তামিম এবং কিছু কিংবদন্তির গল্প!
পোস্টটি ৭৭০৬ বার পঠিত হয়েছেপ্রথম ইনিংসে দলীয় ৩৪ রানের মাথায় অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ডের বলটি এসে হঠাৎ গ্রায়েম স্মিথের বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে কাতরাতে লাগলেন স্মিথ। আর মনে হয় ব্যাট করতে পারবেন না আজ। ব্যাথা আঙ্গুল নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে হাটতে হাটতে রিটায়ার্ড হয়ে ফিরে গেলেন প্যাভিলিয়নে।
৩৭৬ রানের পাহাড়সম টার্গেট বেধে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট ম্যাচে ৪র্থ ইনিংসে এই রান করা খুবই মুশকিল, তাও আবার ১০ জনের দক্ষিণ আফ্রিকা দল। বরং ড্রয়ের কথাই ভাবা যাক। একদিকে একে একে উইকেটের পতন ঘটছে প্রোটিয়াদের, অপরদিকে ড্রেসিংরুমে বসে বসে অধিনায়ক স্মিথ সেটা দেখে আফসোস করছেন নিজের জন্য। সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান ব্যাট হাতে নামতে পারছেনা! একটা সময় স্কোরবোর্ডে ২৫৭ রান জমা পড়তে না পড়তেই ৯টি উইকেট পড়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার। স্মিথ ইঞ্জুরীতে জেনে পন্টিংরা যখন বিজয়োল্লাস করতে শুরু করলেন তখন চ্যানেল নাইন ব্রডকাষ্টের ক্যামেরা চলে গেল প্রোটিয়াদের ড্রেসিংরুমে। স্মিথ ব্যাট বগলদাবা করে হাটতে আরম্ভ করছেন! সংকল্প একটাই, দলকে হার থেকে এড়াতে তাকে নামতেই হবে। অজিরা অবাক! তারা ভেবেই নিয়েছিল তারা ইতিমধ্যে জয়ী হয়ে গিয়েছে। অথচ বলের আঘাতে থেঁতলে যাওয়া আঙ্গুল নিয়ে স্মিথ নেমে পড়লে ক্রিজে। গ্যালারিতে বসে থাকা হাজার হাজার দর্শক তখন হাততালি দিচ্ছে স্মিথকে অভিবাদন জানিয়ে, "সুস্বাগতম হে বরুণ, আপনি প্রোটিয়া অধিনায়ক, আপনি এগিয়ে চলুন।"
ম্যাচটা ড্র করতে হলে ৮.২ ওভার ব্যাট করতে হবে যেখানে স্মিথের সঙ্গী মাখায়া এনটিনি। প্রথম বলটা ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ শট খেললেন সাবলীলভাবেই। এক হাতে ব্যাট কতটুকু শক্ত করে ধরে রাখা যায়? প্রথম বলটা যখন তার ব্যাটে এসে লাগল তখন দেখা গেল ব্যাটটা স্মিথের হাতের ভিতরে ৩৬০° ডিগ্রী কোনে একবার বাক খেল! এরপর খেললেন আরো ১৫ টি বল। শেষ পর্যন্ত ১১ বল বাকি থাকতে জনসনের করা ১৪৩.৭ কিঃমিঃ গতিবেগের বলটি উপড়ে ফেলল গ্রায়েম স্মিথের স্ট্যাম্প। খেললেন ১৭টি বল। ১০ বলের জন্য ম্যাচটি ড্র করা হলোনা প্রোটিয়াদের।
এক হাতে ব্যাটিংয়ে স্মিথ
ম্যাচটি হয়তো অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল, কিন্তু সেই ম্যাচে হারেনি গ্রায়েম স্মিথ। ২৬ মিনিট ক্রিজে দাড়িয়ে ১৭টি বল মোকাবেলা করেছিলেন স্মিথ। ক্রিকেটটা যে ভদ্রলোকের খেলা সেদিন সেটা আবারো দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব।
২
বাংলাদেশ দল ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছে। সময়টা ২০১০ সাল। ব্রিষ্টলে ২৩৭ রানের জবাবে ইংলিশরা ব্যাট করতে গিয়ে এক পর্যায়ে ২২৭ রানে ৯ উইকেট পড়েও গেল। ফিল্ডিং করার সময় ইয়ান বেল ইঞ্জুরীতে পড়ে যান তার একটা পায়ে ফ্রাকচারের জন্য। জিততে যখন দলের প্রয়োজন মাত্র ১০ রান, আর স্ট্রাইক প্রান্তে জোনাথন ট্রট ৯০* অপরাজিত, তখন দেশত্ববোধে উন্মত্ত হয়ে ইয়ান বেল মাঠে নেমে পড়লেন। শেষ ওভারে দরকার ১০টি রান। কিন্তু ফায়দা এল না। স্কোরবোর্ডে ৪ রান যোগ করে শফিউলের বলে আউট হলেন ট্রট। কোনো বল মোকাবেলা না করলেও বেল সেদিন ভাঙ্গা পা নিয়ে ননস্ট্রাইকে ট্রটকে সাহস দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশ জিতে যায় ৫ রানে। এটিই ছিল ওডিআই ক্রিকেট ইতিহাসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়।
পায়ে অতিরিক্ত গার্ড নিয়ে মাঠে নামেন ইয়ান বেল
৩
এমন আরো কিছু ঘটনার নজীর আছে ক্রিকেটে। ২০১৪ সালে মরনে মরকেলের বলে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর সবাই যখন ভেবেই নিয়েছিল মাইকেল ক্লার্ক ব্যাট করতে নামতে পারবেন না, ঠিক তখনই ক্লার্ক মাঠে নেমেছিলেন দলের স্বার্থে। ২০১১ সালে ইঞ্জুরীতে পড়ার পরেও ওয়াহাব রিয়াজ ১১ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১১টি বলও মোকাবেলা করেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২০১৪ এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফিল্ডিং করতে গিয়ে হাত ফেটে যায় সোহাগ গাজীর। দলের যখন ৩৬ বলে ৫০ রানের প্রয়োজন হয় তখন ১১ তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যান্ডেজ পরেই ব্যাট হাতে নেমে গিয়েছিলেন ক্রিজে। সোহাগ গাজী ব্যাটে নামার পর ২৩ টি বল খেলেছিল বাংলাদেশের শেষ জুটি এবং সোহাগ গাজী ৮ বল মোকাবেলা করেছিলেন সেদিন।
৪
১৯৮৪ সালের হেডিংলি টেস্টে ফিল্ডিং করার সময় আঙ্গুলের হাড় ভেঙ্গে যায় ম্যালকম মর্শালের। দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতে নেমে পড়েন ১১ নম্বর পজিশনে। জিওফ অ্যালটের বলে বোথামের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হবার আগে ১৬ মিনিট ক্রিজে থেকে ৮টি বল মোকাবেলাও করেন মর্শাল। ৮টি বলই তিনি ১ হাতে ব্যাট নিয়ে খেলেছিলেন, ১টি বাউন্ডারিও ছিল এক হাতের কাট শট খেলে।
মানুষটি ম্যালকম মর্শাল
২০০২ সালে এন্টিগুয়া টেস্টে মাথায় ব্যান্ডেজ পরেই ৯টি ওভার বল করেছিলেন অনিল কুম্বলে। নিয়েছিলেন ব্রায়ান লারার উইকেটটিও।
৫
এরা সবাই নায়ক। ক্রিকেট মাঠের নায়ক। তবে শনিবার তামিম ইকবাল যেটা দেখালো সেটা ছাঁপিয়ে গেছে ক্রিকেট ইতিহাসের অতিতের সকল নায়কদের ঘটনাকে। দলীয় ২য় ওভারে লাকমলের বলটি তামিমের হাতে লাগায় উঠে যেতে হয় তামিমকে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ২ ঘন্টা চিকিৎসার পর এক্সরে রিপোর্টে ফ্রাকচার ধরা পড়ায় সকল গনমাধ্যমে খবর রটেও গিয়েছিল তামিম আর খেলছেন না এশিয়া কাপে, ৬ সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে তিনি। এমন দুর্বিষহ ঘটনা মনে হয়না তামিমের জীবনে আগে কখনো ঘটেছে। ঈদের ছুটিতে সবাই যখন আপনজনের সাথে ঈদ কাটাচ্ছে, তখনও মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে একা একাই ব্যাটিং প্রাকটিস চালিয়ে যাচ্ছেন তামিম। যে মানুষটার মধ্য এতটা অধ্যবসায়, সেই মানুষটার ভাগ্যে মাত্র ২টি বল! এটা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল? জীবন চরম নাটকীয় গল্প উপন্যাস নয়।
২২৯ রানে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মোস্তাফিজ যখন আউট হয়ে গেলেন, তখন কোটি কোটি দর্শক ভেবে নিয়েছিল শ্রীলংকার জন্য টার্গেট এই ২৩০ ই হবে। তাৎক্ষনিক ক্যামেরার চোখ চলে গেল হাটি হাটি পা পা করে ড্রেসিংরুম হইতে মাঠের ভিতরে নামতে থাকা তামিমের দিকে। সবাই অবাক! তামিম মাঠে! ব্যাট হাতে ব্যাট করবেন তিনি! মাত্রই হাসপাতাল ইইতে রিপোর্ট এল তামিম ৬ সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে, সে কিনা মুশফিককে সাপোর্ট দিতে মাঠে নেমে গেলেন!
ব্যাটিংয় করার জন্যই হাঁটছেন তামিম!
৪৭ তম ওভারের শেষ বলটি তামিম মোকাবেলা করলেন মাত্র ডান হাত দিয়ে। বলটি ব্যাটে লাগার পর ২৭০° ডিগ্রী কোণে ঘুরে যেতে দেখা গেল! তামিম অবিচল রইলেন। পরের ১৫ টি বল মুশফুক নিজেই খেললেন। দলে যুক্ত হল আরো ৩২ টি মহা মূল্যবান রান। কাগজে কলমে রানগুলো মুশির খাতায় যুক্ত হলেও রানগুলো যে তামিমেরও সেটা নিয়ে কেউ দ্বিমত পেষণ করেনি। পত্রপত্রিকায় লেখা হল মুশফিক তামিম কল্যাণে বাংলাদেশ জয়ী। এ জয়ের নায়ক তামিম।
মাঠের একশন!
কোনো এক ইন্টার্ভিউ এ তামিমের জননী বলেছিলেন তামিম যখন ব্যাট করে তখন তিনি চোখ বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু এদিন তামিমের বীরত্ব দেখে তার জননী কি করছিলেন সেটা তার পরিবারই ভাল জানেন।
একটা আঙ্গুল নাই তাতে কি হয়েছে, একটা হাত তো আছে! হয়তো এটাই তখন তামিমের মনে ছিল। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশনের সময় গ্রেনেড বিষ্ফোরনে শহীদ জুয়েলের ডান হাতের আঙ্গুলগুলো মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর জুয়েল তার বোনকে বলেছিলেন "আঙ্গুল গুলো ঠিক না হলে দেশ স্বাধীন হবার পর ক্রিকেট খেলব কি করে, বল তো!" তামিমের মনে হয়তো এমন কাজ করেছিল 'আঙ্গুল তো একদিন ঠিক হবেই, কিন্তু এই ম্যাচ হেরে গেলে সেটা আর ফিরে পাওয়া যাবেনা।' তাইতো তিনি ব্যাটিং গ্লাভস কেটে ভাঙ্গা আঙ্গুল সেখান দিয়ে বের করে আঙ্গুলগুলো অক্ষত রেখে দেশ এবং দশের জন্য মাঠে নেমে গেলেন।
দেশ এবং দশের কাছে এখন একটা প্রশ্ন, 'তামিমকে মনে রাখবেন তো?' নাফিস ইকবাল কিন্তু এরই মধ্যে বলে ফেলেছেন, তামিমকে যেন আমরা সবসময়ই মনে রাখি।
- 0 মন্তব্য