লা ডেসিমা: একটি প্রজন্মের আবেগের উপাখ্যান
পোস্টটি ৩১৫৫ বার পঠিত হয়েছে২০০২ সালে প্রথম ও একমাত্র ক্লাব হিসাবে নবম বারের মত উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। জিদানের সেদিনের জাদুকরী ভলি ও বদলি গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসের দুর্দান্ত সেভগুলোর মাধ্যমে নবম শিরোপা নিজেদের করে নেওয়া মাদ্রিদ অভিজাতদের অপেক্ষা দশমের অর্থাৎ 'লা ডেসিমা'র!পরের মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে মনে হলো এবারই হয়ত আসবে লা ডেসিমা কিন্তু না জ্যুভেন্টাসে অবসান হয় সে স্বপ্নের। ২০০৩-০৪ মৌসুমে স্বপ্ন যাত্রার সমাপ্তি হয় কোয়ার্টার ফাইনালে। এ্যাওয়ে গোলের সুবিধায় মোনাকো চলে যায় সেমিফাইনালে। গ্যালাক্টিকো সমৃদ্ধ রিয়াল মাদ্রিদ স্বপ্ন দেখে পরের মৌসুমে লা ডেসিমা জয়ের। ২০০৪-০৫ মৌসুম!আরও একটি বসন্ত পেরিয়ে যায়, ভাগ্য সাথে থাকে না লা ডেসিমাও আসে না।এবার দৌড় থামে শেষ ষোলোতে আর ঘাতক আবারও জ্যুভেন্টাস। লা ডেসিমার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হয় একটি প্রজন্ম, একটি প্রজন্ম কৈশোর পেরিয়ে পদার্পণ করে যুবাতে।কিন্তু লা ডেসিমাতো দূরে থাক রিয়ালের আর শেষ ষোলোই পার হওয়া হয় না। পেরেজের প্রথম গ্যালাক্টিকো অবসরে চলে যায়। নতুন মুখ হিসেবে রাজকীয় ক্লাবে আগমন ঘটে মার্সেলো-হিগুইন-আর্বালোয়াদের তবুও লা ডেসিমা আসে না! রিয়ালের আর ইউরোপের মঞ্চে উৎসব করা হয় না। কখনো বায়ার্ন, কখনো জ্যুভেন্টাস,কখনো লিভারপুল ঘাতকের পরিবর্তন হলেও রিয়ালের ভাগ্যের আর পরিবর্তন হয় না। রোনালদো-কাকা-বেঞ্জেমারা আসেন তবুও শেষ ষোলোর গেঁড়ো আর কাটে না। রাউল ক্লাব ছেড়ে চলে যান আসেন ডি মারিয়া -ওজিলরা তবুও লা ডেসিমা আসে না। ২০১০-১১ মৌসুম!২০০২-০৩ মৌসুমের পরে প্রথমবারের মত সেমিফাইনালে ওঠে রিয়াল মাদ্রিদ। রোনালদোদের পায়ে স্বপ্ন যাত্রা চলতে থাকে কিন্তু মেসির পায়ে তা থেমে যায়। পরের মৌসুমে আবারও সেমিফাইনালে পৌছায় রিয়াল মাদ্রিদ। আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখা। সামনে হিটলারের দেশ জার্মানির ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে পেনাল্টি শুটআউটের ভাগ্য বিড়ম্বনা।লাল উৎসবে স্তব্ধ বার্নাব্যু।রামোস কাঁদেন কাঁদে বার্নাব্যু।কান্নারত রামোসকে রড় ভাইয়ের মতো বুকে আগলে সান্ত্বনা দেন ক্যাসিয়াস। কিন্তু কান্না থামে না লা ডেসিমাও আসে না। পেনাল্টি মিস করার পর রোনালদো বলেন, "আমার কাছে আপনাদের একটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ প্রাপ্য, এটা এনে দিতে আমি নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত "।দলের প্রাণভোমরার দেওয়া আশ্বাসে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করে মাদ্রিদিস্তারা। ২০১২-১৩ মৌসুম।সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ ডর্টমুন্ড। রবার্ট লেভান্ডভস্কির 'লন্ডভন্ড' কান্ডে আবারও সেমিফাইনালেই থেমে যায় স্বপ্ন যাত্রা। সেমিফাইনালের গেঁড়ো কাটে না আর শিরোপার সুভাসও পাওয়া হয় না।অপেক্ষায় অপেক্ষায় একযুগ কেটে যায় তবুও লা ডেসিমা ধরা দেয়না।অবশেষে ২০১৩-১৪ মৌসুম।সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া এক আঁতেল গাঁটছড়া বাঁধে ইউরোপ ক্লাব ফুটবলের সাথে।অন্যদিকে মাঠে নামে তার প্রিয় দল রিয়াল মাদ্রিদ। নতুন মৌসুমে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখে মাদ্রিদিস্তারা। মনে প্রশ্ন এবার হবে তো? না কি আবারও হৃদয় ভাঙা গল্পে সমাপ্তি হবে বিগত বছরগুলোর মতো।কোয়ার্টার ফাইনাল!সামনে গতবছরের জম ডর্টমুন্ড।বার্নাব্যুতে রোনালদো-ইস্কো-বেল বিশ্বাসের সুতোটা শক্ত করেন, ইদুনা পার্কে চোখ রাঙান রিউস! ৯০ মিনিটের নাটক শেষে গতবারের প্রতিশোধ সম্পন্ন করে সেমিফাইনালে পা রাখে গ্যালাক্টিকোসরা। এবার সামনে বায়ার্ন। সেমিফাইনালের গেঁড়ো খুলবে তো? নাকি ২০১২ এর পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে? এমন সব চিন্তায় হয়ত উৎকন্ঠিত আপনি।কিন্তু রোনালদো-রামোসদের মনে ছিলো অন্য কিছু। রামোস পণ করে নেমেছিলান এবার আর কাঁদবেন না তাইতো ২০ মিনিটেই করে বসলেন জোড়া গোল।এরপরে দৃশ্যপটে রোনালদো! তিনিও করলেন জোড়া গোল।মনে হচ্ছে তিনি তার কথাটা রাখতেই বদ্ধপরিকর। স্বপ্নের ফাইনালে প্রতিপক্ষ নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। লিসবনে সেদিন সূর্য উঠেছে ঘরের ছেলে রোনালদোর স্বপ্নকে রাঙিয়ে দিতে।গোটা লিসবন রোনালদোদের জয়ের অপেক্ষায়। আর রোনালদোদের অপেক্ষা লা ডেসিমার।সব ঠিকই চলছিলো কিন্তু ৩৬ মিনিটে গোডিন গোল করে বুঝিয়ে দিলেন তারাও জিততেই এসেছেন। প্রথম অর্ধ এ্যাটলেটিকোর এগিয়ে থাকার মাধ্যমেই শেষ হয়।দ্বিতীয় অর্ধ শুরু হতেই গোল পরিশোধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে রিয়াল মাদ্রিদ। লিসবনের ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে থাকে তার নিয়মেই।৬০ মিনিট.... ৭০ মিনিট..... ৮০ মিনিট..... ৯০ মিনিট। ইকোলাইজার আসেনা। রোনালদো-বেল-বেঞ্জেমা-ডি মারিয়া-মার্সেলো-খেদিরা-মাদ্রিচ-রামোসরা আক্রমণের ঢেউ তুলেও ডেডলক ভাঙতে পারেন না তবুও মানুষগুলো হাল ছাড়েন নাহ।আপনার তখন মনে হতেই পারে তবে কি একযুগ ধরে চলে আসা 'এতো কাছের তবুও এতো দূরের' গল্পটার সমাপ্তি এবছরও হচ্ছে না।আপনার এসব ভাবনার মাঝেই শুরু হয় ইঞ্জুরি টাইমের খেলা।এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তাদের প্রথম উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জয় থেকে পাঁচ মিনিট দূরে।সাদা জার্সি পরিহিত এগারো জন মানুষ তখনো গোল শোধ দিতে প্রাণ দিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ রেফারি কর্ণার কিকের বাঁশি বাজান।লিসবনের ঘড়িতে পেরিয়ে গিয়েছে ৯২ মিনিট।টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা সাথে এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ এগিয়ে যাচ্ছে জয়ের দিকে।কর্ণার -কিক নিতে এগিয়ে যান মদ্রিচ।এরপরেই লিসবনের সময় ৯২:৪৮ মিনিটে থমকে যায়।গ্লাডিয়েটর সার্জিও রামোস আইসিইউতে থাকা স্বপ্নটাকে দান করেন নতুন জীবন।সতীর্থদের মধ্যে এমন আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করেন যে অতিরিক্ত সময়ের ৩০ মিনিটে এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের উপরে রীতিমতো তান্ডব চালিয়ে বেল,মার্সেলো ও রোনালদোর গোলে ৪-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে রিয়াল মাদ্রিদ।
সেদিন লিসবন রূপকথার ফ্রন্ট কভার হওয়ার যোগ্যতা ছিলো ক্রাম্প নিয়ে লিড এনে দেওয়া বেলের।ফ্রন্ট কভার হওয়ার যোগ্যতা ছিলো ম্যাচসেরা ডি মারিয়ার। সেদিন ফ্রন্ট কভার হওয়ার যোগ্যতা ছিলো বুলেট গতির লেফট ফুটেড শটে কোয়ার্তোয়াকে বোকা বানানো মার্সেলোর।সেদিন ফ্রন্ট কভার হতে পারতেন পুরো টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং এ্যাটলেটিকোর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কিন্তু না সবাইকে ছাপিয়ে স্পটলাইটে এক!তিনি মিঃ৯২:৪৮।
"৯২ :৪৮" এটা এখন আর কোনো সংখ্যা নেই,এটা এখন আর নয় কোনো সময়ও সবকিছু ছাপিয়ে এটা হয়ে গিয়েছে একটি ব্রান্ড! একটি মিথ!হয়ত আজ থেকে ৫০ বছর পরে কেহ নাতি-নাতনীদের এ গল্প বলবে আর হবে নস্টালজিক। কেহ হবে শিহরিত, কেহবা বলবে জানিস," গোলটার পরে সময়কে ভুলেই গিয়েছিলাম আর গভীর রাতে চিৎকার দেওয়ার অপরাধে আম্মুর হাতে থাপ্পড়ও খেয়েছিলাম" হয়ত শ্রোতার হাসবে। কিন্তু গল্পকারক মনের অজান্তেই মুচকি হেসে দিবে কারন সে জানে সেদিনের থাপ্পড়টাও সেদিনের মূহূর্তটার মতই মধুর।যা হাজারবার বললেও হবেনা পুরানো।যা সর্বদাই বসন্তে সদ্য পাতাগজানো গাছগুলোর মতই চিরসবুজ রয়ে যাবে।
- 0 মন্তব্য