• ক্রিকেট

বিশ্বকাপ বিতর্ক(পর্ব-৫)

পোস্টটি ২০২৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০০৩ বিশ্বকাপ। আয়োজক যৌথভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে এবং কেনিয়া। সে বিশ্বকাপে দুই জিম্বাবুইয়ান অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা জন্ম দিলেন এক বিতর্কের। কারো কাছে হলেন নায়ক, কারো কাছে খলনায়ক।  

জিম্বাবুয়েতে তখন চলছে রবার্ট মুগাবের একদলীয় শাসন। মানবাধিকার হরণ, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি ইস্যুতে চলছিল নিরন্তর বিতর্ক। একঘরে হয়ে যেতে বসেছিল জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট অঙ্গনও। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক একমাস আগে ইংল্যান্ড বাতিল করেছিল তাদের জিম্বাবুয়ে সফর। ইংল্যান্ড এই সফর বাতিলের পেছনে নিরাপত্তার অজুহাত দেখালেও নীতিগত বিষয়ে জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসনের সঙ্গে একমত হতে না পারাই ছিল এর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বকাপ শুরুর আগ দিয়েও জিম্বাবুয়ের শাসকগোষ্ঠী কিছুটা ভয়ে ছিল যে, বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের ম্যাচগুলোতে হয়তো গ্যালারি থেকে এই স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ জানানো হতে পারে। এমন ভয়ের কিছুটা যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ এক বছর আগে বুলাওয়েতে একটা ম্যাচে এরকম প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন এক বিক্ষোভকারী। যাই হোক, শেষপর্যন্ত সবাই ক্রিকেটের দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়ায় কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন জিম্বাবুয়ের শাসকরা।

robert mugabe এর ছবির ফলাফলজিম্বাবুয়ের স্বৈরতান্ত্রিক শাসক রবার্ট মুগাবে। 

কিন্তু বসে থাকেননি তখনকার সময়ের জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার এবং হেনরি ওলোঙ্গা। তাঁরা জানতেন, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। এটাও জানতেন দেশ থেকে নির্বাসনে যেতে হতে পারে। ছিল মৃত্যুর হুমকিও। কিন্তু সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে, দেশের মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য ঝুকি নিলেন। কেউ ঝুঁকিতে না পড়ে, তাই আগে কাউকে জানাননিও। হারারের এক ক্যাফেতে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, করতেই হবে। এবং করলেনও। নামিবিয়ার বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের প্রথম ম্যাচের আগে তাঁরা সাংবাদিকদের কাছে একটা লিখিত বিবৃতিতে জানালেন যে, ‘জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র-হরণের শোকে’ তাঁরা হাতে কালো বাহুবন্ধনী বেঁধে মাঠে নামবেন।‘   

andy flower henri Olonga এর ছবির ফলাফল                            

 

 

 

 

 

 

 

 

 

                     অ্য্যান্ডি ফ্লাওয়ার এবং হেনরি ওলোঙ্গা।

খেলার শুরুতে সাংবাদিকদেরকে এই প্রতিবাদ সম্পর্কে জানানো হলেও খেলার ২২ তম ওভার পর্যন্ত আর কারোরই এ ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না। ২৩তম ওভারে ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। দেখা গেল সত্যিই তিনি মাঠে নেমেছেন কালো একটা বাহুবন্ধনী বেঁধে। এরপর ক্যামেরার চোখ খুঁজে নিল ওলোঙ্গাকেও। হারারে স্টেডিয়ামের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ওলোঙ্গার হাতেও দেখা গেল একই ধরণের জিনিস। তাদের হাতের ঐ কালো ব্যান্ডগুলো সেদিন জ্বল জ্বল করে জানিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র হরণের করুণ কাহিনী।

৪র্থ পর্ব - ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল, অন্ধকারের গহীনে হারিয়ে যাওয়া ফাইনাল!

জিম্বাবুয়ে সরকার এটা দেখার পর রাগে ফুঁসে উঠে। আইসিসিকে জানায় এই কর্মকান্ড যাতে অবৈধ ঘোষণা করে তাদের নিষিদ্ধ করতে। কিন্তু আইসিসি সরকারের পুরোপুরি কান দেয়নি। তবে ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গাকে বলে দেয়া হয়, যেন পরবর্তীতে এটা আর না করে। কিন্তু মানেননি তাঁরা। তারা পরবর্তীতেও কালো বাহুবন্ধনী বেঁধেই মাঠে নামার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। হেনরি ওলোঙ্গা খুব পরিস্কারভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘তারা যদি আমাকে দল থেকে বের করে দিতে চায় তো দিতে পারে। আমার কিছু যায় আসে না।’ তার অনুমানটা সঠিকই ছিল। পরবর্তী ম্যাচ থেকেই বহিস্কার করা হয় ওলোঙ্গাকে। টিম-বাস থেকেও নামিয়ে দেয়া হয়েছিল তাকে। ফ্লাওয়ারের সঙ্গেও এমন কিছু করা হতো, যদি না অন্য সব ক্রিকেটার একসাথে ম্যাচ বয়কটের হুমকি না দিতেন। ওলোঙ্গাকে তৎকালীন জিম্বাবুইয়ান তথ্যমন্ত্রী আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আঙ্কেল টম’ (যে কৃষ্ণাঙ্গ হীনমন্যতায় ভুগেন) আর ‘শ্বেতাঙ্গের মুখোশ পরা কৃষ্ণাঙ্গ’ হিসেবে। পরে অবশ্য এক ম্যাচের জন্য তাকে দলে নেয়া হয়েছিল এটা বুঝাতে, তার বাদ পড়াটা ‘রাজনৈতিক’ কোনো ব্যাপার ছিল না। সে বিশ্বকাপে সুপার সিক্সে উঠে জিম্বাবুয়ে। ওলোঙ্গা ও ফ্লাওয়ার, দুজনেরই শেষ ম্যাচ ছিল এটি। ওলোঙ্গা মৃত্যুঝুকি পেয়ে পরে চলে যান ইংল্যান্ডে। ফ্লাওয়ারও পরবর্তীতে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলা শুরু করেন। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার যাতে পান সফলতার দেখা, হন ইংল্যান্ডের কোচ।  

সম্পর্কিত ছবিইংল্যান্ডের হেড কোচ হিসেবে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। 

যে উদ্দেশ্যে এতখানি ঝুঁকি নিয়েছিলেন ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গা, তা সফলই হয়েছিল বলা যায়। সাধারণ জিম্বাবুইয়ানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ উদ্যোগ। পরবর্তীতে অনেক ম্যাচেই জিম্বাবুইয়ানরা এরকম কালো আর্মব্যান্ড পড়ে খেলা দেখতে আসেন।  

পরবর্তী পর্ব – ১৯৯৬ বিশ্বকাপ, ইডেন গার্ডেনের দাঙ্গা এবং উপমহাদেশীয়দের আবেগ। সাথেই থাকুন!