• ক্রিকেট

তবু ঠিক হয় না

পোস্টটি ২৩১২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

               কিছু হার মেনে নেওয়া যায়না । কিন্তু না মেনেও উপায় থাকে না। টেস্টে আমরা এমন কোনো অভিজাত দলও নই যে হার মেনে নেওয়া আমাদের জন্য দুঃসাধ্য হবে। কিন্তু ম্যাচের হিসেবে তিন অঙ্কে পৌঁছোনোর পরও যখন দুই অঙ্কেও না পৌঁছোনো এক দলের কাছে হারতে হয় তখন মেনে নেওয়াটা কষ্টকরও। কিন্তু উপায় তো নেই। এই হার যেমন ক্রিকেটের কুলীনতম ফরম্যাটে আমাদের অবস্থানটা জানিয়ে দেয় তেমনি আমাদেরকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীনও করে দেয়। যেটা আমাদের দলের অনেক বেসিক থেকে বেসিকতম ধারণা নিয়ে ধন্দে ফেলে দেয় সকলকে ।

 

 

               শুরুটা না হয় পিচ দিয়েই করি। সাকিব আল হাসানের মতে তারা যেমন পিচ চাচ্ছিলেন তেমনটা তারা পান নি। তারা টার্নিং উইকেট চেয়েছিলেন কিন্তু দেখলেন উইকেট নাকি ফ্ল্যাট । তাই চার স্পিনার (!) নামিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তারা। যদি খুব একটা ভুল না হয়ে থাকি তাহলে ২৮ আগস্ট টিম ম্যানেজমেন্টের এক বৈঠকে এই টেস্টের স্কোয়াড চূড়ান্ত হয় এবং ঐদিনই সিদ্ধান্ত হয় যে কিরকম পিচ তারা চান। পাঠক আমি আবারও বলছি তারিখটা ভালো করে পড়ুন। ২৮ শে আগস্ট এই সিদ্ধান্ত হয়। টেস্ট শুরু হওয়ার কথা ৫ সেপ্টেম্বর । অর্থাৎ কিউরেটর আর গ্রাউন্ডসম্যানদেরকে মাত্র আটদিন সময় দেয়া হয় চট্টগ্রামের প্রচলিত ফ্ল্যাট ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটকে একদম টার্নিং উইকেটে পরিণত করতে। আট দিন। টিম ম্যানেজমেন্টে যারা ছিলেন তারা সকলেই বহুদিন থেকেই ক্রিকেটের সাথে যুক্ত। অন্তত তাদেরতো এটা বোঝা উচিত ছিল যে মাত্র আটদিনে একটা টেস্ট ম্যাচের উইকেট তৈরি করা সম্ভব নয়। তাহলে গলদটা সেই গোড়া থেকেই ছিল।

  

               ঠিকাছে নাহয় । তারা যেইরকম পিচ চেয়েছিলেন সেরকম না হয় তাদেরকে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন কিউরেটর। কিন্তু তাতেও কি তাদের খুব সমস্যা হওয়ার কথা? পিচ তো আর অস্কার পুরস্কার না যে ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কেউ কিছুই জানতে পারবে না। প্রতি দলই খেলা শুরুর আগের দিন পিচটা পর্যবেক্ষণ করে এবং সে অনুযায়ীই তারা দল সাজায়। তাহলে অবশ্যই তারাও ম্যাচের আগের দিন পিচটা দেখে নিয়েছিল। এবং এত বছরের ক্রিকেট খেলা থেকে তাদের তখনই বোঝার কথা যে পিচটা ফ্ল্যাট উইকেট। তাহলেও টার্নিং উইকেটের প্রস্তুতি নিয়ে দল সাজানোর যৌক্তিকতা কোথায়? নিজেদের চেনা মাঠ, যেখানে আমরা তখন পর্যন্ত টেস্টে অপরাজিত, সেই পিচটা পড়তে কি এতটাই ভুল হওয়া সম্ভব? যদি ধরেই নেই যে পিচ পড়তে ভুল হয়নি তাহলে চার স্পিনার নামানোর একটাই মানে । একটা মুখস্থ একাদশ। টিম ম্যানেজমেন্টের এটাই ঠিক করা ছিল যাই হোক এই একাদশই আমরা নামাব। মাঠে নামার পর আমাদের ক্রিকেটারদের প্রি-মেডিটেটেড ভাবে খেলার উদাহরণ অসংখ্য আছে। এখন না হয় মাঠে নামার আগেই প্রি-মেডিটেটেড হওয়ার উদাহরণও আমরা দেখে নিলাম।

 

               আরেকটা সমালোচনার জায়গা এই টেস্টে ছিল চার স্পিনার খেলানোর। কন্ডিশনের সুবিধা নেওয়ার জন্য নাকি এই প্ল্যান সাজানো। কিন্তু আসলেও কি তাই? সৌম্য সরকার যতই নিউজিল্যান্ডের সাথে ১৫০ রানের ইনিংস খেলুক, তার ব্যাটিং টেস্টের জন্য না এই দাবি প্রায় সকল বিশ্লষকের। লিটন দাশ এখন পর্যন্ত টেস্টে তার নামের প্রতি সুবিধা করতে পারেননি। মাহমুদুললাহ রিয়াদ অনেক বছর ধুকে ধুকে শেষে গত জিম্বাবুয়ে সিরিজ এবং নিউজিল্যান্ড সিরিজ বাদে তার টেস্ট ব্যাটিংও ব্যাখ্যাতীত। মোসাদ্দেক সৈকতের যথেষ্ট পটেনশিয়াল থাকলেও এবং তার পরিসংখ্যান তার হয়ে সাক্ষী দিলেও কখনো যথেষ্ট সুযোগের অভাব, কখনো যথেষ্ট সদ্ব্যবহারের অভাব তাকে টেস্টে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যাটসম্যান এখনো হতে দেয়নি। আবার বর্তমান সময়ে টেস্ট ফরম্যাটে আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান, অন্তত পরিসংখ্যানের বিচারে, তামিম ইকবাল অনুপস্থিত । এদিকে স্কোয়াডের সব পেসারদের তুলনায় মিরাজ, তাইজুল এবং নাঈমের ব্যাটিং যথেষ্ট প্রসিদ্ধ । 

               আবার চার স্পিনার খেলালেও এক তাইজুল বাদে কাউকেই লম্বা স্পেলে বল করতে দেখা যায়নি। তাইজুলই একমাত্র লম্বা স্পেলে ধারাবাহিক বল করেন এবং বিন্দুমাত্র বিস্ময়ের জায়গা না রেখে, তিনিই যথারীতি এই ম্যাচে আমাদের সেরা বোলার। বাকি সবার ক্ষেত্রে স্পেলের তিনটা ওভার ঠিকমতো করার পর চতুর্থ ওভার থেকেই লাইন-লেন্থ এবড়ো-থেবড়ো হয়ে যাওয়া দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে। এমনকি যেটা সত্য সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ মনোযোগ এবং একই সাথে ফিটনেসের অভাব। তাহলে এই চার স্পিনার নামানোর অর্থ কি কন্ডিশনের সুবিধা নেয়া যেটা ম্যাচের আগেই পিচ দেখে তাদের বুঝে যাওয়ার কথা যে এই পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বাধ্য, নাকি আমাদের ব্যাটিং এবং বোলিং ডিপার্টমেন্টের এই মিডিওক্রিটিটাকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে রাখা?

 

               আর ব্যাটসম্যানদের নিয়ে কোনো কথা না-ই বা বললাম। হয়তো একটা মাসিক ম্যাগাজিনের প্রয়োজন হবে সে ব্যাপারে লিখতে গেলে। কিন্তু কিছু উপলব্ধি এই টেস্ট থেকে আমার হয়েছে যেটা না লিখলেই নয়। সাকিব আল হাসানের চতুর্থ দিনের সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে তাকে কোনো পেসার না খেলানো নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে বলেন " তাদেরকে তো জায়গাটার যোগ্য হতে হবে। আমি তাদের পরিসংখ্যান ঘাটতে গিয়ে দেখি যে তাদের সকলের গড় ইকোনমি ৪.৪১। অর্থাৎ দিনে ৯০ ওভার বল করলে তারা রান দেবে চারশ। ম্যাচ থেকে তো আমরা প্রথম দিনই ছিটকে পড়লাম।" ব্যক্তিগতভাবে চার স্পিনার খেলানোর বিপক্ষে আমি কখনোই ছিলাম না। এখনো নই। কিন্তু কিছুটা দুর্ভাগ্য এবং কিছুটা দুঃখের মিশেলে গড়ে ওঠা একটা ধ্রুব সত্য আমাদের ক্রিকেটে এই যে আমাদের ফার্স্ট ক্লাস কাঠামো কখনোই আমাদের পেসারদেকে গড়ে উঠার জন্য বিশেষ সুবিধা করে দেয় না। তাই যদি তাদের উন্নতির প্রকৃত কোনো জায়গা থেকে থাকে তাহলে তা এই আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোই। সেই সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা আমাদের ক্রিকেটের জন্য কখনোই সুখকর নয়। বিদেশের মাটিতে তাদের অসহায় আর্তনাদে দিনজুড়ে হাপিত্যেশ করা সে কথাই বলে।

 

               শেষ একটা কথা বলি। এই টেস্টে আমাদের সেরা বোলার নিঃসন্দেহেই তাইজুল। ব্যাটিংয়ে কোনো পজিটিভ কিছু না থাকলেও যাদের মধ্যে মাটি কামড়ে ক্রিজে থাকার প্রণতা ছিল এবং যারা দুই ইনিংসে সবচেয়ে বেশি বল খেলেছে তারা হল প্রথম ইনিংসে মুমিনুল এবং দ্বিতীয় ইনিংসে সাদমান। যে তিনজনের নাম বললাম তারা তিনজনই আমাদের টেস্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে খ্যাত । এই ফ্যাক্টটা যদি আমাদের টিম ম্যানেজমেন্টকে টেস্টের জন্য আলাদাভাবে একটি স্কোয়াড গঠনে উৎসাহিত না করে, আমার জানা নেই অন্য কি করতে পারবে। তখন আমাদের এটাই মেনে নিতে হবে ১৯ বছর টেস্ট ক্রিকেট খেলার পরেও টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের অপরিপক্বতা শুধুমাত্র চার স্পিনার বা কোনো পেসার না খেলানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই।