রোনালদো ভার্সেস মিডিয়াঃ কেন এই দ্বন্দ্ব
পোস্টটি ৩৭৩৬ বার পঠিত হয়েছে
২৬ জুলাই, ২০১৯। সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া। প্রি-সিজন ফ্রেন্ডলি ম্যাচ চলছে জুভেন্টাসের সাথে ‘কে-লীগ অল স্টারস’-এর। একটু পরেই হাফ-টাইমের বাঁশি বাজবে। ডান প্রান্ত থেকে আক্রমণে বল গেল চেসিনহার পায়ে। ডি-বক্সের কিনারায় বাঁ-পায়ে শুট করলেন ব্রাজিল-বংশোদ্ভূত এই স্ট্রাইকার। দুর্দান্ত প্লেসিং-এ বল গোলকিপারের বাড়ানো হাত পেরিয়ে একেবারে টপ কর্ণারে! গোল! গোলের পর এক অদ্ভুত কান্ড করলেন তিনি। দুই সতীর্থকে সাথে নিয়ে কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আইকনিক সেলিব্রেশনটি করেন। অন ফিল্ড ক্যামেরা ক্লোজ-আপ করা হলো জুভেন্টাসের বেঞ্চে। কিন্তু রোনালদোর মুখভঙ্গি দেখে বিশেষ কিছু বোঝা গেল না।
এর পরের দিন এ-ব্যাপারে নিউজ করল ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড নিউজপেপার ‘ডেইলি স্টার’। মহা উৎসাহে তারা ঘোষণা দিল- মূলত রোনালদোকে বিদ্রূপ করতেই এরূপ সেলিব্রেশন করেন চেসিনহা। কিন্তু তাদের এই দাবি রাতারাতি উড়ে গেল ফ্যান-ফুটেজের কাছে। ওখানে দেখা গেল- গোল সেলিব্রেশনের পরেই চেসিনহা রোনালদোর দিকে নির্দেশ করে তার গোলটা উৎসর্গ করেন। এরপর জুভেন্টাস বেঞ্চের সামনে গিয়ে তাকে দুইবার কুর্নিশও করে আসেন। ম্যাচ শেষে রোনালদোর কাছ থেকে উপহার পাওয়া জার্সিটা তুলে ধরে ছবিও তুলে ফেলেন বেশ কয়েক খানা। এতসব ক্লু দিয়েও আটকানো গেল না ব্রিটেনের অষ্টম সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া নিউজপেপারটির সাংবাদিক মহোদয়কে।
এটা শুধুই সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ। ইন্টারনেট ঘাঁটলে মনে হবে- কিছু মিডিয়া বোধহয় সত্যি সত্যিই ‘এন্টি-রোনালদো ক্যাম্পেইন’ নামে কিছু একটা খুলে বসেছেন। কিন্তু কেন এই অন্তহীন ঘৃণার জগতে অসহায় আত্মাহুতি?
স্পোর্টিং লিসবন থেকে তরুণ রোনালদো ইউনাইটেডে আসেন ২০০৩ সালে। তার অবিশ্বাস্য ড্রিবলিং স্কিল আর বিদ্যুৎগতির স্প্রিন্টের মাধ্যমে আউট-এন্ড-আউট উইংগারের সংজ্ঞা নতুনভাবে লিখেছিলেন ইংলিশ ফুটবলে। ‘থিয়েটার অফ ড্রিমস’ এর দর্শকরা তাকে সাদরে গ্রহণ করলেও বিপক্ষের ডিফেন্ডার ও ফ্যানরা ভাবলেন- এই নতুন আপদ আবার কোত্থেকে এলো? তখনকার ক্ষীণকায় ওই রোনালদোর গতি সামলাতে না পেরে প্রিমিয়ার লিগের অভিজ্ঞ ডিফেন্ডাররা তাদের ঝুলি থেকে মারাত্মক সব ট্যাকল করতে লাগলেন। ফ্যানরাও বসে থাকল না। যতবার রোনালদো বল টাচ করত, ততবার তারা ব্যু দিয়ে তাদের ‘দায়িত্ব’ পালন করত। তবে এই অবস্থা খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও পর্যন্ত ব্রিটিশ মিডিয়া তার দিকে বিশেষ কোনও নজর দেয়নি। আরেক পর্তুগিজ মরিনহোকে সামলাতেই তারা অতিষ্ঠ তখন, নতুন কারো দিকে নজর দেয়ার সময় কই।
তবে সব হিসাব-নিকাশ বদলে গেল ২০০৬ বিশ্বকাপের পর। চলছে কোয়ার্টার ফাইনাল। ইংল্যান্ড বনাম পর্তুগাল। ইংল্যান্ডের গোল্ডেন জেনারেশন বনাম পর্তুগালের গোল্ডেন জেনারেশন। দুই জেনারেশনেরই তখন ছিল বিশ্বকাপ জেতার শেষ সুযোগ। গোল পেতে দুই দলই মরিয়া ছিল। অনেকগুলো গোলের সুযোগ পেলেও ‘রহস্যজনক’ কারণে কোনও পক্ষেই গোল হচ্ছিল না। কাঁহাতক আর সহ্য হয়? মেজাজ হারিয়ে ফেললেন তৎকালীন ইংলিশ ওয়ান্ডার বয় ওয়েন রুনি। পাড়া দিয়ে বসলেন পর্তুগিজ রিকার্ডো কারভালহোর পায়ে। আর যায় কোথায়, পর্তুগিজরা দেখল এ-ই সুযোগ, পড়িমড়ি করে ছুটে এসে রেফারিকে ঘিরে ধরল। রেফারি ইতস্তত করছিলেন। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে বেচারা রুনি। না হয় ভুলে একটা পাড়াই দিয়ে বসেছে, ঠ্যাং তো আর ভেঙ্গে দেয়নি। ঠিক তখনই ঘটনায় ক্লাইম্যাক্স হাজির। রুনির ইউনাইটেড টিমমেট রোনালদো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলেন। খুব মিনতি করে কি যেন বোঝালেন রেফারিকে। বিরক্ত হয়ে শেষমেষ রেফারি রুনিকে লাল কার্ড দেখিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এরপর রোনালদো পর্তুগিজ বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। হয়তো বোঝালেন- ‘জব ডান, বয়েজ’। সবশেষে টাইব্রেকারে ম্যাচ-উইনিং স্পটকিকটি লক্ষ্যভেদ করে ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দিয়ে কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠুকে দেন।
মূলত এই ঘটনার পরেই রোনালদো ইংল্যান্ডের ‘পাবলিক এনিমি নাম্বার ওয়ান’ বনে যান। লস এঞ্জেলেস টাইমস ওই সময় ইংলিশ মিডিয়া ও ফ্যানদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবেদন করে। তারা রোনালদোর চোখ টিপকে ‘the most analyzed wink in history’ বলে আখ্যা দেয়। বিবিসি এটাকে স্লো-মোশনে বারবার দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে- লাল কার্ডের ঘটনাটা পুরোটাই রোনালদো ও পর্তুগালের একটা ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছিল। একটা ট্যাবলয়েড রোনালদোকে ‘the world’s biggest winker’ আখ্যা দেয়, যেটার বাংলা করলে খুব বাজে একটা অর্থ দাঁড়ায়। আরেকটা ট্যাবলয়েড এত রাখঢাক না করে সরাসরি ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘অহংকারী’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়।
তবে সবাইকে ছাড়িয়ে যায় তৎকালীন ব্রিটেনের এক নম্বর নিউজপেপার ‘দি সান’। তারা একটি ডার্টবোর্ডের ওপর রোনালদোর মাথা বসিয়ে দেয়। বুল’স আই পজিশনে রোনালদোর টিপ্পনরত চোখটি বসিয়ে শিরোনাম করে ‘Give Ron one in the eye’। তারা এটাকে রোনালদোর প্রতি ইংলিশ ভক্তদের ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ বলে প্রচার করে। মূলত ইংলিশ মিডিয়ার এই নগ্ন অপপ্রচারের কারণেই রোনালদো কুখ্যাত ব্রিটিশ ফুটবল হুলিগানদের (দাঙ্গাবাজ সমর্থক) নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ইংল্যান্ড ছেড়ে নিজের প্রিয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার ব্যাপারেও জনসম্মুখে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে এলেক্স ফার্গুসন ও ইউনাইটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ ডেভিড গিল তাকে আশ্বস্ত করেন, ‘ইংলিশ ফ্যানরা যত গর্জে ঠিক তত বর্ষে না’।
ইংলিশ লিজেন্ডরাও বসে ছিলেন না। নিউক্যাসল ইউনাইটেডের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার এলান শিয়েরার ওয়েন রুনিকে পরামর্শ দেন, পারলে সে যেন রোনালদোর মুখে দু’এক ঘা বসিয়ে দেয়। বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডে ফেরার পর রোনালদোকে প্রায়ই চিঠির ভেতর সাদা পাউডার ভরে পাঠানো হত। ওগুলো ছিল মূলত ‘নকল এনথ্রাক্স’, যা ওই সময় হুমকি দেয়ার মাধ্যম হিসেবে সুপরিচিত ছিল। যে চোখ-টিপ নিয়ে এত কান্ড, সেটা নিয়ে পরবর্তীতে পর্তুগালের কোচ লুইজ ফেলিপে স্কলারি বলেন- আসলে মাঠের কোথায় পজিশন নিতে হবে সেটা জানতে পেরেছেন বলে আশ্বস্ত করতেই রোনালদোর ওই চোখ-টিপ। এর সাথে রুনির লাল কার্ডের কোনও সম্পর্ক ছিল না।
২০১২ সালে রোনালদোর একটি ‘অল এক্সেস’ ইন্টারভিউ নেয় বিখ্যাত নিউজ চ্যানেল CNN। ইন্টারভিউটি নেন CNN-এর স্পোর্টস এঙ্কর পেদ্রো পিন্টু। ইন্টারভিউ এর এক পর্যায়ে তিনি রোনালদোকে বলেন, ‘গত বছর আমি মোনাকোতে ‘ইউরোপিয়ান ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার এওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করি। তখন কিছু সহকর্মী সাংবাদিকদের সাথে কথা হয়। তারা জানান, তারা মেসিকে ভোট দিয়েছেন কারণ তারা মেসিকেই বেশি ‘পছন্দ’ করেন। এখানে কে ভালো খেলেছে সেটা নিয়ে তারা তেমন একটা মাথা ঘামাননি’।
মিডিয়াতে তেমন একটা জনপ্রিয় না হলেও সাধারণ ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় এক নম্বরে রোনালদো। আমেরিকার বাস্কেটবল লেজেন্ড লেব্রন জেমসকে পিছনে ফেলে ইএসপিএন এর গবেষণায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাথলেট হিসেবে নির্বাচিত হন। সার্চ স্কোর, এনডোর্সমেন্ট ডিল, সোশ্যাল মিডিয়া ফলোয়ার্স- এই তিনটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরিতে এই র্যাংকিংটি করা হয়। রোনালদোর এই বিপুল জনপ্রিয়তা ভোগ করছে তার স্পন্সররা। ফোর্বসের মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রোনালদোর সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টগুলো ব্যবহার করে তার স্পন্সররা প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের মতো কামিয়ে নিয়েছে। CNBC অনুসারে, ২০১৮ সালে রোনালদোর নেট ওয়ার্থ ছিল প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার।
মিডিয়ার প্রচারণায় রোনালদোর জনপ্রিয়তায় ভাটা না পড়লেও মাঝে মধ্যেই তাকে নিরাপত্তা সংশয়ে পড়তে হয়েছে। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ মিডিয়া রোনালদোকে কার্যত ব্রিটিশ হুলিগানদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই হুলিগানরা কতটা কুখ্যাত, তা ২০০৫ সালে এলাইজাহ উড ও চার্লি হুন্নাম অভিনীত ‘Green Street Hooligans’ মুভিতে হুবুহু চিত্রিত হয়েছিল। কিন্তু এত প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও রোনালদোরা কেন যেন থেমে থাকেন না। মাঠে প্রতিনিয়ত লড়াই করেন বিশালকায় ডিফেন্ডারদের সাথে, আর মাঠের বাইরে লড়েন মিডিয়ার রক্তচক্ষুর সামনে। মাদেইরার যে বাচ্চা ছেলেটি একসময় নতুন বুটের জন্য হাহাকার করত, সেই ছেলেটিকে হারাতে একটু বেশিই বেগ পেতে হবে।
- 0 মন্তব্য