বিশ্বকাপ সালতামামি এবং অতঃপর
পোস্টটি ৩১৫৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
শেষ হল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। তো কেমন ছিল এ যাত্রা?? প্রথমেই বলে নেই শুরুর আগে আমার প্রেডিকশন ছিল আমরা ২ ম্যাচ জিতব। সেখানে ৩ টা ম্যাচ জিতলাম...
আমার হিসেবে ভাল হইসে বলা উচিত, তাই তো?
কিন্তু না। এবারের বিশ্বকাপ অভিযানকে আমি ব্যার্থ ই বলব।
কেন?
প্রথমত, আমরা কোন বড় কোন দলের সাথে বিন্দুমাত্রও ভাল খেলতে পারিনি। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে তো প্রথম ইনিংস পরেই খেলা শেষ!! ভারতের সাথে লড়াই বলবেন?? এটাকে আমি ঠিক লড়াই হিসেবে ধরি না। সাইফুদ্দিনের ওই ইনিংসটা জাস্ট ফ্লুক ছিল, এরচেয়ে বেশি কিছু না। এটলিস্ট জেতার মত তো না ই কারণ সব ব্যাটসম্যানরাই আউট হয়ে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৩৩৩ করাটাকে ভাল লড়াই বলছেন অনেকে। কিন্তু আমরা ব্যাটিং এর সময় একটা মুহুর্তেও জেতার মত অবস্থায় ছিলাম না। তাহলে সেটা লড়াই হল কেমনে!!!
মাঝারি দল নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা আর পাকিস্তানের সাথে একটা জয়, একটা মোটামুটি ফাইটিং এবং একটা বাজে হার।
শ্রীলংকা,আফগানিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে জয় আমাদের জন্য ফরজ। দুইটা ম্যাচ জিতসি, একটা বৃষ্টিতে গেসে-এতটুকুই...
এবার বলি আমার প্রেডিকশন এর পিছনের ঘটনা। গত বছর দুয়েক হয়ত আমরা অনেক ম্যাচ জিতসি। কিন্তু কাদের সাথে জিতসি?? সব ছোট দলের সাথে। বড় দলগুলোর সাথে খুব বেশী ম্যাচ খেলা হয়নি এবং যে কয়টা খেলেছি সবগুলাই হেরেছি... তো বড় দলগুলোর সাথে জিততে যে পারফরম্যান্স এর দরকার আমাদের সেরকম কোন পারফরম্যান্স ছিল না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ দর্শক সমর্থকদের ধারণা যে আমরা এখন বড় দল হয়ে যাচ্ছি!! জ্বি না, আমরা এখনো ঠিকভাবে মাঝারি মানের দলও হতে পারিনি- মানুন আর না মানুন এটাই বাস্তবতা!!
এর পিছনে বড় কারণ হল আমাদের বোলিং ইউনিট খুবই দূর্বল। এই বোলিং ইউনিট নিয়ে আমরা নিজেদের মাটিতে জিতে যাচ্ছি হয়ত এবং সেগুলোও কিন্তু ছোট এবং মাঝারি দলের সাথেই। নিজেদের মাটিতে আমরা ইংল্যান্ডের সাথে সিরিজ জিততে পারিনি। ইন্ডিয়ার সাথে একটা জিতে গিয়েছিলাম বটে, তবে ওই একটাই!! বলার মত আর কিছু নেই...
মাঝারি দলগুলোর সাথেও আমরা ওদের মাটিতে গিয়ে খুব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারিনি। বলা যায় বাজেভাবেই হেরেছি। তো বোলিং ইউনিটে উইকেট টেকার বোলার না আসলে আমরা আসলেই উন্নতি করতে পারব না।মুস্তাফিজের কথা বলবেন?? মুস্তাফিজ উইকেট নিচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু ওর পরিসংখ্যান ভুল ধারণা দিচ্ছে। সেটার ভাল উদাহরণ আজকের ম্যাচটাই আছে- আর বিস্তারিত কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমরা না প্রথমে উইকেট নিতে পারছি, না মাঝখানে!! শেষের উইকেট গুলা আসছে বিপক্ষ দলের রান তোলার তাড়নায়, এরচেয়ে বেশি কিছু না।
আর ব্যাটসম্যানও ওই পঞ্চপাণ্ডবের চারজনই। এই বিশ্বকাপেও এর ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি। টপ ফোর কন্ট্রিবিউটর এখানেও তারা ই। লিটন একটা ভাল খেলছে এই যা। কিন্তু আপনি শুধুমাত্র ব্যাটিং দিয়েই সব ম্যাচ জিততে পারবেন না। আপনি যদি আমাদের বিগত কয়েক বছরের পারফরম্যান্স দেখেন, সব সিরিজেই আমাদের খালি দুইজন ব্যাটসম্যান ই বেশিরভাগ রান করে। কখনো সেটা তামিম-মুশফিক, কখনো সাকিব-মুশফিক, কখনো তামিম-সাকিব। আর রিয়াদের একটা কন্ট্রিবিউশান থাকে।
বাকীদের হঠাৎ এক-দুইটা ভাল ইনিংস। ধারাবাহিক তেমন কেউ ই নেই...
তো এর জন্য আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট এবং ম্যানেজমেন্ট- দুইটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। নতুবা আমরা এই ছোট-মাঝারি দুষ্টচক্রেই ঘুরপাক খেতে থাকব। বোলিং ইউনিট নিয়েই কাজ করতে হবে অনেক বেশি। রুবেল- মোস্তাফিজকে ধারাবাহিক হওয়া শিখতে হবে। রুবেল এত এক্সপেরিয়েন্সড বোলার হওয়া সত্বেও এখনো ক্রিটিকাল মোমেন্টে ম্যাচ হারিয়ে দেয়!! গত বিশ্বকাপের সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ম্যাচেই কেবল ক্রিটিকাল মোমেন্টে ম্যাচ জেতাতে পেরেছে। কেউ আমাকে অন্য কোন পারফরম্যান্স বলতে পারলে খুশি হব। তবে আমি আর পাইনি। ফিজ আজকে ভাল করে তো কালকে আবার খারাপ। তারচেয়ে বড় কথা হল ইদানিং তার আলগা ডেলিভারির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এবং তূণে নতুন কিছু যোগ না হলে এমন সম্ভাবনাময় প্রতিভা অচিরেই শেষ হয়ে যাবে(অজান্তা মেন্ডিস-তার উদাহরণ)। তার পরিসংখ্যান খালি আপনাকে বিভ্রান্তি ই দিয়ে যাবে, তার বেশি কিছু না।
সাইফুদ্দিন এর বেলায়ও একই কথা। উইকেট পায় কিন্তু রান বিলিয়ে দেয়, যেটাতে আসলে দিনশেষে খুব একটা লাভ হয় না। তবে এই ছেলেটা ইয়র্কার দিতে পারে ভাল। এটাতে যদি সে নিজেকে বুমরার কাছাকাছি লেভেলে নিয়ে যেতে পারে তাহলে তারও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে।ডেথ বোলিং নিয়েও প্রচুর কাজ করতে হবে। আর পাটা পিচে, যেখানে বোলারদের জন্য কিছুই থাকে না সেইপিচে কিভাবে কার্যকর বোলিং করতে হয় তা রপ্ত করতে হবে। এছাড়াও আরো বোলার লাগবে, কারণ বোলাররা ইনজুরিতে পরবেই। কোয়ালিটি এটাক মানে আপনার যে ই থাকুক না কেন, সবাই ই উইকেট টেকার এবং একাদশের যোগ্য। যার ফর্ম থাকবে, সে একাদশে থাকবে। আর স্পিন নির্ভরতা আমরা যতদিন না বাদ দিচ্ছি ততদিন আমাদের এই দশাই থাকবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ফিল্ডিং নিয়ে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। ভাল ফিল্ডিং দিয়েও যে ম্যাচ জেতা যায় সেটা যতদিন আমরা বুঝব না, ততদিন এইরকম ই থেকে যাব। বড় দল আর হওয়া লাগবে না!!
তৃতীয়ত, আমাদের প্লেয়ারদের প্রফেশনাল হতে হবে-সাকিবের মত। সাকিব ছাড়া আমাদের দলে আর কোন প্রফেশনাল প্লেয়ার নেই। সবাই খুব আবেগী। এই আবেগ দূর না হলে আমাদের সেরাদের কাতারে কখনোই যাওয়া হবে না। শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়-শেওয়াগদের সময়ে ইন্ডিয়া কিন্তু ঠিক ততটা বড় দল ছিল না এখনকার মত। তার একমাত্র কারণ তখন তাদের বোলিং ইউনিট এবং ফিল্ডিং এখনের মত এত ভাল ছিল না এবং তারাও খুব বেশি প্রফেশনাল ছিল না। তাদের অতিরিক্ত লেভেলের ভাল ব্যাটসম্যান থাকায় তখন তারা ম্যাচ জিতত। কিন্তু এখন বিরাটা ছাড়া আর খুব বড় কোন ব্যাটসম্যান নেই। কিন্তু তাদের পুরো দলটাই এখন অনেক বেশি প্রফেশনাল। সেজন্যই এখন তারা বড় দল।
ব্যাটিং এও উন্নতির অনেক জায়গা আছে। যেমন কিভাবে আরো বেশী স্ট্রাইক রোটেট করা যায়, একরান নিতে গিয়ে বলকে যেন স্টাম্পে টেনে না আনে(এই বিশ্বকাপে এটা অনেক হয়েছে), রানিং বিটুইন দ্যা উইকেট কিভাবে আরো ভাল করা যায়, প্ল্যানিং কিভাবে আরো ভাল করা যায় যাতে করে সেট হয়ে বড় ইনিংস বের করে আনতে পারে এরকম আরো অনেক কিছু। তবে তামিম-সাকিব-মুশফিক নিযেদের ব্যাটিং অনেক উপরের লেভেলে নিয়ে যাওয়াতে বাকী ব্যাটসম্যানরাও সেখানে উঠতে চাইবে। কিন্তু বোলিং এ তেমন কেউ না থাকাতে কম্পিটিশনও হচ্ছে না, উপরের লেভেলেও যাওয়া হচ্ছে না!
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ৮ নং দল হয়ে শেষ করলেই আমি বরং বেশি খুশি হব (৮ এই শেষ হল, লেখাটা লেখার সময় ৭ এই ছিল)। তখন হয়ত নতুন করে ভাবার তাড়না আসবে। নতুবা আমি যথেষ্ট সন্দিহান!!
এই বিশ্বকাপে বরং পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা আমাদের চেয়ে বেশী ভাল করেছে। তাদের হয়ত ধারাবাহিকতা ছিল না কিন্তু তারা যেটা জিতেছে সেটা জিতেছে এবং যেটা হেরেছে সেটা হেরেছে। তারা বড় দলকেও হারিয়েছে যেটা আমরা পারিনি।আর আমরা ধারাবাহিক হয়ত ছিলাম কিন্তু যে ধারাবাহিকতা জেতার জন্য যথেষ্ট না, সেটা আবার কেমন ধারাবাহিকতা!!! কারণ, দিনশেষে হার হারই। জয়ী দলকেই সবাই মনে রাখে...
আরেকটা ভয়ংকর ব্যাপার হল পাবলিক হাইপ, যেটাকে আমাদের টীম ম্যানেজমেন্টও খুব গুরুত্ব সহকারে নেয়! লোকে অনেক কিছুই বলবে, অনেক দাবীও রাখবে। কিন্তু দলের এবং ম্যানেজমেন্ট এর সেসব পাত্তা দেওয়া মানেই সর্বনাশ ডেকে আনা। তামিম এবং সাইফুদ্দিন বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়েই বাইরের সমালোচনা গায়ে মাখিয়ে ফেলেছে। তাতে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিটাই বরং বেশী হয়েছে। মাশরাফির ক্ষেত্রেও মনে হয় কিছুটা হয়েছে। এই ব্যাপারে তারা সাকিবের সাহায্য নিতে পারে৷ এটা কাটিয়ে উঠতে না পারলে তামিমের ক্যারিয়ার হয়ত আগামী বিশ্বকাপের আগেই শেষ হয়ে যাবে!! আমাদের দর্শক সমর্থকদেরও খেলাকে খেলা হিসেবেই দেখতে হবে। এবারের কথা ই ধরূন। সবাই ধরেই নিয়েছে যে আমরা সেমিফাইনালে খেলব এবং অনেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়াও ধরে নিয়েছে। কারণ বাংলাদেশ এবার সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল এবং ওটাই বাংলাদেশের সেরা দল। কিন্তু অন্য দলগুলোর অবস্থাটাও তো দেখতে হবে, তাই না। যে দলের বোলিং এটাক খুবই দূর্বল সেই দল সেমিফাইনালে কিভাবে খেলবে? তাও আবার এই ফরম্যাটে। এই ফরম্যাটে ভাল দলের এবং বড় দলেরই সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাব্যতা বেশি। কারণ আপনাকে ধারাবাহিকতা ধরে রেখে জিততে হবে।
এখন থেকেই যদি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না করে তাহলে এবারের মতই হতাশ হতে হবে বারবার। মুখে না বলে কাজে কর্মেও প্রতিফলন দেখাতে হবে। বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড হয়েও আমরা যদি উপরে উঠতে না পারি তাহলে সেটা হতাশাজনকই হবে।
আশা রাখি বাংলাদেশ ক্রিকেট আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে। ভুল থেকে শিখতে হবে এবং শিখার প্রয়োগও ঘটাতে হবে। ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে আমরা এ আশা করতেই পারি...
- 0 মন্তব্য