• ফুটবল

আর কত??????.......

পোস্টটি ২৭৭৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

               ইশ্! দিনগুলো কত ভালই না ছিল। গ্যালারীতে তিল ধারণের জায়গাটুকুও পাওয়া যেত না, আবাহনী-মোহামেডানের খেলার সময় পুরো দেশ দু'ভাগ হয়ে যেত, চায়ের টংগুলোয় মানুষের ভিড় জমত, প্রিয় দল জিতলে রাস্তায় মিছিল বের হত। 

     এরকম অনেক হা-হুতাশের কথা আমরা শুনতে পাই যখন এদেশের ফুটবল আমাদের আলোচনার খোরাক হয়। ক্লাব ফুটবলের সোনালী দিনগুলোর চাকচিক্য যেমন জ্বলজ্বল করে উঠে, তেমনি এখনকার ফুটবলের ভরাডুবির পেছনে ক্লাব ফুটবলের সেই চকচকে জনপ্রিয়তায় মরচে পড়ে যাওয়াকেই দায়ী করে। অনেক সময় দর্শকদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় নিজের দেশের ফুটবলের খোঁজখবর না নেওয়ায়, মাতামাতিতে পিছিয়ে থাকায়। কিন্তু আসলেই দর্শকদের কাছে সে সুযোগ কতটা?

 

 

               বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল টুর্নামেন্টগুলো নিয়ে ভক্তদের মাতামাতি কম থাকলেও এই ক্লাবগুলোই যখন বহুজাতিক কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে যায় তখন সমর্থনের কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। গতকাল শেষ হওয়া শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ টুর্নামেন্টের তিনটি আসর যার প্রমাণ। আবার এরকম সমর্থনের দেখা মেলে যখন আবাহনী এএফসি চ্যাম্পিয়নশীপের বাছাইপর্বে যায় অথবা শেখ জামাল ভূটানের কিংস কাপ এবং কোলকাতার আইএফএ শিল্ড মাতিয়ে আসে। 

 

 

               কিন্ত গলদ তো কিছু থেকেই যায়। চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের ২৫ হাজার ধারণ ক্ষমতার গ্যালারী প্রায় পুরোটাই দর্শকে গিজগিজ করে এই টুর্নামেন্টে তাদের প্রতিটি ম্যাচেই। গলা ফাটানো চিৎকার, ভুভুজেলার ঝংকার, সবটা দিয়েই তারা তাদের ঘরের প্রিয় ক্লাবটিকে সমর্থন জানায়। সে জায়গাতে কোনো কমতি ছিল না তাদের । কিন্তু শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আবাহনী ফাইনালে হেরে যাওয়ায় তাদের প্রাপ্তি পুরোটা থাকল না। এটুকু তো আমরা সবাই জানি।

      কিন্তু ধরুন দৃশ্যপটটা ভিন্ন। চট্টগ্রাম আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়েই গেল। তখন দর্শকদের চিৎকারে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের ডেসিবল লেভেল হয়ত তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ হত। এই গগনবিদারী সমর্থনের মধ্য ট্রফিটা কে উঁচিয়ে ধরত? জামাল ভূঁইয়া। তারা নিজেদের ধন্য মনে করত এরকম একটি মূহুর্তের সাক্ষী হতে পেরে। তারপর?

কিছুদিন পর যখন বাংলাদেশের ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলো শুরু হবে তখন এই জামাল ভূঁইয়াকেই তারা দেখবে সাইফ স্পোর্টিংয়ের হয়ে মাঠ মাতাতে। জামাল ভূঁইয়া তো দিনশেষে তাদেরই খেলোয়াড়। চট্টগ্রাম আবহনীতে শুধুমাত্র এই টুর্নামেন্টের জন্য সে ধারে এসেছিল। এ অবস্থায় সমর্থকদের মনের অবস্থাটা একটা ভাবনার খোরাক জোগায়। মাত্র এক মাস আগেই যার হাতে ট্রফি দেখে এই ক্লাবটাকে সাপোর্ট করার সার্থকতা এই মানুষগুলো খুঁজে পেয়েছিল আজ তার বিপক্ষেই সমর্থন দিতে হচ্ছে। 

এবং এটা একটি খুবই পরিচিত দৃশ্য বাংলাদেশের ফুটবলে। যখনই কোনো দল বিদেশে বহুজাতিক টুর্নামেন্ট বা এশিয়ান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যায় তখনই অন্য দলগুলো থেকে প্রয়োজনমতো ফুটবলার ধারে দলে ভিড়িয়ে নেয়।  

 

 

               একটা দর্শক কখন কোনো দলের প্রতি টান অনুভব করে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তরটা হল প্রিয় খেলোয়াড় সেই দলে খেললে। বার্সেলোনার ফ্যানদের ক্ষেত্রে যা মেসি, রিয়াল মাদ্রিদ ফ্যানদের ক্ষেত্রে রোনালদো, লিভারপুলের ক্ষেত্রে জেরার্ড ইউনাইটেডের ফ্যানদের ক্ষেত্রে তা রুনি বা তারো আগে গিগস, স্কোলস অথবা অ্যালেক্স ফার্গুসন । মোট কথা একটি বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই একটা ক্লাবের প্রতি সমর্থন শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য তো এরকম কেউ নাই। 

 

 

               একটু আগেই যে জামাল ভূঁইয়ার প্রসঙ্গটা আনলাম তা এ কারণেই । তিনি এখন আমাদের ফুটবলের সবচেয়ে বড় আইকন। তাঁর সমর্থনে এখন পুরো দেশ। তাই তার ক্লাবকেও এখন পুরো দেশ সাপোর্ট করতে পারত । কিন্তু সাইফ স্পোর্টিংয়ে থাকা অবস্থাতেই তিনি একটি টুর্নামেন্টের জন্য চট্টগ্রাম আবাহনীর জার্সি গায়ে দিলেন। এর আগেও তিনি শেখ জামাল, শেখ রাসেল সহ বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন। তাঁর আগের আইকন মামুনুল ইসলামের ক্ষেত্রেও তো তা বলা যায়। তিনি শেখ জামালের হয়েও ট্রেবল জয় করেন, শেখ রাসেলের হয়েও। এখন তিনি আবাহনীতে। একসময় দেশের ফুটবলের সবচেয়ে পরিচিত মুখ জাহিদ হাসান এমিলিও তো তাই। তিনি আবাহনী, মোহামেডান, শেখ রাসেল, চট্টগ্রাম আবাহনী সব ঘুরে এখন আবার মোহামেডানে। এমনকি এক সময় এমনও কথা উঠত যে প্লেয়াররা সবাই ঝাঁকের কই হয়ে থাকতে চাইত। তারা প্রতিযোগিতা ভয় পেত। তাই জাতীয় দলের অধিকাংশই এক সাথে খেলতে চাইত। ফলে এক একজন দলবদল করতে চাইলে সকলেই একসাথে চলে যেত। এই মৌসুমের কথাই ধরি। ঢাকা আবাহনীর সেন্টার-ব্যাক তপু বর্মন এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আতিকুল ইসলাম ফাহাদ দুজনেই গত মৌসুমে ঢাকা আবাহনীর সাফল্যের পেছনে অনেক প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। কিন্ত এবার দুজনেই বসুন্ধরা কিংসে পাড়ি জমায়। গত মৌসুমের মাঠের খেলা দেখে ধারণা করা যায় বাংলাদেশ ফুটবলের পরবর্তী দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী হবে এই দুই ক্লাব। তাহলে এক বছরেই এরকম দলবদল কি সমর্থকদের মনে ভালো কিছুর প্রভাব ফেলে?

 

 

               দোষটা আসলে এদেশের ফুটবল সংস্কৃতিতেই। প্রায় সব খেলোয়াড়ই একটি দলের সাথে মাত্র এক মৌসুমের চুক্তি করে। যাতে তারা পরবর্তী মৌসুমে ফ্রি এজেন্ট হয়ে যায় এবং আরো বড় অঙ্কের কোনো চুক্তি পেলে তা সাথে সাথে লুফে নিতে পারে। এতে করে ফুটবলারদেরও ক্লাবের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হয় না আবার অন্য ক্লাবগুলোরও খেলোয়াড়দের প্রস্তাব দিতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হয় না। এতে করে আমাদের ফুটবলারদের ক্লাবের প্রতি লয়্যালটি ব্যাপারটা নেই বললেই চলে। আবার আরেকভাবে সম্ভব ছিল এই লয়্যালটি গড়ে তোলার। আর তাহল যদি ফুটবলারদের ছোটবেলা থেকেই ফুটবল শিক্ষাটা কোনো ক্লাব দিতে পারত। এতে করে দীর্ঘদিন ক্লাবের সাথে গাঁথা বাঁধনটি ছিঁড়ে দিতে তাদের অন্তত দু'বার হলেও ভাবতে হত। কিন্তু হায়রে পোড়া কপাল! তিন-চারটি ক্লাব বাদে তো কারো কোনো একাডেমিই নেই। তাহলে এই ক্রন্দন আমি কার কাছে করছি? মজার বিষয় কি। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের চট্টগ্রাম আবাহনীর প্রতি সমর্থন দেখে সবাই বিমোহিত। কিন্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গত মৌসুমে চট্টগ্রাম আবাহনী এমএ আজিজ স্টেডিয়ামকে হোম গ্রাউন্ড না করে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে আপন করে। এমনকি চট্টগ্রামের মাটিতে চট্টগ্রামের টিম থেকে ঢাকার কোনো দল কখনো পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে পারেনি এই পরিসংখ্যানও তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎসাহ জোগাতে পারেনি।

 

 

               জামাল ভূঁইয়ার ভক্ত এখন পুরো দেশ। তিনি যদি তাঁর ক্যারিয়ারের যে পাঁচ-ছয়টা শ্রেষ্ঠ বছর বাকি আছে তা সাইফ স্পোর্টসের সাথেই কাটিয়ে দেন তাহলে নিঃসন্দেহে সাইফ স্পোর্টস দেশের অন্যতম বড় ফ্যানবেসের হকদার হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতের সাথে গোল করে সাদ উদ্দিন এখন কোটি হৃদয়ের নায়ক। তিনি যদি ঢাকা আবাহনীতেই তার ক্যারিয়ারের লম্বা সময় কাটান তাহলে এই আবাহনীও কোটি হৃদয় দখল করে নেয়। কিন্তু তা যেন হবার নয়। এমন নয় যে তাদের সামনে কোনো উদাহরণ নেই। আবাহনীর ওয়ালি ফয়সাল এবং প্রাণতোষ রায় প্রায় দশ বছরের উপরে ক্লাবটির সেবায় নিয়োজিত । কিন্তু কেও তাদের দেখে কেন যেন উদ্বুদ্ধ হয় না। এ অবস্থায় দর্শকরা কেনই বা মাঠে যাবে আর কেনইবা কোনো দলকে সমর্থন জানাবে। তাই সংশ্লিষ্ট বোর্ড ও ক্লাব কর্তৃপক্ষ , পুরো দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমি আমার এই লেখায় মিনতি করছি। দয়া করে ফুটবলের এই ভালোর জন্য নিয়মগুলোর পরিবর্তন আনুন। নির্ধারিত সময়ের বাইরে দলবদল নিষিদ্ধ করুন দরকার পড়লে। দরকার পড়লে ক্লাবের সাথে অন্তত তিন বছরের চুক্তি করা বাধ্যতামূলক করে দিন। দরকার হলে সব ক্লাবের একাডেমী বাধ্যতামূলক করুন। কিন্তু ফুটবলে যখন নতুন আশার কিরণ উঁকি দিচ্ছে তখন এই বেসিক একটা ভুলের জন্য অন্ধকার সে কিরণকে গ্রাস করে নিবে তা এদেশের ফুটবলপ্রেমীরা কখনোই মেনে নিতে পারবে না।