• ক্রিকেট

বিশ্বমঞ্চে প্রথম জয়:১৯৯৯

পোস্টটি ১৩৯৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৯৯৯ সাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এক অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকা বছর। পাশের দুই দেশ ভারত আর পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পর এদেশের ফুটবল পাগল মানুষগুলোকেও একটু একটু করে ছুঁতে শুরু করেছে ক্রিকেট নামক কেতাদুরস্তি এই সাহেবি খেলা। '৯৭ এ কুয়ালালামপুরে আকরাম খানের ওরা এগারো জন জায়গা করে নিয়েছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে। তারই ধারাবাহিকতায় '৯৯ এ ইংল্যান্ডে (সাথে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ড) আয়োজিত বিশ্বকাপে বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশ নামক নতুন এক দেশের আবির্ভাব ঘটে। সেই বিশ্বকাপেই ক্রিকেটের নতুন এই দেশটি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল তারা এখানে শুধু অংশগ্রহণ করে খালি হাতে ফিরে যেতে আসেনি। এসেছে কিছু নিয়ে যেতে। ছিনিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। '৯৯ এর বিশ্বকাপটা সবাই মনে রেখেছে বাংলাদেশের পাকিস্তান বধের গল্প দিয়ে। তবে সেটা ছিল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জয়। প্রথম জয়টা এসেছিল আরেক বিশ্বকাপ অভিষিক্ত দেশ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। আজকের গল্পটা সেই প্রথম জয়ের যেটা দ্বিতীয় জয়ের প্রতাপে অনেকটা তলিয়ে আছে। ২৪ মে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে স্বাগতিকদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার আগে দু'দলই গ্রুপ পর্বের দু'টি করে ম্যাচ হেরে এসেছিল। বাংলাদেশ হেরেছিল নিউজিল্যান্ড এবং ওয়েস্টইন্ডিজের বিপক্ষে অন্যদিকে স্কটল্যান্ড হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলতে আসা দু'দলই চাইছিল বিশ্বকাপের মত মঞ্চে নিজের প্রথম জয়ের স্বাদটা নিতে। তাই বড় দলের রোমাঞ্চকর ম্যাচগুলোর বাইরে এই ম্যাচটা ছিল অন্য রকম এক রোমাঞ্চের উৎস। বিশেষ করে স্কটল্যান্ডের জন্য তাদের নিজেদের দেশের মাটিতে প্রথম কোন বিশ্বকাপ ম্যাচের আয়োজন, তাই জয়টা যেন তাদের বেশিই দরকার ছিল। টসে জিতে প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় স্কটল্যান্ড। তাদের এই সিদ্ধান্তকে ঠিক প্রমাণিত করেই যেন ৩য় ওভারে কাধের উপরের বলে অনিয়ন্ত্রিত এক হুক শটে কিপারের পিছনে প্রথম স্লিপের হাতে ক্যাচ দিয়ে শুন্য রানে ফেরেন খালেদ মাসুদ। এরপর ৩ ওভার যেতে না যেতেই প্যাডের উপরের এক সহজ বলকে কবজির মোচড়ে ফ্লিক করতে গিয়ে লিডিং এজে ক্যাচ দিয়ে বসেন মেহরাব হোসেন। পরের ওভারেই আমিনুল ইসলাম পরেন এল বি ডব্লিউ এর ফাঁদে। স্কোরবোর্ডে তখন ১৩ রানে তিন উইকেট। অবস্থা এতটা নাজুক ছিল যে প্রথম বাউন্ডারি পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৯ম ওভার পর্যন্ত। ১১ ওভার যেতে যেতে আকরাম খান স্লিপে ক্যাচ দিয়ে এবং ফারুক আহমেদ প্লে ডাউনে বোল্ড হয়ে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়ে গেল ২৬ রানে ৫ উইকেট। অবশ্য আগের দুই ম্যাচেও বাংলাদেশের টপ অর্ডার এভাবেই ভেঙ্গে পড়েছিল। নিউজিল্যান্ডের সাথে ৫১ রানে ৭ উইকেট এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৫ রানে ৪ উইকেট এর মত অবস্থা থেকে বের হয়ে পর্যায়ক্রমে ১১৬ এবং ১৮২ রানের স্কোর দাঁড় করাতে পেরেছিল বাংলাদেশ। সেদিনও সাহস করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর দরকার ছিল কারো না কারো আর সেই কাজটা করেছিলেন নাইমুর রহমান এবং মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। নাইমুর রহমান আউট হওয়ার আগে ৬ষ্ঠ উইকেটের জন্য ৬৯ রানের অতিপ্রয়োজনীয় পার্টনারশিপে পালে কিছুটা বাতাস পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটাও বেশিক্ষন স্থায়ী হল না, পরের ওভারেই খালেদ মাহমুদ শুন্য রানে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সাজঘরে। তখনো একপাশে মিনহাজুল আবেদিন খেলে যাচ্ছিলেন এবং এনামুল হক ও হাসিবুল ইসলামকে সাথে নিয়ে যথাক্রমে ৩৭ রান এবং ৩১ রানের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপের মাধ্যমে দলের স্কোরকে নিয়ে গেলেন ৫০ ওভারে ১৬৪ রানে। শেষ পর্যন্ত ১১৬ বলে ৬ চারের সাহায্যে ৬৮ রানে অপরাজিত ছিলেন আবেদিন। বিশ্বকাপের মঞ্চে এই প্রথম বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ৫০ ওভার ব্যাটিং করল। বাংলাদেশের ইনিংসে ২৮ টি ওয়াইড সহ মোট ৪৪ রান এক্সট্রা উপহার দিয়েছিল স্কটল্যান্ড। জন ব্লেইন নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। স্কটল্যান্ডের সামনে জয়ের জন্য লক্ষ্য ছিল ১৬৫ রানের। কিন্তু সেই রান তাদেরকে করতে হত ১ ওভার কমে ৪৯ ওভারে। স্লো ওভার রেটের কারনে তাদেরকে এক ওভার ফাইন করলেন ম্যাচ রেফারি। তারচেয়েও বড় বিপদটা এল তাদের ইনিংসের দ্বিতীয় বলে। হাসিবুল হকের ইনসুইংগিং ইয়র্কার কিছু বুঝে উঠার আগেই আছড়ে পড়ল প্যাটারসনের প্যাডের গোড়ায়। এরপর পঞ্চম ওভারে আবার আঘাত হানলেন হাসিবুল হক। মাইক স্মিথকে খালেদ মাসুদের হাতে ১ রানে কট বিহাইন্ড করে স্কোরবোর্ড দাঁড় করালেন ৮ রানে ২ উইকেট। আরেক পেসার মনজুরুল ইসলামও বেশিক্ষন অপেক্ষা করালেন না, পরের ওভারেই স্কোরবোর্ডে কোন রান যোগ হবার আগেই ইয়ান ফিলিপসকে এলবি ডব্লিউ করে স্কটল্যান্ডের টপ অর্ডারকে ধ্বসয়ে দিলেন। এরপর স্ট্যাগান আর স্যালমন্ড ৪র্থ উইকেটে ২৯ রান যোগ করে কিছুটা মাটি খুঁজে পাচ্ছিলেন পায়ের তলায়। কিন্তু আবারো আঘাত হানলেন মনজুরুল ইসলাম। ফারুক আহমেদের হাতে ক্যাচ করিয়ে ফিরিয়ে দিলেন স্যালমন্ডকে। আর স্ট্যাগান এলবি ডব্লিউ হলেন মিনহাজুল আবেদিনের বলে।সেদিনের দিনটাই যেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর নামে লেখা ছিল। ২৭ ওভারের মধ্যে স্কটল্যান্ডের স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ৮৩ রানে ৬ উইকেট। স্কোরবোর্ড দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের জয় এখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তখনো বাংলাদেশের জয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন স্কটল্যান্ডের তারকা অলরাউন্ডার গেভিন হ্যামিলটন। সেই সময়ে কাউন্টি ক্রিকেট এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন হ্যামিলটন। তার উপর আশাও ছিল স্কটল্যান্ডের। সেই আশার প্রতিফলনও ঘটাতে শুরু করলেন বিপদের সময়ে। একাই খেলে যাচ্ছিলেন যেন। ২৬.৩ ওভারে ৮৩ রানে ৬ উইকেট থেকে এক সময় স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ৪১.২ ওভারে ১৩৮ রানে ৬ উইকেট। হ্যামিলটন খেলছিলে ৭০ বলে ৬৩ রানে। যেভাবে খেলছিলেন তাতে আর ৫ ওভার খেললেই ম্যাচ হয়ত জিতে জেতে পারত স্কটল্যান্ড। কিন্তু ভাগ্যদেবী হয়ত সেদিন কোনভাবেই স্কটল্যান্ডের সাথে ছিলেন না। ৪২ তম ওভারের ৩য় বলটিতে ঘটে যায় স্কটিস ক্রিকেটের আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় অঘটনটি। এলেক ডেভিসের স্ট্রেইট ড্রাইভ বোলার মনজুরুল ইসলামের আঙ্গুল ছুঁয়ে গিয়ে লাগে স্ট্যাম্পে এবং হ্যামিলটন তখন ক্রিজের বাইরে। ক্রিকেটের সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক আউটের শিকার হয়ে ফিরে যান হ্যামিলটন। সাথে সাথে মিলিয়ে যায় স্কটল্যান্ডের জয়ের আশাও। হ্যামিলটনের আউটের পর আর ফিরে আসতে পারেনি ম্যাচে। ৪৬.৩ ওভারে ১৬৩ রানে অলআউট হয়ে যায় স্কটল্যান্ড এবং বিশ্বদরবারে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ ২২ রানে। নিজের অসাধারন পারফরমেন্সের কারনে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন মিনহাজুল আবেদিন। হ্যামিলটনের সেই রান আউটকে এখনো স্কটিস ক্রিকেটের সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলোর একটা হিসেবে দেখা হয়। সেদিন ওভাবে রান আউট না হলে হয়ত ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের প্রথম জয়টা পেয়ে যেত স্কটল্যান্ড যেটা এখনো পর্যন্ত তাদের আর পাওয়া হয়নি। হয়ত সেই জয়ে বদলে যেতে পারত স্কটল্যান্ডের ক্রিকেট। কিন্তু সেটা হয়নি। ভাগ্যের পরিহাস কিংবা চরম অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটের সৌন্দর্য যাই বলা হোক না কেন সেটা ঘটে গিয়েছিল স্কটল্যান্ডের সাথে সেদিন। হ্যামিলটন অবশ্য পরে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে ইংল্যান্ড টেস্ট টিমে তার অভিষেকও হয়েছিল। ১৯৯৯ সালেই ২৫ নভেম্বরে তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ও একমাত্র টেস্টটি খেলেন। দূর্ভাগ্য বশত দু'ইনিংসেই এলান ডোনাল্ডের বলে শুন্য রানে আউট হন এবং বোলিংয়েও উইকেটশূন্য থাকেন। এরপর আর ইংল্যান্ডের হয়েও খেলা হয়নি তার। স্কটল্যান্ডের দূর্ভাগ্যের দিন হলেও বাংলাদেশের জন্য দিনটি ছিল ঐতিহাসিক। বিশ্বকাপের মত বিশাল মঞ্চে নিজেদের জিততে পারার ক্ষমতাটাকে বিশ্বাস করার জন্যই জয়টা খুব দরকার ছিল সেই নতুন দলটার। কি জানি সেই জয়টা না পেলে হয়ত পরের জয়গুলা আরো কত কঠিন হত কিংবা প্রলম্বিত হত! তবে সেটা হতে দেয়নি সেদিনের সেই এগারো জন। ব্যাটে বলে পুরো ম্যাচে বারবার হোঁচট খেয়েও বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বারবার ফিরে এসেছে ম্যাচে। সাথে ভাগ্যদেবীও মাঝে মাঝে বুলিয়ে দিয়েছেন মমতার হাত। হয়ত একারনেই বলা হয়  "Fortune favours the brave".