• ক্রিকেট

বিচিত্র ক্রিকেটে বিচিত্র সব কিম্ভুতকিমাকার রেকর্ড

পোস্টটি ৭০৭৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

যদি প্রশ্ন করা হয় পাড়ার ক্রিকেটে আপনি কত রান করেছেন, তাহলে অনেকেই বলতে থাকবে আমি একশো করেছি, আমি দুইশো করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। বল হাতে হ্যাট্রিকের উপর ডাবল হ্যাট্রিকও করেছি। এমন সব কথা বেরিয়ে আসবে সাবলীলভাবে। আসলেও এমন সব কান্ড তারা ঘটিয়েছেন। কারো কারো পারফরমেন্স টা হাইলাইটস হয়েছে আবার কারোটা ঢাকা পড়েছে পর্দার অন্তরালে।

পাড়ার ক্রিকেট আপনি কি করেছেন কি না করেছেন এইটি কি আর আইসিসি খবর রাখবে? না, রাখবে না। ওরা ঢাকঢোল পিটিয়েও বলবেনা ওমুক এত করেছে তমুক এত করেছে। এমন লাখ লাখ রেকর্ড ঘটছে মাইনর ক্রিকেটেও। সেগুলিরই খবর রাখাসহ সময় থাকেনা, আর তো ওই পাড়ার ক্রিকেটের পরিসংখ্যান।

ওইযে আমি বলছিলাম কিছু ঘটনা হাইলাইটস হয় অনায়াসে। এখনকার সময়ের গনমাধ্যমের বদৌলতে সবাই সেটা ভালভাবেই জানতে পারে। পারবেই না কেন বলুন, যদি একটা খবর চাপিয়ে লক্ষ লক্ষ ভিজিটর তাদের ওয়েবসাইটে এঙ্গেজড যায় বা টিভি চ্যানেলের টিআরপি বেড়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুন হয় কিংবা ফেইসবুকে হাজার হাজার লাইকইক কমেন্ট পড়ে কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে হঠাৎ সাবস্ক্রাইবারের ঢল নামে, তাহলে তো ওই নিউজই ভাইরাল করা ভাল।

আমি রেকর্ড পরিসংখ্যান খুঁজতে পছন্দ করি। কবে কোথায় কে কি করল তা নিয়ে সর্বদা কৌতুহলের শেষ নাই। ক্রিকবাজ, ক্রিকইনফো, হাউস্ট্যাটস, আইসিসির ওয়েবসাইট ঘেঁটেঘুটে খানখান করে ফেলার অভিজ্ঞতা বেশ চওড়া। যার বদৌলতে সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল, সরি কিছু চাঞ্চল্যকর রেকর্ড পরিসংখ্যানের ফুলঝুরি। এমন কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা তুলে ধরব এখানে।

টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে ৯৬২/৬ রান করে ডিক্লেয়ার দেয় শ্রীলঙ্কা। এটা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। টেস্ট ৯০০+ রানের ইনিংস আরো একবার ঘটেছিল ১৯৩৮ সালে। অথচ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এক ইনিংসে ১১০৭ রান পর্যন্ত এসেছে (নিউ সাউথ ওয়েলস এর বিপক্ষে ভিক্টোরিয়া)। তাসমানিয়ার বিপক্ষে এই ভিক্টোরিয়াই আবার ১০৫৯ রান করেছিল ১৯২৩ সালে।

Sri-Lanka-952৬ উইকেটে ৯৫২ রান করে শ্রীলংকার ইনিংস ঘোষণা (ছবিঃ ক্রিকেট কাউন্ট্রি)

 এটা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের রেকর্ড। তবে মাইনর ক্রিকেটে ভারতের মুম্বাইয়ে ভান্ডারি কাপে কে.সি গান্ধী স্কুল দল আরিয়া গুরুকুল দলের বিপক্ষে ১৪৬৫/৩ রান করে ইনিংস ঘোষনা করে। ওই দলের ওপেনার প্রনব ধানাওয়াড ৩২৭ বলে ১২৯টি চার ও ৫৯টি ছক্কার সহায়তায় ১০০৯* রানে অপরাজিত থাকেন। প্রতিপক দল কত করেছিল জানেন? ৩১ ও ৫২ রান! ইনিংস ও ১৩৮২ রানে জেতে কেসি গন্ধী স্কুল দল। ১৮৯৮ সালের আরো একটি ম্যাচে এসেনডনের বিপক্ষে মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় দল ১০৯৪ রান করে। 

230667১৪৫৬ রান করা ম্যাচের স্কোরকার্ড এবং প্রনব ধানাওয়াড এর ১০০৯* (ছবিঃ ক্রিকইনফো)

মাইনর ক্রিকেটে এমন অসংখ্য চাঞ্চল্যকর ম্যাচের ইতিহাস আছে। ২০০৭ সালে হায়দরাবাদে ৪০ ওভারের একটি ম্যাচে সেন্ট ফিলিপস স্কুলের বিপক্ষে সেন্ট পিটার্স হাই স্কুল ৭২১/০ রান করে। ১৯৯৪ সালে নেদারল্যান্ডে গান্ধী সিসি ২য় একাদশের বিপক্ষে গান্ধী সিসি দল ৫৫ ওভারে ৮১৫/১ রান তুলেছিল। এগুলো আসলে শুনতেই যেন কেমন লাগে।  

২০১৪ সালে ইংলিশ পত্রিকা দ্যা টেলিগ্রাফে  ছাপা হয়েছিল একটি নিউজ। উইরেল ক্রিকেট ক্লাব এক ঘরোয়া টুর্নামেন্টের (চেশায়ার লিগ) একটি ম্যাচে ৩ রানে অলআউট হয়েছিল হ্যাশলিংটন ক্রিকেটে ক্লাবের বিপক্ষে। উইরেল ক্লাবের প্রথম ১০ জন ব্যাটসম্যানই আউট হন ০ রান করে। শেষ ব্যাটসম্যান ১ রানে অপরাজিত থাকেন। বাকি ২টি রান আসে অতিরিক্ত খাত থেকে। হ্যাশলিংটন ক্লাবের বোলার বেন ইসটেড ১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। এটা অবশ্য ৪ দিনের ম্যাচ ছিল।

x720-VXW৩ রানে অল আউট হওয়া ম্যাচের স্কোরকার্ড  (ছবিঃ Sky Sports)

আগেই তো জানানো হয়েছেন প্রনব ধানাওয়াড ১০০৯* রান করেছিলেন লঙ্গারভার্সন ক্রিকেট। ১৮৯৯ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ক্লিফটন কলেজ মাঠে জেমস কলিন্স নামের এক ব্যাটসম্যান ৬২৮* রান করেন। ভারতীয় দলের বর্তমান উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান পৃত্থিব 'শ ২০১৪ সালে স্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ৫৪৬ রান করেন। সিমিত ওভারের ক্রিকেটে শেন ড্যাডসওয়েল পোটচেফস্ট্রমে ২০১৭ সালে ১৫১ বলে ২৭ চার ও ৫৭ ছক্কায় ৪৯০* রান করে অপরাজিত থাকেন।

ক্রিকেট ইতিহাসের রেকর্ড পাতায় ১ বলে ২৮৬ রানের একটা রেকর্ড লেখা আছে। কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় এর সত্যতার ব্যাপারেও লেখা আছে। তবে এক ওভারে কত রান আসছে সর্বোচ্চ এটা কি জানা আছে কারো? এইচ মরলে নামক এক ব্যাটসম্যান ১৯৬৯ সালে  ওভারে ৬২ রান নিয়েছিলেন। এছাড়া মাইর ক্রিকেটে এক ওভারে ৪৯, ৪৮, ৪৬, ৪৪ রান নেওয়ার কথাও শোনা যায়।


২০০৭ সালে হায়দ্রাবাদে মনোজ কুমার ও মোহাম্মদ শাইবাজ ৭২১ রানের পার্টনারশিপ গড়েছিলেন ৩য় উইকেট জুটিতে। ১৪৬৫ রান করা ওই ম্যাচটিতে ওপেনিং জুটি হইতে এসেছিল ৫৪৬ রান। এমন অসংখ্য রেকর্ড এর নজীর আছে মাইনর ক্রিকেটে।

বোলারদের নিয়ে তাহলে এবার একটু আলোকপাত করা যাক। ১৯৩১ সালে পিটার হুগু আলিওয়াল নর্থের বিপক্ষে স্মিথফিল্ডের হয়ে টানা ৯ বলে ৯টি উইকেট নিয়েছিলেন। মানে ত্রিপল হ্যাট্রিক! ১৯৬৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বোলার স্টিফেন ফ্লেমিং (কিউই অধিনায়ক স্টিফেন ফ্লেমিং নন) ও টানা ৯ উইকেট নেন। ম্যাট নেলসন নামক আরেক বোলার (নিউজিল্যান্ড) টানা ৩টা হ্যাট্রিক করেছিলেন ২০০৪ সালে যেটা উইজডেন তাদের সাময়িকীতে প্রকাশ করেছিল।  এগুলো ছাড়াও একাধিকবার টানা ৭ ও ৮ বলে উইকেট পেয়েছে বহুবার। ১৯১৭ সালে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর দুটো দলের মধ্যকার একটা খেলায় জে. লিক ১২ বলে ১০ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। এমন আরো একটা ঘটনা ঘটে ১৯৪৬ সালে। ১৮৮৭ সালের একটা ম্যাচে পেঙ্গে বনাম ক্রইডন রেভেলার্স এর মধ্যকার খেলায় এফ. ওল্ডহ্যাম নামক এক বোলার ৫টা বার হ্যাট্রিক করেছিলেন বলে জানা যায় 'কালেক্টিং রাইটিং অন ক্রিকেট' নামক বইয়ে।

ক্রিকইনফোর এক রেকর্ড পাতায় পাওয়া যায় মাইনর ক্রিকেটে ২৫ টি ঘটনা ঘটেছে যেখানে একজন বোলার ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছেন কোনো রান না দিয়েই! ডেভিড মর্টন নামক এক বোলার সর্বশেষ এমন রেকর্ড গড়েছে ১৯৯৯ সালে ব্রিজবেনে।

দর্শকেরা হল ক্রিকেট মাঠের প্রাণ। দর্শক শূন্য ক্রিকেট মাঠ যেন লবনছাড়া তরকারির মত। ক্রিকেটে হাতেগোনা কিছু স্টেডিয়াম আছে যেখানে খেলা হওয়া মানেইই যেন দর্শকের উপচে পড়া ভীড়। যেমন ভারতের ইডেন গার্ডেন্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ ক্রিকেট গ্রাউন্ডস। ক্রিকেট ইতিহাসের সব রেকর্ড এর সাক্ষী এই স্টেডিয়াম দুটিতে (দর্শকদের ক্ষেত্রে)।

১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে মেলবোর্নে ৮৭,৮১২ জন দর্শক ফাইনাল দেখেছিল। ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ৩টি ম্যাচে ১ লক্ষেরও বেশি দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখেছিল। এমন ঘটনা আরো অনেকবার ঘটেটে ইডেনে এবং মেলবোর্নে। শুড়ু ওডিআই ক্রিকেটে নয়, টেস্টেও ১ লক্ষ দর্শক দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। ২০১৩ সালে অ্যাসেজের ৪র্থ টেস্টের প্রথম দিনে মেলবোর্নে ৯১,১১২ জন দর্শক উপস্থিত ছিল। ১৯৯৯ সালে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পাক-ভারত ম্যাচে ১০০০০০+ দর্শক খেলা দেখতে ইডেন গার্ডেনে সমবেত হয়েছিল।

cb883924a7a8efb87b56fdf0bd1d47be2295aac7বক্সিং ডে টেস্ট ২০১৩  (ছবিঃ ক্রিকইনফো )

ইংল্যান্ডের ক্রিকেট স্টেডিয়াম গুলোতে দর্শন ধারনক্ষমতা একটু কম হয়। এজন্য ইংল্যান্ডের মাটিতে এমন বড় কোনো রেকর্ড নাই। তবে ১৯৪৮ সালে লীডস টেস্টে ১৫৮,০০০ দর্শক মাঠে এসেছিল ৫ দিনে।  তবে এক টেস্টে সর্বোচ্চ ৪৫৬,০০ দর্শক দেখেছিল ১৯৯৯ সালের পাক-ভারত টেস্টটি।এছাড়া ১৯৩৭ সালে মেলবোর্নে ৩৫০,৫৩৪ জন খেলা দেখেছিল ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে।

Eden_Gardens_under_floodlights_during_a_match ২০১৬ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ইডেন গার্ডেনস  ( ছবিঃ উইকিপিডিয়া )

১৯৫৩ সালের অ্যাসেজে ইংল্যান্ডের মাঠে ৫ টেস্ট মিলিয়ে ৫৪৯,৬৫০ জন খেলা দেখেছিল! তবে সবচেয়ে বেশি ১৯৩৬ সালের অ্যাসেজ সিরিজটা মাঠে বসে খেলা দেখেছিল ৯৪৩,০০০ দর্শক!

অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি বোলার ডেনিস লিলি তার লেখা বই 'আর্ট অব ফার্স্ট বোলিং' বইয়ে (২৭-৩০ পৃষ্ঠা) লিখেছিলেন ১৯৭৫ সালে বোলিং স্পিড পরীক্ষা করার জন্য পার্থে অত্যাধুনিক টেকনোলজির বোলিং স্পিড ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। ওই ক্যামেরার সামনে কিংবদন্তি কিছু বোলার বল করেছিলেন যেখান সবচেয়ে দ্রুত ১৬০.৪৫ কিঃমিঃ গতিতে বল করেন জেফ থমসন। থমসন দুটো বল ১৬০.৪৫ বেগে করেছিল। সেদিন থমসনের পাশাপাশি গিয়েছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস (১৫৯.৪৯), মইকেল হোল্ডিং (১৫০.৬৭) ডেনিস লিলি (১৪৮.৫৪)। লিলি ক্লান্ত ছিলেন আর তখন মাইকেল হোল্ডিং এর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর!

195379থম্পসনের বল ডিফেন্স করতে না পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ফ্রেড টিটমুস  (ছবিঃ গেটি ইমেজ)

১৯৭৬ সালের আরেকটি পরীক্ষায় নিজেকে ছাড়িয়ে যান জেফ থমসন। সেবার করেন ১৬০.৬ কিঃমিঃ গতিতে। লিলি গতি দিয়েছিলাম ১৫৪.৮, মাইকেল হোল্ডিং ১৫৩.২।

এগুলো কব্জির জোর। তবে কব্জির জোর দেখানোর আরো একটা মাধ্যম আছে সেটা হল বল ছুড়ে মারা। কে কতদূর বল ছুড়ে মারতে পারল সেই রেকর্ড। ১৮৮২ সালে ডুরহামে রবার্ট পারকিভাল বল ছুড়ে ১৪০ গজ ২ ফুট দুরে পাঠিয়েছিলেন! এর ১০ বছর আগে টেরেন্টোতে রস ম্যাকেঞ্জি ১৪০ গজ ৯ ইঞ্চি দূরে পাঠান।

9Starc-throwবল থ্রো করছেন মিচেল স্টারক (ছবিঃ ইন্টারনেট)

এগুলো সবই রেকর্ড। যেগুলো লেখা থাকে ওয়েবসাইট, ম্যাগাজিন এবং ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে। কারো কাছে এগুলো জানা খবর কারো কাছে অজানাই রয়ে যায়। আর যারা এগুলো প্রথম শোনে তারা যেন হতভম্ব হয়ে যায় 'এ আমি কি জানলাম' এটা ভেবে।