• ফুটবল

থমাস মুনিয়ের: পোস্টম্যান থেকে ফুটবলার (প্রথম পর্ব)

পোস্টটি ৩০১৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

একজন পোস্টম্যান আপনার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পরিশ্রমী।প্রকৃতপক্ষে, পরেরবার একজন পোস্টম্যান আপনার বাড়ির কাছে চিঠি নিয়ে আসলে আপনার দরজা খুলতে হবে এবং তাকে একটি হাসি দিতে হবে।হয়তো তাকে এক কাপ চা খাওয়ার প্রস্তাব দিবেন বা অন্য কিছু।কারণ, সে অবশ্যই একটি কঠিন দিন অতিক্রম করেছে।

সবাই সম্ভবত চিন্তা করছেন, কেন এই ফুটবলার আমাকে আমার পোস্টম্যান সম্পর্কে বলছে?সে কী বুঝাইতে চাইছে? বিশ্বাস করেন বা না করেন, বেলজিয়ান জাতীয় দলে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার আগে এটাই আমার কাজ ছিল।আমি 'ফুটবলার থমাস মুনিয়ের' ছিলাম না—আমি 'পোস্টম্যান থমাস মুনিয়ের' ছিলাম।

যখন আমি ১৮ বছর বয়সী এবং ফুটবলে বাঁচতে লড়াই করছি, তখন আমি ডাক সার্ভিসের চাকরি নিয়েছিলাম।আমি ভোর পাঁচটায় জেগে উঠতাম এবং সূর্য উপরে আসার আগেই যাত্রা শুরু করতাম। আপনি যদি লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের পোস্টম্যান হন, আমি মনে করি যে এটি সম্ভবত মোটামুটি মজার;কারণ, সেখানে সমস্ত অ্যাপার্টমেন্টগুলো একে অপরের কাছাকাছি।তাই আপনি শুধু আপনার বড় ব্যাগের চিঠি সঙ্গে নিয়ে হেঁটে যেতে পারেন, একটি চমৎকার ভ্রমণের মত।

তবে, আমি বেলজিয়ামের একটি ছোট্ট গ্রামে কাজ করেছি যেখানে ঘরগুলো সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।আমাকে বলুন, যখন ভারী বৃষ্টি বর্ষণ হবে এবং আপনাকে গাড়ি পার্ক করে প্রথমে ৫০ মিটার হেঁটে ডাকপোস্টে যেতে হবে এবং চিঠিগুলো বিলি করতে হবে—আপনি কি গুরুতরভাবে ক্লান্ত হবেন না?এবং আপনাকে এটি প্রতি ১০ মিটার অন্তর-অন্তর করতে হবে!

আপনি গাড়ি থামালেন।বের হয়ে আসলেন।চিঠির ব্যাগটি নিয়ে হাঁটলেন।চিঠি দিয়ে গাড়িতে ফিরে আসলেন।পরবর্তী ঘর পর্যন্ত ড্রাইভ করলেন।আবার এমন শুরু করলেন এবং প্রতি ১০ মিটার পর পর করতে থাকলেন।ভাবতে পারছেন?

যখন আমি বাড়িতে আসতাম, তখন আমি এত ক্লান্ত হয়ে পড়তাম যে সারা বিকেলবেলা ঘুমিয়ে কাটাতাম।আমি দুই মাসের জন্য কাজটি করি এবং এরপর 'সেইন্ট-গোবেন অটোওভার' নামক একটি বড় কারখানায় অটোমোবাইলের অংশ একত্রিকরণের কাজ নিই। এটি বেশিদিন আগের নয়।২০১০ সালে এমন ছিল।অথচ এখন আট বছর পরে, আমি বিশ্বকাপে আমার দেশের জন্য খেলতে প্রস্তুতি নিচ্ছি।

আপনার এটি হলিউড থেকে সংগ্রহ করা মনে হতে পারে।আপনি এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে ভেবে আশ্চর্য হতে পারেন।কখনও কখনও আমি নিজেও আশ্চর্য হয়।আমার কর্মজীবন এত অদ্ভুত যে, এমনকি এখন, আমি এটা বিশ্বাস করতে চেষ্টা করছি।তাই আমি গল্পটি ঘুচিয়ে বলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

বেশিরভাগ ফুটবলারদের গল্পের মত, আমার যাত্রাও বাবার সাথে শুরু, যিনি অপেশাদার ফুটবলার হিসেবে কিছু সময় খেলেছিলেন এবং তিনি ঐকান্তিক ছিলেন।আমি মনে করি, তিনি আমাকে একটি পেশাদার ফুটবলার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি ফুটবলের সব স্বপ্ন নিজে দিয়ে পূরণ পারেনি।

প্রতি রবিবার আমরা তাঁর খেলা দেখতে চাইতাম—আমি, আমার বড় বোন এবং আমার মা।আমার পুরো পরিবার ফুটবল পছন্দ করত, এমনকি আমার দাদা-দাদিও।আমাদের গ্রামে সবকিছুই করা যেত, আপনি জানেন?এটাকে সেইন্ট-অডে বলা হয;এবং এখানে শুধু ২ হাজারের মত মানুষের বসবাস আছে।স্কুলে যাওয়া যেত, ফুটবল খেলা যেত এবং জিমন্যাস্টিকস করা যেত।এখানে অনেক কিছু ছিল।আমি মজার জন্য ফুটবল খেলতাম, কিন্তু আমার বাবার অনেক দাবি ছিল।তিনি সবসময় আমার সাথে ট্রেনিংয়ে যেতেন এবং আমাকে আরো ভালো করার জন্য জোর দিতেন।যদি আমি যেতে না চাইতাম, তাহলে তিনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতেন।

তারপর একদিন, যখন আমার বয়স ১২ বছর, আমার জীবনে পরিবর্তন নেমে আসে।আমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যায়। আমি মনে করি, এটি ভালোই ছিল।আমার বাবা খুব মৃদু মানুষ ছিলেন না।আমাদের বাড়িতে উনার রাগ জিনিস একটু বেশিই তীব্র ছিল। আমার বোন এবং আমি আমার মায়ের সাথে থাকতে গিয়েছিলাম, এবং তাঁর জন্য এটি খুব কঠিন ছিল।তিনি সবকিছু করেছেন যাতে আমাদের জন্য ফ্রিজে কিছু (খাবার) থাকে।তিনি ভোর ৬ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত নার্স হিসেবে কাজ করতেন, এরপর বাড়িঘর পরিষ্কার করতেন বাড়তি কিছু টাকার জন্য।রাত ৯ টার দিকে তিনি বাড়িতে ফিরতেন এবং আবার একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্য চলে যেতেন।সে-সময় আমার দাদা-দাদি আমাদের সাথে থাকত।ধন্যবাদ মাকে;আমাদের এসব প্রয়োজন ছিল।

এক বছর পর, যখন আমি ১৩ বছর বয়সী ছিলাম, তখন আমি বেলজিয়ামের স্ট্যান্ডার্ড লীগের একটি বড় ক্লাবের অ্যাকাডেমিতে একটি স্থান অর্জন করি।একমাত্র সমস্যা ছিল, এটা আমাদের গ্রাম থেকে দূরে;তাই, বাধ্য হয়ে অ্যাকাডেমির কাছাকাছি একটি বোর্ডিং স্কুলে যেতে হয়েছিল।প্রথমে, আমি এমনকি যেতে পর্যন্ত চাইনি।আমি ভাবতাম, আমি খুব বেশি বাড়িকে মিস করব।কিন্তু, এটি একটি বড় সুযোগ ছিল, এবং তারপর আমি একবারই সেটি পেয়েছিলাম;আমি সেখানে বন্ধু পেয়েছিলাম এবং এটি একটি বড় অভিজ্ঞতা ছিল।এটি এমন একটি সময় ছিল, যা আমি কখনও ভুলব না।আমি সেখানে দুই বছর কাটিয়েছি, এবং আমি ভাবতাম যে সম্ভবত আমি বেলজিয়ামে প্রথম বিভাগের ফুটবল খেলার পথেই আছি।

তারপর একদিন, আমার বয়স যখন ১৫ বছর, আমার তখনকার কোচ আমাকে এবং আমার মাকে তাঁর অফিসে ডেকেছিলেন।আমি জানি না এটা কী ছিল।আমার কোন ধারণাই ছিল না! আমরা বসলাম এবং তিনি যা বলেছিলেন, "আমরা থমাসকে ছেড়ে দিচ্ছি।" আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে।আপনারা কি বুঝতে পারছেন?

আমার মনে পড়ে, আমি আর মা একে অপরের দিকে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়েছিলাম।তারপর আমরা কোচের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছিলাম, "ও আচ্ছা, ঠিকাছে।এখানেই শেষ তাহলে?"

আপনাদের হয়তো এটি শুনে মজা লাগতে পারে যে, এ ঘটানা আমার জন্য বিপর্যয় ছিল না।কারণ, ফুটবল আমার জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল এমন না।তাই, আমি ভাবতাম, "এটাই শেষ।আমি এখন নিয়মিত স্কুলে যাবো।স্বাভাবিক কাজগুলো করব, সিনেমা দেখতে যাবো।জীবনকে উপভোগ করব।"

এবং তাই আমি আমার বাবা-মাকে বলেছিলাম যে, ভালোই হয়েছে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।আমার আর আবেগ নেই।আমার স্বপ্ন মারা গেছে। আপনারা কল্পনা করতে পারছেন, আমার বাবা কেমন অনুভব করেছিলেন!আমরা ফুটবল সম্পর্কে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।এখানে একটা সমস্যা ছিল, কারণ ফুটবল ছিল আমাদের জীবন।তিনি খুব হতাশ হয়েছিলেন।তিনি আমার মাধ্যমে ফুটবলের জন্য তাঁর আবেগ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।তাই, আমার স্বপ্ন ধ্বংস হওয়ার সাথে তাঁরটাও ধ্বংস হয়ে গেছে।

আমি আশা করেছিলাম আমার মা আমাকে বুঝতে চেষ্টা করবে।কিন্তু না, তিনি আমার সিদ্ধান্তের সাথে মতবিরোধ করেন। "না, না, না," তিনি বলেন, "ফুটবল তোমার জীবন।তোমাকে খেলতেই হবে।" তাই, তিনি ভিরটন নামে খুব ছোট্ট একটি ক্লাব থেকে একজন কোচকে ডেকে এনে বলেছিলেন, "হ্যাঁ, আমার ছেলে স্ট্যান্ডার্ড লীগে ছিল;দুর্ভাগ্যবশত, তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।সে কি নিজেকে প্রমাণের জন্য আপনার ক্লাবে যেতে পারে?আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সে খুব ভালো।"

আমি মনে করি যে, তিনি আমার মধ্যে এমন কিছু দেখেছেন যা আমি ছিলাম না।হয়তো এটাই কারণ ছিল যে, আমি ফুটবল খেলতে পেরেছি বলেই আমি বুঝতে পারিনি এটি আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।আমি বলতে চাচ্ছি, প্রতি রবিবার, যখন আমরা আমার বাবার খেলা দেখতে যেতাম, তখন আমি প্রায় একটি বলে কিক মারতাম।আমি এমনকি এটি সম্পর্কে ভাবতাম না, কারণ এটি আমার জন্য এত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

কিন্তু মা সেখানে কিছু খুঁজে নিয়েছিল।আমার মা আমাকে সবার চেয়ে ভাল জানেন। আমি ভিরটনের যুব দলের সঙ্গে একটি ট্রায়াল ম্যাচ খেলেছিলাম।আমরা ১৫-৩ গোলে জিতেছিলাম এবং আমি একাই ১০টি গোল করেছিলাম।খেলাটির পরে কোচ আমার কাছে এসে বলেছিল, "কত নম্বর জার্সি তুমি চাও?" অবশ্য, এটি সে-সময়ে একটি জীবন পরিবর্তনের মত মনে হয়নি।কারণ, ভিরটন তৃতীয় বিভাগের দল ছিল, এবং তাদের সিনিয়র দিকের খেলোড়ায়দের মাসিক বেতন ছিল ৪০০ ইউরো।অন্যকিছু বাদ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাস করার জন্যও এটি যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু যদি আমার মা ফোন কলটি না করে কোচকে আমার খেলা না দেখাত…

আমি এমনকি ভাবতেও পারছি না, আমি তখন কী করতাম।আমার জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যেতে পারত।

['দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউন' থেকে অনূদিত]

(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)