্রধান হাতে জুলে রিমে ট্রফি তুলে দিচ্ছেন ফিফা প্রধান জুলে রিমে। কালের পরিক্রমায় জুলে রিমে ট্রফিই আজকের ফিফা ট্রফি।
সেই চারটি দেশ সেবার আর বিশ্বকাপে অংশগ্রহনই করেনি। ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ খেলতে আসেনি। কারণ জানতে চান? অবাক হবেন। সেকালে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমন ছিল খুবই কষ্টসাধ্য, তাই দলগুলো ভাবলো থাক এবার তবে ক্ষান্ত দেই। পরের বার না হয় যাওয়া যাবে।
ফিরে দেখা
উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে শুরু হয় প্রথম বিশ্বকাপের আসর। আসলে সবগুলো খেলাই হয়েছিল রাজধানীতে, তিনটি ভেন্যুতে। বেশিরভাগ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এস্তাদিও সেন্তানারিও (সেঞ্চুরি স্টেডিয়াম)। মোট দল ছিল ১৩ টি। প্রথম পর্বে খেলা হয় চারটি গ্রুপে, প্রতি গ্রুপের সেরা দল খেলে সেমিফাইনালে। সর্বমোট ১৮ টি ম্যাচ হয়েছিল সেবার।
রোমানিয়া ফুটবল দল গঠন করেন সে দেশের রাজা 'কিং ক্যারল টু'। তিনি খেলোয়াড়দের আশ্বস্ত করেন যে বিশ্বকাপ শেষে তারা স্ব স্ব কাজে যোগ দিতে পারবে। অন্যদিকে ফরাসিদের দল গঠন করেন স্বয়ং জুলে রিমে। যদিও ফ্রান্সের সেরা সেরা সব খেলোয়াড় আর প্রধান কোচ শেষ মুহূর্তে আর উরুগুয়েতে খেলতে যাননি। সার্বিয়ার দুটি ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে গঠিত হয় যুগোশ্লাভিয়া দল।
ফাইনালের মাহেন্দ্রক্ষণ
৩০ জুলাই, দিনটি বুধবার। গ্যালারিতে ৬৮ হাজার দর্শকের মুখরতায় উৎসবমুখর পরিবেশ। উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনা দল মুখোমুখি ফাইনালে। ফাইনাল ম্যাচের সব মালমশলা উপস্থিত। উরুগুয়ে এগিয়ে যায় পাবলো দোরাদোর গোলে, ১২ মিনিটে। গোল শোধ করতে মরিয়া আর্জেন্টিনা। পরের ৮ মিনিটের মধ্যেই সমতা আনেন কার্লোস পিউসেল্লে। এখানেই শেষ নয়, আবারও ৩৭ মিনিটে গুইলেরমো স্তাবিলের গোলে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। শেষ হয় প্রথমার্ধ।
দ্বিতীয়ার্ধে মন প্রাণ উজাড় করে ঝাপিয়ে পড়ে উরুগুয়ে, স্বদেশের মাটিতে স্বাধীনতার শতবর্ষে কাপটা কোনভাবেই খোয়ানো যাবেনা চিরশত্রু আর্জেন্টাইনদের কাছে। দেশবাসীর কাছে মুখ দেখানো যাবেনা তাহলে! এবার গোল আসে উরুগুয়ের পেদ্রো সিয়ার পা থেকে। স্কোরবোর্ডে ২-২। ৬৮ মিনিটে ৩-২ এ এগিয়ে যায় উরুগুয়ে, গোল করেন ভিক্তোরিয়ানো ইরিয়ার্তে। ঘাম ছুটে যায় আর্জেন্টিনার। ভাগ্যদেবী উরুগুয়ের পক্ষে ছিল, ৮৯ মিনিটে চার নম্বর গোলটি করেন হেক্টর কাস্ত্রে। ৪-২ গোলে ফাইনাল জিতে মন্টেভিডিওকে উৎসবের নগরীতে পরিণত করে ওরা ১১ জন (এবং আরো অনেকে)।
ফাইনালে মুখোমুখি উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনা
যাক, প্রথম বিশ্বকাপ গেল ল্যাটিন আমেরিকায়। পরের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতালিতে। ১৯৩৪ সালে। কিন্তু ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির দেশে গিয়ে আর অংশ নেয়নি। কারণ?
উরুগুয়ে থেকে ইউরোপ ভ্রমণ অসম্ভব কষ্টসাধ্য, তাই।
সেই ফাইনাল খেলা ফুটবলারদের কেউ আজ বেঁচে নেই, আছে তাদের কিংবদন্তি।
তথ্যসূত্রঃ A টু Z বিশ্বকাপ (লেখকঃ রুহুল মাহফুজ জয়, প্রকাশনীঃ ঐতিহ্য)
- 0 মন্তব্য