ভিন্ন পথের দুই পথিক
পোস্টটি ৩২০৩ বার পঠিত হয়েছেসবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লীগের কথা বললে অবশ্যই এবং খুবই স্বাভাবিকভাবেই প্রিমিয়ার লীগের নামটাই সবার উপরে থাকবে। দিনশেষে যে লীগের নিষ্পত্তি হয় শেষ ম্যাচের ৯৩তম মিনিটে তখন এ বিতর্কে ওদের পিছিয়ে রাখা দায়। কিন্ত গত কয়েক মৌসুমের চিত্রপট কিছুটা ভিন্ন হিসেবেই দর্শনীয়। যেখানে ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটি ১৯ পয়েন্টের ব্যবধানে লীগ জেতে। আর গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটি ৯৮ পয়েন্ট এবং লিভারপুল পায় ৯৭ পয়েন্ট। যেখানে তৃতীয় দল হিসেবে টটেনহ্যামের পয়েন্ট ছিল মাত্র ৭০। এই একপেশে প্রিমিয়ার লীগের কারিগর বলা যায় দুজনকেই। অন্তত আমি তাই বলব। পেপ গার্দিওলা ও ইয়ুর্গেন ক্লপ। কিন্তু কিভাবে এই বিবর্তন?
বড় থেকে ছোট, নামী দামী থেকে কমদামী, লীগ লিডার থেকে রেলেগেশনে থাকা সব দলের মধ্যেই একটি অত্যাবশ্যক প্রবণতা মোটা দামে ফরোয়ার্ড বা মিডফিল্ডার কেনার প্রতি। যার অন্যতম কিছু উদাহরণ হতে পারে রিয়াল মাদ্রিদ, পিএসজি, এমনকি বার্সেলোনাও তাদের গত দু-তিন মৌসুমের ট্রান্সফারগুলোর দরুন এই তালিকায় যুক্ত হয়। ম্যানচেস্টার। ইউনাইটেডের ১২০ মিলিয়নে পগবাকে কেনা, জুভেন্টাসের ৩৪ বছরের যুবক রোনালদোকে ১০০ মিলিয়নে কেনা, পিএসজির ৪০০ মিলিয়নের কাছাকাছি খরচে নেইমার ও এমবাপ্পেকে কেনা, বার্সেলোনার ৩০০ মিলিয়নের উপরে খরচ করে কৌতিনহো বা ডেম্বেলেকে কেনা অথবা নাছোড়বান্দার মতো নেইমারকে দলে ফেরাতে চাওয়া । এই ঘটনাগুলোই উল্লেখ করে যে সব দলই তাদেরকে উন্নত করার পূর্বশর্ত হিসেবে যেকোনোভাবেই হোক কোনো ঝলক দেখানো, ডিফেন্ডারদের চোখ ঝলসানো স্কিল সম্পন্ন ফরোয়ার্ডদের বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের কেনা। এমনকি এই ধারণা এখন ফুটবল সংগঠক থেকে গবেষক , বিশ্লেষক বা সমর্থক সবারই । তাই যখনই তারা কোনো দলকে একটা ডিফেন্ডারের পেছনে মোটা অঙ্ক ঢালতে দেখে তখনই সমালোচনার তীর বা কটুক্তির বাণ কোনোটাই ছুড়তে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা থাকে না। কিন্তু দুজন মানুষ হয়তো অন্যভাবে ভাবেন। তাই তাদের দলের লেভেলও এখন অন্যদের থেকে অনন্য উচ্চতায়।
প্রিমিয়ার লীগে নিজের প্রথম মৌসুমের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে পেপ গার্দিওলা সংবাদমাধ্যমে বলেন, "আমার ফুলব্যাকদের বয়স অনেক বেশি।" খুব একটা ভুলও ছিল না তার কথায়। পাবলো জাবালেতা, বাকারে সাগনা, গায়েল ক্লিশি, আলেক্সান্দার কোলারভ সবার বয়সই যে ত্রিশের ভুল অর্ধে ঘোরাফেরা করছিল। তখনই তার পরবর্তী ট্রান্সফার প্ল্যান নিয়ে ধারণা হয়ে যায় সবার । কিন্তু যে ধারণা সবার ছিল না তাহল তিনি সে জন্য কতটুকু মরিয়া । তবে তা জানার জন্য মাত্র দুই মাসেরই অপেক্ষা যথেষ্ট ছিল। পঞ্চাশ মিলিয়নের বিনিময়ে দলে আনেন কাইল ওয়াকার আর ষাট মিলিয়নের বিনিময়ে আনেন বেঞ্জামিন মেন্ডিকে। এরপরের জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোতেই পঁয়ষট্টি মিলিয়নে নিয়ে আসেন সেন্টার-ব্যাক আয়মেরিক লাপোর্তেকে। এছাড়া পঁয়ত্রিশ মিলিয়নে গোলকিপার এডারসনকে তো আনেনই। মাঠের বিপরীত অর্ধে এত টাকা ঢালা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও কম হয় না পণ্ডিতদের মাঝে । কিন্তু গার্দিওলা তার নীতিতে থাকেন অটল। ফলাফল? পরের দুই মৌসুম মিলিয়ে লীগ ১৯৮ পয়েন্ট এবং গোলগড় যথাক্রমে ৭৯ ও ৭২। চ্যাম্পিয়নস লীগেও টানা দুইবার কোয়ার্টার ফাইনাল, যা ভাগ্য খানিক সহায় থাকলে হয়তো আরও সমৃদ্ধ হত। এছাড়াও গত মৌসুমে ঘরোয়া ট্রেবল জয়। আর এসবই ছিল ওই ভিন্নভাবে চিন্তা করার ফসল। এমনকি এই মৌসমেও তার দুটি সাইনিং রাইট-ব্যাক হোয়াও ক্যানসেলো ৫০ মিলিয়নে এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি ৭০ মিলিয়নে ।
ইয়ুর্গেন ক্লপ হয়তো অত তাড়াতাড়ি পারেননি । কিন্তু ঠিক রাস্তাটা তিনিও চিনেছিলেন । তাই ভার্জিল ভ্যান ডাইককে, যিনি কিনা পরবর্তীতে উয়েফার বর্ষসেরা ফুটবলার হন এবং যাকে কিনা সাউদাম্পটন নাছোড়বান্দা ছিল না ছাড়ার ব্যাপারে, ছয় মাস অপেক্ষা করে হলেও ৭৫ মিলিয়নের বিনিময়ে দলে ভেড়ান। পরের মৌসুমে গোলকিপার অ্যালিসনকে নিয়ে আসেন ৮০ মিলিয়নের বিনিময়ে । এবং স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এক ঝাঁপি সমালোচনা । কিন্তু তিনিও থোড়াই কেয়ার করেন। আর তার ফল হিসেবে যে লিভারপুল গত ১২ বছর ঠিকমতো চ্যাম্পিয়নস লীগে জায়গাই করতে পারত না তারাই টানা দুইবার চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনাল খেলল যার মধ্যে একবার চ্যাম্পিয়নও। শুধু তাই নয়। গত মৌসুমে ৯৭ পয়েন্ট নিয়ে এবং মাত্র একটি ম্যাচ হেরে ৬৮ গোলগড় নিয়ে লীগ শেষ করেন । একটি অর্জন, যা ১৯৯২ থেকে প্রিমিয়ার লীগের পথচলা শুরু হবার পর থেকে যেকোনো মৌসুমে তার হাতে ট্রফিটা তুলে দিত শুধুমাত্র গত মৌসুম বাদে, যেখানে তাকে এমন একজনের সামনে পড়তে হয় যিনি হয়তো তার কৌশল তার চেয়েও ভালোভাবে রপ্ত করে প্রয়োগ করেন ।
কথায় বলে ভালো আক্রমণ আপনাকে ম্যাচ জেতাবে আর ভালো রক্ষণ ট্রফি। নীতি কথা হিসেবে সবাই তা আওড়ালেও প্রকৃতপক্ষে হয়তো তা মানেন এই দুজনই। তাই যখন ডিফেন্ডারদের এত আকাশচুম্বী (অন্তত সমালোচকদের দৃষ্টিতে) দাম দেখে বিদ্রূপের পাত্র হবার পরও তাদের ভাবান্তর হয় না। সবাই যখন বলে ৮০ মিলিয়ন একজন গোলরক্ষকের পেছনে বা একজন ডিফেন্ডারের জন্য খরচের মানে কি যেখানে উন্নতমানের স্ট্রাইকার তুমি পাবে এই দামে, তখন তাদের উত্তর হয় দলের উন্নতিই প্রধান লক্ষ্য । আমার দলের উন্নতিতে যদি আমার ৮০ মিলিয়ন খরচ করতে হয় এবং একজন স্ট্রাইকারের চেয়ে ওই দাম দিয়ে একজন রাইটব্যাক কিনলে আমার দলের উন্নতি বেশি হবে তবে ওই ৮০ মিলিয়ন আমি ওভাবেই খরচ করব। এবং এভাবে করেই তারা দুজন তাদের দলকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যান যেখানে এখন চ্যাম্পিয়নস লীগের জন্য তাদেরই ফেভারিট ধরা হয়। আর লীগের মাত্র পাঁচটা ম্যাচ হলেও এখনই সবাই বলে দিতে পারে কোন দুটো টিমের মধ্যেই লীগ ট্রফিটা অবশ্যই এবং অতি অবশ্যই থাকবে । এবং এসবই হয় তাদের ওই ভিন্ন পথ অনুসরণের জন্য।
- 0 মন্তব্য