• ফুটবল

বিশ্বকাপে স্পেনের টিকি-টাকা যেভাবে ব্যর্থ হল

পোস্টটি ১৮১১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০১৮ বিশ্বকাপে স্পেন-রাশিয়া ম্যাচ। স্পেন পরিষ্কার ফেভারিট। শুরুতেই রাশিয়ান সেন্টারব্যাকের সৌজন্যে গোল পেয়ে তারা নিজেদের সক্ষমতাই প্রমাণ করেছিল। কিন্তু এরপর যা হল তা অবিশ্বাস্য। রাশিয়ার ২৮৪ টি পাসের বিপরীতে এক হাজারেরও বেশি পাস সম্পন্ন করেও কিভাবে যেন ম্যাচের বাকিটা সময় রাশিয়ান গোলপোস্টকে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের কোনও দুর্গের মতোই অধরা বানিয়ে ফেলল। সেই সাথে জেরার্ড পিকে তার ‘হ্যান্ডবল’ ঐতিহ্যের  প্রতি সুবিচার করে স্পেনের বারোটা পুরোপুরিই বাজিয়ে দেন।

spain failure

এখন যে প্রশ্নটা উঠে আসছে সেটা হল, এত ভালো একটা টিম আর পরীক্ষিত ট্যাকটিকস নিয়েও কিভাবে স্পেন নিজেদের সর্বনাশ করতে সক্ষম হল। প্রথমত ফার্নান্দো হিয়েরো কোনও পরীক্ষিত কোচ নন। স্পেনের হয়েই প্রথমবারের মত কোনও সিনিয়র টিমের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ট্যাকটিক্যালি লক্ষণীয়ভাবে নবিস এই কোচ হুলেন লোপেতেগুই-এর পরিকল্পনা এবং টিম কম্বিনেশন বাস্তবায়নে পুরোপুরিই ব্যর্থ হন। এজন্য অবশ্য তাকে কোন দোষারোপও করা যাচ্ছে না। বিশ্বকাপের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে দায়িত্ব দেওয়া হলে ক্লপ-মরিনহোরাই মুখ থুবড়ে পড়তেন, আর উনি তো হিয়েরো।

‘টিকি-টাকা’ মূলত স্পেনে প্রচলিত একটা ‘জাগলিং টয়’। ফুটবলে এই টার্মটা শর্ট পাসিং এবং মুভমেন্ট বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই সিস্টেমে পজেশন ধরে রেখে বিভিন্ন চ্যানেলের মধ্য দিয়ে বল পাস করে আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। ইয়োহান ক্রুইফের মস্তিষ্কপ্রসূত এই সিস্টেমটি স্পেন ন্যাশনাল টিমে সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন লুইস আরাগোনেস। তার অধীনেই ইউরো ২০০৮ জিতে স্পেন। এরপর দেল বস্ক এই ধারা অনুসরণ করে বিশ্বকাপ ২০১০ এবং ইউরো ২০১২ এনে দিয়ে সাফল্যের ষোলকলা পূর্ণ করেন। টিকি-টাকায় মূলত পজেশন ধরে রেখে প্রতিপক্ষকে বল তাড়া করতে বাধ্য করা হয়। অত্যধিক মুভমেন্টের ফলে ক্লান্ত প্রতিপক্ষ পিচের সব স্পেস কভার করতে ব্যর্থ হয়। এসব খালি জায়গা ব্যবহার করেই টিকি-টাকা তার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত করে তুলে প্রতিপক্ষকে।

এই বিশ্বকাপে স্পেন পজেশন ধরে রেখে খেললেও সেটা ছিল নির্বিষ সাপের দংশনের মতই। বল রিকভার করার পর সেটাকে ফরওয়ার্ড না করে ব্যাকপাস এবং সাইডওয়ে পাস খেলার কারণে প্রতিপক্ষ টিমের শেইপ রি-অর্গানাইজ করার জন্য সময়ের অভাব হয়নি। এছাড়াও স্পেনের হাইলাইন ডিফেন্সের কারণে মাঠের টোটাল ‘প্লেয়িং এরিয়া’ কমে যায়। এর ফলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স এবং এটাকিং লাইনের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে, তাদের সীমানায় ব্যবহার করার মত কোনও ‘ফ্রি-স্পেস’ পাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। এই বিশ্বকাপে স্পেনের বিপক্ষে কমবেশি সব কোচই ৪-৪-২ ফর্মেশন ব্যবহার করেন। চারজন মিডফিল্ডারের উপস্থিতির কারণে মাঠের সেন্ট্রাল এরিয়াটা ‘ক্রাউডেড’ হয়ে পড়ে, স্প্যানিশ মিডফিল্ডাররা তখন ওয়াইড এরিয়ায় সরে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে মাঝখানে খালি হওয়া জায়গায় প্রতিপক্ষের দ্রুতগতির কাউন্টার এটাকের তোড়ে স্প্যানিশ ডিফেন্স খড়কুটোর মতই ভেসে যায়।

স্পেনের টিকি-টাকা কাজ না করার আরেকটি কারণ হচ্ছে ‘পাসিং ট্রায়াঙ্গল’ গঠনের ব্যর্থতা। গার্ডিওলা তার বার্সা আমলে এর ওপর খুব জোর দিয়েছিলেন। তার ম্যাজিক্যাল ট্রিয়ো জাভি-ইনিয়েস্তা-মেসি এর সার্থক রূপায়ন দেখিয়েছিলেন। এই ট্রায়াঙ্গল গঠনের মাধ্যমে যেমন সর্বোচ্চ পাসিং অপশনের সুবিধা পাওয়া যায়, তেমনি মাঠের যে কোনও জায়গায় প্রতিপক্ষকে ‘আউটনাম্বার’ করে ফেলা যায়। এবার ইস্কো-ইনিয়েস্তা মিলে চেষ্টা করলেও স্ট্রাইকার ডিয়েগো কস্তার অসহযোগিতার কারণে ট্রায়াঙ্গলটা পূর্ণতা লাভ করেনি।

এবার স্পেনের মূল স্ট্রাইকার ছিলেন ডিয়েগো কস্তা। ক্যারিয়ারজুড়েই চেলসি এবং এটলেটিকোতে সময় কাটানো এই স্ট্রাইকার লং বল এবং ক্রসে সাবলীল হলেও লিঙ্কআপ প্লে-তে বেশ খানিকটা অসহায়ই বলা চলে তাকে। এর ফলে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ‘সিগফিকেন্ট ফ্লেক্সিবিলিটি’র অভাব বোধ করে স্পেন। কস্তাকে সহায়তা করতে কোচ কোনও ফলস নাইনও ব্যবহার করেন নি, যিনি তার অফ দ্যা বল মুভমেন্টের মাধ্যমে কিংবা ‘ডিকয় রান’ দিয়ে ডিফেন্ডারদের কস্তার কাছ থেকে সরিয়ে আনতে পারতেন। গার্ডিওলার সময় এই রোল প্লে করা মেসি নিঃশব্দ আততায়ীর মত ডি-বক্সের ভিতরে-বাইরে পিস্টনের মত মুভ করতেন। এর ফলে তার মার্কার প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন এই ভেবে যে, তিনি নিজের পজিশন ছেড়ে সামনে গিয়ে মেসিকে মার্ক করবেন, নাকি আগের পজিশনে থেকেই ডিফেন্ড করবেন।

রাশিয়া ম্যাচে স্পেনের বিরুদ্ধে বেশ কম্প্যাক্ট শেইপ বেছে নেওয়া হয়। এর ফলে সেন্ট্রাল এরিয়া প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেলেও ওয়াইড এরিয়া খালি হয়ে যায়। এই জায়গাটা ব্যবহার করে কাট-ইন করে যেমন ডি-বক্সে ঢোকা সম্ভব ছিল, তেমনি টাচলাইন বরাবর গিয়ে সেখান থেকে বক্সে ক্রস ফেলাটাও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু এই কাজটা করার জন্য যে গতি, ড্রিবলিং এবং ক্রসিং এবিলিটি দরকার- তা এক লুকাস ভাসকেজ ছাড়া বাকি স্প্যানিশ উইঙ্গারদের ছিল না।

২০১০ সালে পর্তুগালকে স্পেন ১-০ গোলে হারানোর পর টিকি-টাকার সমালোচনা করে হোসে মরিনহো বলেছিলেন- ‘টিকি-টাকায় কোনও ডিফেন্ডার কিংবা এটাকার নেই, এখানে সবাই মিডফিল্ডার’। ২০১৮-তে এসে রামোস-পিকেরা পাসের ফুলঝুরি ছুটিয়ে রাশিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়ে মরিনহোর কথাটিকেই যেন সত্য প্রমাণ করে দিয়ে এলেন।