JUST KICK IT OUT!
পোস্টটি ৩৩৯৫ বার পঠিত হয়েছেমারিও বালোতেল্লির জন্ম ইটালীতে। ঘানাইয়ান বংশোদ্ভুত বাবা মা এর ঘরে জন্ম নিলেও বেড়ে উঠেছেন ব্রেসিয়ার সিলভিয়া আর ফ্রান্সেসকোর ঘরে। এই দুই পালক পিতামাতাকে বাবা মায়ের আসন দিয়েছেন তিনি। জাতীয় দল হিসাবে ইতালীকে কেন বেছে নিয়েছেন এই প্রশ্নের উত্তরে বালোতেল্লি বলেছিলেন “আমি ইতালিয়ান, আমি নিজেকে ইতালিয়ান হিসাবে অনুভব করি এবং অবশ্যই চিরকাল এই দেশের জাতীয় দলের হয়েই খেলতে চাই”।বালোতেল্লি ইতালী জাতীয় দলের হয়ে ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন। ১৪ গোল করেছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে বালোতেল্লি নিজ মাতৃভূমি ইটালীতে শিকার হন ঘোর বর্ণবাদ এর। গায়ের কালো রঙ এর জন্য তাঁর দিকে কলা ছুড়ে মারা হয়। ইতালীতে বর্ণবাদ এর শেষ এখানেই নয়। ঘানাইয়ান বংশোদ্ভুত কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং ও মূলত সমর্থকদের বর্ণবাদী আচরণ এ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েই ইতালী ছাড়তে বাধ্য হন।তিনি চলে যান জার্মানীতে।
গায়ের রঙ হিসাব করে কারো জাতিগোষ্ঠিকে ছোট করে দেখা, পূর্বপুরুষের দাসত্বকে ইঙ্গিত করে গালি দেয়া বা কৃষ্ণ বর্নের কারণে বানর জাতীয় প্রানীর সাথে ফুটবলারদের তুলনা করার বিষয় গুলো ইউরোপে চোখ বুজে সবাই অস্বীকার করলেও একটি কুৎসিত সত্যের মত বাস্তব। প্রফেশনাল ফুটবলাররা বিনোদন দাতা। প্রতি সপ্তাহে টিভিতে বা স্টেডিয়ামে তাঁদের খেলা দেখা আমাদের রাতের পর রাত জাগায়, আবেগে ভাসায়। তাঁদের সাফল্যে আমরা বাধভাঙ্গা আবেগে উল্লসিত হই, ব্যার্থতাকে নিজেদের ব্যার্থতা হিসাবে নিয়ে আমাদের মন ভেঙ্গে যায়। আমাদের এই আবেগ এর উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ইউরোপিয়ান ফুটবলের কাঠামো। ফুটবল একটি খেলা, একটি ব্যাবসা, একটি জীবিকা এবং অবশ্যই একটি শহর, একটি দেশ এর পরিধি ছাড়িয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ফুটবলাররা সেই সব কিছুর বাহন। কিন্তু সব কিছুর উপরে তারা প্রত্যেকে মানুষ। শুধু মানুষ নন, কোন না কোন শহরের বা দেশের মানুষের জন্য তারা নায়ক। কিংবদন্তী এবং অবশ্যই জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা প্রত্যেক ফুটবলার ওই দেশের মিলিয়ন মিলিয়ন শিশু-কিশোরের আইকন।ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে তা সত্য।
আর বিশ্বকাপ জয়ী কোন ফুটবলার? তিনি দেশের ফুটবল ইতিহাসের স্বর্নালী অধ্যায়ের অংশ। যুগের পর যুগ ধরে দেশের তরুণ সমাজের জন্য আদর্শ। প্রফেশনাল ফুটবলারদের জাকজমকের জীবন অনেক সময় প্রশ্ন তুলে দেয়, তারা সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন কী না। সাথে দুইদিন আগের একটি ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে- এই জাতীয় বীরদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সফল জাতিগুলোও আদতেই দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা সন্তান হিসাবে কতটা মূল্যায়ন করে? জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল মাত্র ২৯ বছর বয়সে জাতীয় ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন। দুই সাড়ে চার পাতার প্রেস রিলিজে তিনি বলেছেন, যে গর্ব নিয়ে তিনি জার্মানি জাতীয় দলের জার্সি ধারণ করতেন বিগত কয়েকদিনের ঘটনায় তিনি তা আর অনুভব করতে পারেন না। জার্মানির জার্সি ধারণ করতে এখন রুচিতে যথেষ্ট বাধে তাঁর।
ওজিলের দোষ? তিনি তুর্কিস্তানের রাস্ট্রপ্রধান এরদোগান এর সাথে ছবি তুলেছিলেন। ওজিল একা নন, তাঁর সাথে ছবি তুলেছিলেন ইকায় গুন্দোগান এবং স্যামি খেদিরাও। এরা তিনজনই ২০১৪ সালে জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী দলের অংশ। এবং আরেকটি সাধারণ পরিচয় এরা প্রত্যেকে তুর্কি বংশোদ্ভুত জার্মান। ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম। এই ছবির জের ধরে জার্মান মিডিয়া দাত নখ বের করে ঝাপিয়ে পড়ে তাঁদের উপর। তুর্কি বংশোদ্ভুত পরিচয়টা তাঁদের জার্মান পরিচয়টাকে গ্রাস করে ফেলছে, ওজিল-গুন্দোগান নিজেদের কতটা জার্মান মনে করেন এই ধরনের রিপোর্টে ছেয়ে যায় জার্মান পত্রপত্রিকার পাতা। এ অবস্থায় ওজিল পেতে পারতেন জার্মান ফুটবল বোর্ড এর সমর্থন। কোচ হোয়াকিম লো ও জাতীয় দলের লিয়াজো অলিভিয়ের বিয়েরহফ তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন ও। কিন্তু বাধ সাধেন জার্মান ফুটবল প্রধান রেইনার্দ গ্রিন্দেল। চরম আক্রমনাত্নক ভাবে তিনি শুধুমাত্র ছবি তোলার জন্য জনসমক্ষে মাফ চাইতে বলেন তিন ফুটবলারকে এবং বিভিন্নভাবে চরমপন্থী জার্মান রাজনৈতিক মতবাদ এর দোহাই চাপিয়ে দিতে চাপ দিতে থাকেন “অভিবাসী” হিসাবে পরিচিত হতে থাকা তিন ফুটবলারকে। এমনকি জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইন্মার এর সাথে বৈঠকেও ওজিলকে তিনি ব্যাক্তিগতভাবে দোষারোপ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর সাথে ছবি তোলার ব্যাপারে। বিশ্বকাপের আগেই এসব নিয়ে টালমাটাল অবস্থায় ওজিলকে জাতীয় দলের কোচিং স্টাফ পরামর্শ দেন ফুটবলে মনোযোগ দেয়ার। কিন্তু বিশ্বকাপে দলের হতাশাজনক পারফরমেন্স আগুনে ঘি ঢালে। দায় এড়াতে ওজিলের ছবির ইস্যু আবার সামনে নিয়ে আসা হয় গ্রিন্দেল এর নেতৃত্বে। এর সাথে যোগ দেন জার্মানির সবচেয়ে বড় ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের সভাপতি উলি হোয়েনেস। ওজিলের দিকে নগ্ন সমালোচনা করে তিনি প্রশ্ন তোলেন তাঁর ফুটবল সামর্থ্য এবং সামাজিক মাধ্যম এর অনুসারীদের নিয়েও। অন্য আরেকটি ক্লাবের ফুটবলার এর উপর এ ধরনের নগ্ন আক্রমণ পেশাদারিত্বের খোলসে মোড়ানো বায়ার্ন মিউনিখ তো বটেই, শেষ কবে ইউরোপের ফুটবল মানচিত্রে দেখা গেছে তা নিয়েও শুরু হয়েছে গুঞ্জন। সমালোচনা। গুন্দোগান সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করলেও ওজিল একদমই রাজি হন নি।
জার্মান ফুটবল দলের emblem এর উপরে জ্বলজ্বল করে চারটি তারা। জাতি হিসাবে হিসাবী আর যান্ত্রিক জার্মানদের জন্য এই চারটি তারা বড্ড গৌরব এর। চারবারের বিশ্বসেরা হবার স্বীকৃতি এই চারটি তারা। ওজিল তাঁর ব্যাক্তিগত বার্তায় অত্যন্ত আক্ষেপ এর সাথে বলেছেন- যেদিন আমি জার্মানির জার্সি গায়ে বিশ্বকাপ জিতি সেদিন আমি জার্মান। অথচ যেদিন আমাকে নিয়ে কোন বিতর্ক ওঠে সেদিন আমি হয়ে যাই তুর্কি অভিবাসী। অল্প কিছুদিন আগে বিশ্বকাপ জিতেছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের দলে ২৩ জনের ১৮ জনের আদিপুরুষের শিকড় পোতা আফ্রিকার মাটিতে। সারা বিশ্বের অনলাইন-অফলাইন গণমাধ্যম এই গাত্রবর্ণ বা অরিজিন এর দিকে আঙ্গুল তুলতে ভুল করেনি। আমেরিকায় ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রদূতলে চিঠি দিতে হয়েছে মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের এই বার্তা দিয়ে যেন ফ্রেঞ্চ ফুটবলারদের কোনভাবেই আফ্রিকান বলা না হয়। এই ডামাডোলের মধ্যে আরেকটি ঘটনা সামনে চলে এসেছে। কিছুদিন আগে আগুনে পড়া একটি ভবন থেকে এক শিশুকে উদ্ধার করা এক আফ্রিকান অভিবাসীকে সম্মানজনকভাবে ফ্রান্স এর নাগরিকত্ব দেয়া হয়। প্রশ্ন তুলে দেয়া হয়- যদি বাচ্চাটি হাত থেকে পড়ে যেত, মানবতা কী হেরে যেত ভৌগলিক সীমার কাছে?
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, বর্ণবাদ এর হাত থেকে বাচতে ইতালী থেকে জার্মানিতে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছিলেন কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং। জার্মানিতে হয়তো গাত্রবর্নের হিসাবে বর্ণবাদ নেই, হয়তো জার্মানি মুক্ত আফ্রিকানদের বা পোলিশদের দিকে আংগুল তোলা থেকে। কিন্তু বর্ণবাদ থেকে? নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলের সদস্যরাও যেখানে নিজেদের রক্ষাকর্তা ও অভিভাবকদের কাছ থেকে বর্ণবাদী আচরণ পাচ্ছেন, তখন প্রশ্নের উত্তর শুধুই অস্বস্তিকর নীরবতা।
ওজিল তাঁর বার্তায় আরো বলেছেন- মিরোস্লাভ ক্লোসা বা লুকাস পোডলস্কিকে কেউ কোনদিন পোলিশ জার্মান বলে ডাকে নি। অথচ মুসলিম বলে বা তুর্কি বংশোদ্ভুত বলে তাঁর দিকে আংগুল তোলা হচ্ছে আজ। বিশ্বকাপ ব্যার্থতার বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। হোয়েনেস বা গ্রিন্দেল এর মত লোক যখন দেশের ক্লাব ও জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেবার সর্বময় ক্ষমতার জায়গায় বসে আছেন তখন আন্দাজ করা কঠিন নয় যে সাধারণ মানুষের মধ্যেও তুর্কি, মুসলমান বা অভিবাসীদের নিয়ে ভীতিটা প্রবল। ফ্রান্সে কিছুদিন আগে হিজাব এর উপরে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, আমেরিকাতে ইসলামফোবিয়া তৈরি হচ্ছে। জিতে যাচ্ছে বর্ণবাদ। জিতে যাচ্ছে শ্রেনীবিভেদ। হেরে যাচ্ছে ফুটবল হেরে যাচ্ছে মানবতা।
২০১০ বিশ্বকাপে Professional football association এর অঙ্গসংগঠন Kick it out এর একটি ব্যানার আলাদা ভাবে নজর কেড়েছিল। সেখানে লিখা ছিল KICK IT OUT ফুটবল থেকে বর্ণবাদ আর বৈষম্যকে লাথি মেরে দূর করে দেবার প্রত্যয় ছিল সেই ব্যানার গুলোতে। আজ ২০১০ বিশ্বকাপের ৮ বছর পরও শুধু আশা নিয়ে বাঁচতে হয় কোন একদিন সত্যি সত্যিই ফুটবল থেকে বর্ণবাদ উঠে যাবে। ড্যানি আলভেস এর শেষ বার্সেলোনা সিজনে গ্যালারী থেকে তাঁর দিকে কলা ছুড়ে মারা হয়েছিল। সেটি তিনি জায়গায়তেই ছিলে খেয়ে খেলেছিলেন এবং বলেছিলেন তাঁর শক্তির দরকার ছিল। এটি তাকে সাহায্য করেছিল তাকে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাড়াতে এখন সমগ্র ফুটবল বিশ্বের ই শক্তি দরকার। বেঁচে থাকুক ফুটবল। বিলুপ্ত হোক বর্ণবাদ।
- 0 মন্তব্য