বিশের বারান্দায় উনিশের ইতিহাস
পোস্টটি ১১১১ বার পঠিত হয়েছেপ্রতিদিন বাংলার পূর্ব আকাশে যখন সূর্য মামার রথের আগমন ঘটে ঠিক তখনই বাঙালি কর্তাদের মনে উঁকিঝুঁকি মারে হাজারও চিন্তা। এদের সকালটা শুরু হয় কাঁচাবাজারে সবজির দাম বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে।সকালের খবরের কাগটাও বয়ে আনে দেশময় ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা ও ধর্ষণের সংবাদ।ক্লান্ত দুপুরে শরীরটা যখনই একটু ঝিমিয়ে আসে তখনই বসের ঝাড়ি। নিয়নের আলোস্নাত সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরা তখন মস্তিষ্কের নিউরনে আলোড়ন তোলে মাসের বাকি দিনগুলো কোনোমতে চালিয়ে নেওয়ার হিসাব-নিকাশ। এত এত দুঃসংবাদ, দুঃশ্চিতা কিংবা অশান্তির মধ্যে 'জীবনানন্দের বনলতা সেন' হয়ে প্রশান্তি দেয় চর্ম গোলক ও উইলো কাঠের ক্রিকেট। বাংলাদেশের হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোর শেষে একপ্রস্ত গালাগাল করে 'ধুর আর খেলাই দেখবো না' নামক অভিমান বাক্যটা পরের ম্যাচে লাল-সবুজ জার্সীধারীরা মাঠে নামতেই কর্পূরের মতো উবে যায়।ভারত মহাসাগরের এককূলে বড়রা যখন অন্ধকারের চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ঠিক তখনই ভারত মহাসাগরের তীর ঘেষে গড়ে ওঠা অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফ্রিকায় আলোকবর্তিকা হাতে উদ্ভাসিত হওয়ার পণ ছোটদের। শুরু হয় দুই প্রতিবেশীর লড়াই।চায়ের দোকান থেকে বঙ্গভবন, বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ড্রয়িংরুম থেকে টিএসসি সমগ্র দেশ বোকা বাক্সের সামনে বসে।মা-বোনেদেরও আজ আর সিরিয়াল দেখার তাড়া নেই।হিন্দু-মুসলমান,বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্মের সকল মতকে সরিয়ে রেখে সবার প্রার্থণায় শুধুই বাংলাদেশ।
শুরুতেই ভারতীয়দের ভরকে দেওয়ার চেষ্টা সাকিব-শরিফুলের।চেষ্টায় সফলও হন তারা।প্রথম ১০ ওভারে ভারতের সংগ্রহ মাত্র ২৩ উল্টো অভিষেকের শিকার সাক্সেনা।২য় উইকেটে গুছিয়ে ওঠার চেষ্টা শচীন-কোহলিদের উত্তরসূরীদের। এবার আঘাত হানলেন সাকিব, ৯৪ রানের জুটি ভেঙে ম্যাচে ফেরান বাংলাদেশকে।গার্গকে দ্রুতই চুপ করিয়ে দেন রকিবুল। কিন্তু চুপ করানো যাচ্ছিলো নাহ পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ ব্যাটিং করা জয়সোয়ালকে।ব্যাক্তিগত ৮৮ রানে তাকে পকেটে পুরে ফেলেন শরিফুল। পরের বলে বীরকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলে নিজের বীরত্ব জাহির করেন শরিফুল। শেষ ২১ রানে চোখের পলকে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে ১৭৭ এ বেঁধে ফেলার কাজটা করেন বলাররা।অভিষেক ৩টি,শরিফুল ২টি, সাকিব ২টি ও রকিবুল ১টি উইকেট লাভ করেন।বাংলাদেশী বলাররা কতটা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছে তা বোঝানোর জন্য ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি।ভারতীয় ইনিংসের ১ম ৩৬ ওভারের মধ্যে প্রায় ২১ ওভারই(১২৫ বল) ডট!সবমিলিয়ে ২৮৪ বলের ১৬৯ টিই ডট!১৭৮ রানের টার্গেটে নামে নীল সন্ধ্যা। তামিম-ইমনের ব্যাটিংয়ে লক্ষ্যটাকে আরও মামুলি মনে হয়। এরপরে ঝড়।না বঙ্গোপসাগর কিংবা ভারত মহাসাগরের কোনো ঝড় নয়।এ ঝড়ের নাম বিষ্ণুয়।যার ৩৫ মিনিটের তান্ডবে টালমাটালে টাইগার শিবির।মাত্র ১৫ রানের ব্যবধানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডের জবুথবু অবস্থা। যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন দলপতির। অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করে চোট নিয়ে ফিরে যান ইমন।কিন্তু কান্ডারী হুশিয়ার। দলীয় ৮৫ রানে ফিরে যান শামীম। তখনও দরকার ৯৩ রান। ধারাভাষ্যকার ডেপি ডুমিনির ভাষায় যে ৯৩ রান তোলা অন্যান্য সময়ের ১৫০ এর থেকেও বেশী কষ্টসাধ্য। দলীয় ১০২ রানে ফিরে যান অভিষেক, পরাজয় চোখ রাঙাতে শুরু করে।কিন্তু কাপ্তান অবিচল, তার মন্ত্র একটাই, "তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবোরে"....
আহত পা টাকে টেনে নিয়ে ফিরে আসেন ইমন।পা হরকালো আরও একবার। ইমন যখন ব্যক্তিগত ৪৭ রানে ফিরে যান তখন দল জয় থেকে ৩৫ রান দূরে, সম্ভল ১০৮ বল ও ৩ উইকেট।কাপ্তান আকবরের ডানে বামে ভারতীয়দের স্লেজিং, টানা ২১ বল ডট।২৫ তম বলেও রান আসেনি ব্যাট থেকে।মুহূর্তেই আকবরের সামনে চট্টগ্রাম অস্তিত্বহীন হয়ে গেল,মিরপুর নামক মাঠটাও মিথ্যে হয়ে এলো, সব ছাপিয়ে মহাসত্য হয়ে সমনে দাড়ালো পচেফস্ট্রুমের ২২ গজে টিকে থাকতে হবে। যে ২২ গজ যেন আফ্রিকার দুর্গম কালাহারি মরুভূমি হয়ে উঠলো,যেখানে টিকে থাকাই দায়। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে আকবর টিকে আছেন রকিবুলকে সাথে নিয়ে।ভারতীয় ফিল্ডাররা মনঃসংযোগে বিচ্যুতি ঘটাতে স্লেজিংয়ের পরে স্লেজিং করে গেলেন।কিন্তু একটু পরেই পরম বিষ্ময়ে যে ছেলেকে ইয়ান বিশপও বলে ফেলবেন, " আইস রানস ইনটু হিজ ভেইনস"।সেই ছেলে এসব গায়ে মাখলে তো?নিজে যেমন গায়ে মাখলেন নাহ তেমনি গায়ে মাখতে দিলেন নাহ রকিবুলকেও।একটা একটা করে রান হয় একটা একটা পদক্ষেপে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে হিমালয় শিখরের পানে।একটা একটা করে রান হয় আর স্বপ্ন তরী যেন একটু একটু করে এগিয়ে চলে ব-দ্বীপ পানে।জয় আর বাংলাদেশের আলিঙ্গনের বাধা যখন ১৫ রান তখন এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় পচেফস্ট্রুমকে।বৃষ্টির শেষে, ডার্কওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে লক্ষ্যটা ৩০ বলে ৭ এ নেমে আসে।অতঃপর ২৩ বল বাকি থাকতেই লক্ষ্য পেরিয়ে যাওয়া।আনকোলেকার বলটা মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে আকবর ও রকিবুল যখন ছুটলেন ততক্ষণে ভারত জুজু কাটিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বনে বাংলাদেশ।ড্রেসিরুমের ছোট্ট ঢেউটা পচেফস্ট্রুম ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে ততক্ষণে বঙ্গোপসাগরের তীরে আছড়ে পরেছে আর উন্মত্ত হয়ে ছড়িয়ে পরেছে গোটা দেশময়।ততক্ষণে মানুষ আরও একবার অনুভব করলো একটা জাতীর সমগ্র উল্লাস, উদযাপন, আবেগ, উচ্ছ্বাস কীভাবে একটা উইলো কাঠের তলায় চাপা থাকে! আর উনিশ-কুঁড়ির লুকোচুরির ফাঁকে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেছে.....
বাংলাদেশ তুমি চ্যাম্পিয়ন।
বাংলাদেশ তুমি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!
বাংলাদেশ তুমি সুন্দর।
বাংলাদেশ তুমি অনন্য।
বাংলাদেশ তুমি অকুতোভয়।
বাংলাদেশ তুমি বিশ্ব বিষ্ময়....
- 0 মন্তব্য