লায়ন্স অফ তেরাঙ্গা:
পোস্টটি ৪৯৪৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
লায়ন্স অফ তেরাঙ্গা:
এক অদ্ভুত নামের বাস্তব গল্প। সেনেগাল প্রজাতন্ত্র পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম ডাকার। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী নাম তার সেনেগাল এই নদীর নামেই দেশটির নামকরণ করা হয়।
সেনেগাল নদী দেশটির পূর্ব ও উত্তর সীমান্ত নির্দেশ করে। সেনেগালের পশ্চিমেই অবস্থিত আবার আটলান্তিক মহাসাগর। রাজধানী ডাকার থেকে অনেক অনেক দূরে দক্ষিণ সেনেগালে অবস্থিত একটি অতি দরিদ্র ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম তার বামবলি। তার উপর জনসংখ্যার একটা তীব্র চাপ। আর নিরক্ষতা যেন গ্রামটাকে চেপে ধরেছে চারদিক থেকে।
একটা মজার ব্যাপার লক্ষনীয় আমাদের রাজধানীর নামের সাথে কত মিল! যাই হোক সেই বামবলি গ্রামেই খেয়ে না খেয়ে বাস করতেন এক জোড়া দম্পতি। অভাব যাদের নিত্য সঙ্গী। এক বেলা খাওয়ার পর আরেক বেলা উপোস করতে হবে এটা তাদের জীবনের অতি পরিচিত অধ্যায়। এদিকে আবার এক গাদা সন্তান। পিতা-মাতা অসহায় দুই জোড়া চোখ দিয়ে সন্তাদের ক্ষুধার্ত মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আদতে কিছুই করার ছিলনা। এ ভাবেই কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। সেনেগালের আকাশে একদিন ভারী বর্ষণ। এ যেন রহমতের বর্ষণ।সময়টা ছিল ১০ এপ্রিল ১৯৯২ দিনটি ছিল শুক্রবার মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে, সেখানকার গরিব গ্রাম বামবালি এর এক ধার্মিক মুসলিম পরিবারে জন্ম নিল সাদিও মানে নামের এক ডায়মন্ডের। স্থানীয়রা যাকে নাম দিয়েছেন ব্ল্যাক ডায়ামন্ড নামে।
তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল হাতে গুনার মত, এক কথায় অনেক। তার পিতা এতটাই গরীব ছিল যে সন্তানদের চাহিদা ঠিক মতো পূরণ করতে পারতেন না। অর্থাভাবে কোনো সন্তানকেই স্কুলে পাঠাতে পারেননি, যার মধ্যে ছিল মানেও। পড়াশুনোর সুযোগ নেই কি আর করবে এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলেই কাটতে থাকে তার বাল্যকাল। তাও ফুটবল বলতে নিজেদের বস্তা আর পলিথিন গোল করে ফুটবল বানিয়ে ফুটবল খেলা।
ছোট থেকেই মানে ভক্ত ছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন সে ওখানে খেলবেই খেলবে। কিন্তু কীভাবে? বাবা–মা কোনো দিনই মানের ফুটবল খেলা সমর্থন করেননি। পিতা মাতা চেয়েছিলেন মানে ধর্মকর্ম নিয়ে পড়ে থাকুন। কিন্তু ছোট্ট ছেলেটা কারও কথায় কান দিলনা। নিজের ছোটবেলা সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে মানে বলেছিলেন, ‘যখন আমার দু–তিন বছর বয়স, তখন থেকে বল ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পেতাম না। রাস্তায় যখনই কেউ বল খেলছে, আমি নেমে গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দিতাম। কোথাও ম্যাচ হলে দেখতে যেতাম। যাদের খেলা ভালো লাগত, তাদের মতো করে খেলার চেষ্টা করতাম। এর নাম অধ্যাবসায়।
মানের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন আরো বৃদ্ধি পায় ২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগাল অংশ নেয়ার পর। প্রথম ম্যাচেই ৯৮ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারানো সেনেগাল আলোড়ন ফেলে দেয়। মানে বাবা-মার কাছে আবদার করে, ডাকারে তার চাচার কাছে গিয়ে ফুটবল শেখানোর জন্য। প্রথম রাজি না হলেও, পরে মানেকে অনুমতি দেন। এবার নিজেকে প্রস্তুত করার পালা।
তার চাচাই প্রথম তাকে স্থানীয় একটা ক্লাবে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা সারাজীবন মনে রেখেছেন মানে। তাঁর মুখ থেকেই শুনে নেওয়া যাক সেই অভিজ্ঞতার কথা, সাদিও বলেন প্রথমেই একজন বৃদ্ধ মানুষ এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী এখানে পরীক্ষা দিতে এসেছ? সাদিও মাথা নেড়ে জানান দিলেন হ্যা। সাদিওর কথা শুনে বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, এই ছেঁড়া বুট নিয়ে?
সাদিও বললেন সত্যি আমার বুটটা খুব পুরনো ছিল। ছেঁড়াও ছিল অনেকটা। তারপর আমার শর্টস দেখে বললেন এই শর্টস পরে তুমি খেলবে? তোমার কি একটা শর্টস কেনারও ক্ষমতা নেই? সাদিও কথাগুলো নেটে ভেষে ভেড়াচ্ছে, এক অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে। সাদিও বললো, আমি আমার চোখের জল আটকে রাখতে পারেনি। সাদিও মানে ধরেই নিয়েছিল আজই হয়ত তার ফুটবল খেলার শেষ দিন। কিন্তু প্রতিভার কোনদিন পরাজয় হয়না। সাদিও নিজের প্রতিভার সাহায্যে সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেন। ওই বৃদ্ধ সাদিও মানের খেলা দেখে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর দলে। মাত্র দু'টা মৌসুমে ১৩১ গোল করেছিলেন মানে। তখনই হঠাৎই তাঁর ভাগ্য ঘুরে যায়। ফ্রান্স থেকে কিছু স্কাউট এসেছিলেন সেনেগাল থেকে গরিব এবং প্রতিভাবান ফুটবলার তুলে আনতে। মানের দক্ষতা দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে যান।
তারা সবাইকে পরীক্ষা করেই দেখলেন মানেই সব থেকে প্রতিভাবান ফুটবলার। ফ্রান্সের ক্লাব মেৎজে তাঁকে খেলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কোনকিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যান মানে এদিকে আবার একটা ভয় তার আব্বা আম্মা তো রাজী হবেনা।
কি করা যায় ভাবতে ভাবতে বাবা–মাকে না জানিয়েই যোগ দেন মেৎযে ক্লাব এ। শুরু হল ১৫ বছরে মেৎজে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ মানের। মেৎজে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেন মানে। ২০১২ অলিম্পিকে দারুণ খেলার পর তাঁকে কিনে নেয় অস্ট্রিয়ার ক্লাব রেডবুল সালজবুর্গ।শুরু হল জীবনের মোড় ঘুরার অধ্যায়। এরপর ধাপে ধাপে এগোতে থাকে মানের ফুটবল ক্যারিয়ার। এবার যাত্রা শুরু ইংল্যান্ডে। কারও হাত ছাড়া তো সম্ভবনা হাত বাড়ালেন সাউদাম্পটন। সাউথহ্যাম্পটন নিয়ে একটু বলি সাউথহ্যাম্পটন হল একটি ইংলিশ ফুটবল দল। এর ডাকনাম হল দ্যা সেইন্টস যা সাউথহ্যানপ্টন শহরের নাম থেকে এসেছে। একটি ব্যতিক্রমী জায়গা যা থেকে মানুষ অসাধারণ কিছু অর্জন করে।
অনেকখানি পড়লেন একটু ব্রেক নিতে পারেন চাইলে। আরও চমক সামনে অপেক্ষা করছে।
মনে আছে ২০১৪–এর ডিসেম্বরে মাত্র ২ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডে হ্যাটট্রিক সম্পূর্ণ করেন, যা আজও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে রেকর্ড। যার রেকর্ড ইউটিউবে মানের হ্যাটট্রিক লেখলেই দেখতে পারবেন। আর নিচে লিংকটা দিয়ে দিয়েছি।
এতে তাঁর গোল করার দক্ষতা চোখে পড়ে লিভারপুল কোচ ইয়ার্গুন ক্লপের। এবার মানের যাত্রা লিভারপুলে। যেখানে তখন খেলেন মোহাম্মদ সালাহ, রবার্তো ফিরমিনো, মত প্লেয়াররা।কিন্তু মানে আর সালাহ এর একক দক্ষতাতেই লিভারপুল ফাইনালে ওঠে। ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধেও গোল রয়েছে তাঁর। প্রথম সেনেগালীয় হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি।
এবার আসুন একটু অতীতে ফিরে যাই, কী পড়তে বিরক্ত লাগছে? মনে আছে ২০০২-এ সেনেগালের চমকএ হেরেছিল তখনকার চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স!।সাদিও মানের তখন বয়স কত হবে ১০/১১ বছরের বালক। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন এল হাজি দিউফ, পাপা দিউপদের খেলা ,আর মনের অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছেন নিজের ফুটবলার হবার স্বপ্নে। দেখুন জীবন কেমন বিচিত্র? আজকের দিনে এই দিউফ এখন লিভারপুলের বর্তমান তারকা সাদিও মানের জন্য গলা ফাটাচ্ছেন। ১৬ বছর পর বিশ্বকাপে ফেরা সেনেগালেরও যে মূল ভরসাও কিন্তু মানে।এটা কিন্তু দিউফ মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।
দিউফের আশা এই বিশ্বকাপ দিয়ে বিশ্বসেরা ফুটবলারেরও মুকুট জিতে নেবেন মানে,দিউফের ভাষ্যমতে সাদিও মানে এই আসরের অন্যতম সেরা হয়ে ব্যালন ডি’অরও জিতে আনবেন, ভালবাসা বলে কথা।সাদিও যিনি গত কয়েক মৌসুম ধরে ইউরোপের ক্লাবএ যে অসধারণ ফুটবল পারফর্মেন্স দেখিয়ে আসছেন তাতে আশার পরিধিটা আকাশ ছোঁয়া হতেই পারে ।সাদিও মানেকে লায়ন্স অফ তেরাঙ্গা’ বা ডাকারের সিংহ নামে ডাকতে শুরু করে দিয়েছেন অনেক আগেই সেনেগালের প্রতিটি মানুষ। এক শব্দে সাদিও মানে এই মুহূর্তে আফ্রিকার অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এতে কোন সন্দেহ নেই।
এবার আসুন একটু পুরনো কাসুন্দি ঘাটি। মানে সর্বশেষ মৌসুমে লিভারপুলের হয়ে করেছেন গোল করেছেন ২০ টি। চ্যাম্পিয়ন্স লীগেও ১০গোল করে যৌথভাবে ছিলেন দ্বিতীয় সেরা গোলদাতা। ২০১৪ সালে সাউথহ্যাম্পটনের হয়ে মাতিয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ । ২০১৫ সালে তার করা সেই দ্রুত সময়ের গোল ইংলিশ ফুটবলে দ্রুততম সময়ে করা হ্যাট্রিকের রেকর্ড। রাশিয়া বিশ্বকাপে সেনেগালের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করবে সাদিও মানের উপর। ইংল্যান্ড এর জায়ান্ট ক্লাব লিভারপুলের হয়ে সর্বশেষ মৌসুমে সবার নজর কেড়েছেন এই ডাকারের সিংহ ভয়ংকর এক নাম । সেনেগাল জাতীয় দলের খেলেছেন মাত্র ২২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।কিন্তু নিজের একক পারফরমেন্সে দেখিয়েছেন সাদিও কি জিনীস!
একটি অবাক করা তথ্য ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে সাউথহ্যাম্পটনে খেলা সেনেগালের কোন ফুটবলার হিসেবে সাদিও মানেই এবারই প্রথম এই পুরুস্কারের জন্য মনোনয়ন পেলেন। আফ্রিকান ফুটবলার অফ দা ইয়ার -২০১৬ সাদিও মানের জন্য এ এক বিরাট পাওয়া যা ফুটবল ইতিহাসের পাতায় ইতোমধ্যে লেখা হয়ে গেছে।
ভাইয়া/আপু লেখাটা পড়তে ক্লান্ত লাগছে? এক কাপ গরম কফি নিয়ে আসুন, এক চুমুক দেন আর লেখাটা শেষ করে মন্তব্য জানিয়ে যাবেন ক্যামন?
অর্থাভাবে সাদিও মানে পড়াশুনা করতে পারেন নি। এমন কি স্কুলের বারন্দায়ও কোনদিন যেতে পারেন নি। কিন্তু এই মানুষটা পড়াশুনার কী মুল্য তা ঠিকই বুঝেছেন।সাদিও মানের একটা কথা আমার খুব ভাল লেগেছে পড়াশুনা খুব দরকার, এই দরিদ্র থেকে উঠতে হলে পড়াশুনার কোন বিকল্প নেই। নিজের গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য নিজের গ্রামে স্কুল প্রতিষ্টা করার জন্য ২০০,০০০ ইউরো দান করেছেন। কিন্তু তার আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়ালের বিরুদ্ধে লিভারপুলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। নিজ গ্রামের দরিদ্র মানুষরা যাতে লিভারপুল জার্সি পরে তাকে সমর্থন যোগাতে পারে এজন্য লিভারপুলের ৩০০ জার্সি উপহারও পাঠিয়েছেন সাদিও মানে।
১৬টি বছর পরে নিজেই দেশকে একাই তুলেছেন বিশ্বকাপে। আশা করি বিশ্ব ফুটবল ভক্ত কিছু একটা পাবে। আমরাও সেই প্রত্যাশায় আছি। বিশ্বকাপের পরেই আবার নিজ গ্রাম বামবালিতে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন মানে। তবে ফাইনালের বিজয়ী মেডেল নিয়েই ফেরার আশা ব্যক্ত করেছেন। সাদিও মানে বলেন বিশ্বকাপের পর আবার দেশে ফিরবো। আশা করছি বিজয়ী দলের মেডেল নিয়েই ফিরতে পারবো। সাদিও মানে ইতোমধ্যেই ওমরা করে এসেছেন।
আমারাও দোয়া করি এই মানুষটার জন্য। ফুটবল যার প্রেম,ফুটবল যার ধ্যান জ্ঞান এবং যে মানুষটা আজ দেড় কোটি মানুষের আশা আর অনুপ্রেরণার এক গল্পের শিরোনাম। সেই মানুষটাই সেনেগালের আজকের সত্যিকারের লায়ন্স অফ তেরাঙ্গা!
সবাই ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ,
---ম নি র মো হা ম্ম দ
তথ্য সূত্রঃ 1.https://playerswiki.com/sadio-mane
2.https://en.wikipedia.org/wiki/Sadio_Man%C3%A9
3.http://celebrityunfold.com/sadio-mane/
4.https://www.independent.co.uk/…/liverpool-fc-news-sadio-man…
5.https://www.thesun.co.uk/…/liverpool-sadio-mane-donates-mo…/
6.https://www.charitystars.com/…/family-day-out-with-sadio-ma…
7.https://www.foottheball.com/…/sadio-mane-secret-life…/195494
8.https://www.youtube.com/watch?v=BXOZ8UXlap4
9.https://www.theguardian.com/football/2018/may/24/sadio-mane-senegal-liverpool-champions-league-final-300-shirts
10.https://www.thefamouspeople.com/profiles/sadio-man-36075.php
pic: Goal.com
- 0 মন্তব্য