• ক্রিকেট

মাশরাফি একজন বীরের নাম

পোস্টটি ১৫২৩৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

_20180815_102459মাশরাফি একজন বীরের নাম।

ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির ১৬বছরে দুই হাঁটু মিলিয়ে ৭বার অপারেশন, দুই অ্যাংকেল মিলিয়ে ১০বার ডাক্তারের ছুরির নিচে নিজেকে সপে দিয়েছেন। প্রতি ম্যাচ শেষে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে বের করতে হয় হাঁটুতে জমা বিষাক্ত রষ। ঘুম থেকে উঠে সাথে সাথে নামতে পারেন না বিছানা থেকে। হাঁটু দুটি কয়েকবার ভাঁজ ও সোজা করতে হয়। তারপরেই শুরু হয় দিন। ডাক্তাররা বলেছেন এভাবে ক্রিকেট চালিয়ে গেলে এক সময়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবেন। কিন্তু দমে যাননি, সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নেমে পড়েন বল হাতে। বাঘের মতো ছটে চলা। এ যেন এক অপ্রতিরোধ্য বীর সেনার গল্প। যার জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সাহসিকতা, দেশপ্রেম আর অদম্য এক যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি। শত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে লাল সবুজ পতাকার সম্মান, হাসি-কান্নার ভার যার কাঁধে, ম্যাচ হারলে যিনি কাঁদেন নিরব সবার আড়ালে। যাতে তরুন ক্রিকেটাররা হতাশ না হয়। নবীন ক্রিকেটারদের বুকের মধ্যে আগলে রাখেন ভালোবাসা দিয়ে বটবৃক্ষের মতো। কখনও কপালে চুমু দেন, ভালোবেসে মাথার চুল এলোমেলো করে দেন। ভক্তগোষ্ঠী মাঠে ঢুকে পড়লেও বুকে আশ্রয় দেন পরম মমতায়। বলছি পাগলাটে কৌশিকের কথা। না, ঠিকই বলছি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তী, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো টাইগার ক্রিকেটের সোনালী দিনের বংশীবাদক এবং লড়াকু সর্বকালের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়েও যিনি বল করে যান। দলকে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। নিজের কষ্ট, ব্যথা নিজের মধ্যে রেখে লড়ে যান দেশের জন্য ক্রিকেট যুদ্ধে। বলছি এমন এক নায়কের কথা। না, নায়ক বললে বিরাট ভুল হবে। এমন মানুষের নামের আগে ঠিক মহানায়ক মানায়। ৫ই অক্টোবর ১৯৮৩সালে নড়াইল জেলায় গোলাম মুর্তজা ও হামিদা রহমান বলার ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম বোলিং স্তম্ভ মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশ জাতীয় দল ছাড়া এশিয়া একাদশে একদিনের আন্তর্জাতিক দলে খেলেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বাকালের সেরা অধিনায়ক তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা আবিষ্কার তিনি।
টেস্টে তাঁর এক ইনিংসে ৫উইকেট নেই। ওয়াসিম,মেগ্রাদের মতো শত শত উইকেট নেই তাঁর। ব্রেট লি, শোয়েব আখতারদের মতো গতি দানব নন তিনি। তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্রিকেটের পরিসংখ্যান, স্পিড গানের হিসেব দিয়ে যাকে চেনা যাবে না। কাগজ-কলম আর বই খুলে তাকে চিনিতে পারেবন না। শুধু টেলিভিশন আর ছাপার অক্ষর যার পরিচয় দিতে পারবে না। তিনি সেই মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাশরাফি দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। ক্রিকেটার কেবল নয়; কোনো জাতির ইতিহাসে এমন মানুষই শত বর্ষের আরাধনা। মাশরাফি হলো গ্রিক ট্র্যাজেডি আর ভারতীয় রোমান্টিকতার মিশেলে এক মহাকাব্য। এমন মহাকাব্যকে ধরতে পারতেন কেবল মহাকবি হেমার কিংবা মহাঋষি বেদব্যাস।
তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটের সোনালী সময় পার করছে বাংলাদেশ। মাশরাফিই বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার, যিনি কোনো লিস্ট-এ ম্যাচ না খেলেই সরাসরি জাতীয় দলের মূল দলে জায়গা পেয়েছেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে দলকে নিয়ে গিয়েছেন কোয়ার্টার ফাইনালে। সেরা সাফল্য আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেমি-ফাইনাল। তার হাত ধরেই পাকিস্তানকে হোয়াইট ওয়াশ, ভারত, দক্ষিন আফ্রিকা, উইন্ডিজদের সাথে সিরিজ জয় করেছে। জাতীয় দলে প্রবেশ করেন টেস্ট ক্রিকেটের মাধ্যমে। ৮ই নভেম্বর, ২০০১সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হয় টেস্টে। ইনজুরির বিষাক্ত ছোবলে টেস্ট ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে পারেননি। ২০০৯ সালে উইন্ডিজ দলের বিপক্ষে ইনজুরি হয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান। ৩৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে দুটি অর্ধ-শত সহ ৭৯৭রান নেন। ৭৮টি উইকেট নেন, ক্যারিয়ার সেরা ফিগার ৬০রানে ৪উইকেট। ২৩শে নভেম্বর ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হয় ওডিআইতে। এখনো দারুণ দক্ষতার সাথে খেলে যাচ্ছেন অভিজ্ঞ এই মহা মানুষ। এই পর্যন্ত তিনি ১৭১টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ১টি অর্ধ-শত সহ ১৫৪০রান এবং ২২২উইকেট নিয়েছে। সেরা বোলিং ফিগার ২৬রানে ৬উইকেট। টি-টুয়েন্টিতেও এই জিম্বাবুয়ের সাথে ২০০৬সালের নভেম্বরে অভিষেক ঘটে। টেস্টের মতো টি-টোয়েন্টিকেও বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন এই মহা তারকা ২০১৭ সালের ৬এপ্রিল শ্রীলংকার সাথে ম্যাচ খেলে। ৫২টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ৩৬৬রান এবং ৩৯উইকেট নিয়েছেন তিনি। সেরা বোলিং ফিগার ১৯রানে ৪উইকেট। অনেকে ভালোবেসে ম্যাশ বলে ডাকেন। ক্রিকেট জীবনে সবচেয়ে বড় দুঃখ চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইনজুরির জন্য ঘরের মাঠে ২০১১সালের বিশ্বকাপ খেলতে না পারা। এছাড়া সোনায় মোড়ানো মাশরাফির ক্রিকেটীয় জীবন।

তিনি একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। মাশরাফি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ এবং প্রথম গতি দানব। সমর্থদের কাছে তিনি 'নড়াইল এক্সপ্রেস' নামে পরিচিত। বিরামহীন দেশকে ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করব দিয়ে খেলে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম নির্ভীক মানুষ তিনি।

মাশরাফির কিছু উক্তি:
* পিটাইয়া খেলবা দেখবা সব ঠাণ্ডা।
* আমি ক্রিকেটার, একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবেচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কে হাততালি দেয় না। তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করেন। যারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন তারাই তারকা।
* মুক্তিযোদ্ধারা যদি পায়ে গুলি নিয়ে যুদ্ধে করতে পারেন তাহলে আমি কেন সার্জারি নিয়ে বোলিং করতে পারেব না।
* রান না করলে মরবি না, ব্যাটিং কর। এটা জীবন না, খেলা।

ম্যাশকে নিয়ে বিখ্যাতদের কিছু উক্তি:

* আমার দুর্ভাগ্য, আমি মাশরাফির সাথে একই টিমে খেলতে পারিনি- ব্রায়ান লারা( সাবেক অধিনায়ক, উইন্ডিজ)।
* পৃথিবীতে দুই ধরণের বোলার আছে। এক ম্যাশ আর অন্যটি বাকি সব- গ্লেন ম্যাকগ্রা( কিংবদন্তী বোলার, অস্ট্রেলিয়া)।
* আমাদের সৌভাগ্য আমরা মাশরাফির যুগে জন্মেছিলাম- আমিনুল ইসলাম বুলবুল( সাবেক অধিনায়ক, বাংলাদেশ)।
* আমার সৌভাগ্য কোনোদিন মাশরাফির বল মোকাবেলা করতে হয়নি- স্যার ভিভ রিচার্সড(কিংবদন্তী, উইন্ডিজ)।
* অধিনায়ক তো অনেকেই আছেন, মা আছে কয়জন?( ম্যাশকে ইঙ্গিত করে)- অ্যাডাম গিলক্রিস্ট(উইকেট কিপার, অস্ট্রেলিয়া)।
* আপনি যদি মাশরাফির পুরো এক ওভার খেলতে পারেন তার মানে একদিন আপনি লিজেন্ড হবেন- ভিভিএস লাক্সমান(অধিনায়ক, ভারত)।
* নেতা, মানুষ আর খেলোয়াড় এই ৩টি শব্দ যোগ করলে মাসরাফির মতো কোনো ক্রিকেটার এর আগে ক্রিকেটবিশ্ব কেউ দেখেনি- নাসের হোসাইন(সাবেক অধিনায়ক, ইংল্যান্ড)।
* তুমি আমাকে একজন মাশরাফি দাও, আমি তোমাকে এগারোটা 'সোনার টুকরা'(খেলোয়াড়) উপহার দিব- শন পলক(সাবেক অধিনায়ক, দক্ষিন আফ্রিকা)।

লেখায়: আরাফাত তন্ময়(বুনোহাঁস)।
বাকিহাটি, বক্সগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা।
------০------

_20180815_101720