• ক্রিকেট

শর্ট বাউন্ডারি : তাদের সত্যিকারের ক্রিকেটের গল্প

পোস্টটি ৩৩১৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

‘‌‌‌আচ্ছা, মিরপুরের ওই স্টেডিয়ামটা কত বড়রে?’
‘‌‌‌এই ধর, আমাদের গ্রামটার সমান।’
‘‌‌‌বলিস কী! এত বড় বাউন্ডারিতে ছক্কা মারে কীভাবে?’
‘‌‌‌আরে তাদের গায়ে তো অনেক জোর, ব্যাটের ওজন জানিস কত?’
‘‌‌‌কয় কেজি?’
‘‌‌‌এই ধর আধমন তো হবেই।’
‘‌‌‌বলটা নাকি কাঠের? উপরে কি কিছু দেয়া থাকে?’
‘‌‌‌কী জানি, তবে আমার মনে হয় ভীষণ ভারি। তুই বল ছুঁড়ে নিতে পারবি না দু হাতও।’

দুই বন্ধুর কথোপকথন হতে পারে কিংবা কৌতূহলী এক ছোট্ট ক্রিকেট পাগল কিশোরের সঙ্গে পণ্ডিত ধরনের কারো। যাদের কারোরই আদতে এবিষয়ে তেমন জানা নেই। অঁজোপাড়া গাঁয়ে বাস। ক্রিকেট মানেই সাদা কালো টিভির অচেনা কিছু মানুষ। কিছু নাম জানা, কিছু অজানা।

বিশাল একটা মাঠ। ভারি ভারি সব ব্যাট। সুরক্ষিত পা আর মাথায় একটা হ্যালমেট। অথবা ভীষণ ভারি বল নিয়ে এসে ব্যাটসম্যানদের দিকে ছুঁড়ে মারা। অবিশ্বাস্যভাবে ওতো ওজনের বলটা অবলীলায় ফিল্ডারদের ধরে ফেলতে দেখে বিস্ময়ে কাটা পড়া।

অথবা তাদের কাছে ক্রিকেট মানে বিশ্বকাপ। ‌‘‌‌‌ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ এসে নাও চিনে’ এর আগে অথবা পরে রিকশায় করে সাহেবী ঢঙে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের প্রবেশ। এসবই তাদের কাছে মনে হয় কাল্পনিক। সাদা কালো টিভির আর চার-পাঁচটা জিনিসের মতোই। শুক্রবারের দুপুরের ছবিতেও তো দেখায় কতজনের মৃত্যু। তারা তো মরে না, এ সম্পর্কে পণ্ডিত একজন মানুষই তো বলেছে। ক্রিকেটটাও হয়তো তেমনই।

নইলে তারা যখন খেলা শুরু করে, তখন তো এসবের কিছুই থাকে না। পাঁচ হাতের জায়গা, এদিকে টিন-ওদিকেও। এটুকুর মাঝেই তো দিব্যি খেলছে তারা। ঘর বানানোর জন্য আনা হয়েছিল কাঠ, সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া একটা টুকরো দিয়েই তো তারা চার মারছে।

একটা ১৫ টাকার বল আর ১০ টাকার স্কচটেপ কিনতে তাদের টাকা দিতে হচ্ছে দশজনকে। তাতে একটা টেপ টেনিসের সঙ্গে মিলছে একটা ওসাকা কসটেপ। তা দিয়েই খেলা চলছে দিনের পর দিন। অথচ তারা স্যুটকেসে করে নিয়ে আসে অসংখ্য বল। বেছে বেছে রাখে একটা। সাদা-কালো টিভির ওই নিয়মকানুনও তো মিলছে না কিছুই।

ওখানে বল উড়িয়ে সীমানাছাড়া করাতে জুটে হাততালি আর এখানে ব্যাট তুলে দিতে হয় আরেকজনের হাতে। ব্যাট নেই, প্যাড নেই, হেলমেট নেই, ভারি ভারি বলও; তবুও তারা খেলছে। এটাও তো ক্রিকেটই। তাহলে টিভিরটাই নিশ্চয়ই মিথ্যে।

তারা বড় হয়। সে ভুল ভাঙে। বুঝতে পারে, তাদের খেলাটার দায় জায়গার অভাব। তবে এটাও ক্রিকেট, ওটাও। পার্থক্য আছে নামে। একটা শর্ট বাউন্ডারি আরেকটা ফুল। অদ্ভুত সব নিয়মের ক্রিকেটটাই তাদের কাছে আপন মনে হয়।

কিচ্ছু ভালো লাগছে না! একটা ব্যাট নাও, একটা বল। দুই ঘরের মাঝে একটা বসার মোড়া দিয়ে স্টাম্প বানাও। সামনে ব্যাট দিয়ে দাঁগ কাটো বাউন্ডারির। এরপর শুরু করো খেলা। মাপা মাপা শট। টিনে উড়ে গিয়ে একবার আর ড্রপ করে দুইবার গেলে আউট। প্রতিপক্ষ ফিল্ডারদের চেয়েও যে ভয় বেশি।

এ তো প্র্যাক্টিস। তাদের আসল খেলে কাচারির মাঠটাতে। দু পাশে গাছ কয়েকটা। আছে ছোট দুটো খাল। ওখানের মাঝখানে বল গেলে, আনতে হবে ব্যাটসম্যানকেই। আর বল যদি হারিয়ে যায়, দায়টা তবে সবার।

তাদের কাছের এই 'আসল' ক্রিকেটেটাতে একদিন বন্ধ হয়ে যায়। উঁচু করে নেয়া হয় রাস্তা। পুরো মাঠটা না। যেটুকু জায়গা রাস্তার, ততটুকুই। বুক সমান পার্থক্যে আর তাই ওই মাঠে খেলার উপায় থাকে না।

ভীষণ মন খারাপ হয় তাদের। আজ এখানে তো কাল ওখানে। জমির মালিক এলেই ভৌ দৌড়। এভাবে কী ক্রিকেট খেলা হয়! তাদের সত্যিকারের ক্রিকেট থেমে যায়।

ক'বছর বাদে তারা আরেকটু বড় হয়। আবার শুরু করে, 'সত্যিকারে'র ক্রিকেট। সারিসারি গাছের ফাঁকে। অদ্ভুত নিয়মের ক্রিকেটে। ব্যাটসম্যান ছক্কা হাঁকাতে পারেন না, বোলার হাত ঘুরালে ডাকা হয় নো।

তারা খেয়াল করে, তাদের মতো অনেকের কাছেই এটা 'সত্যিকারে'র ক্রিকেট। পোস্টার টাঙিয়ে ঘোষণা দেয়া হয় টুর্নামেন্টের। তারা দেখতে যায়। টিভি পুরস্কার দেয়া সে আসর তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

কিন্তু সেটা কোনো একদল নিয়ে নিতে তারা কমই দেখে। খেলার মধ্যে ঝগড়া লাগে, গড়ায় মারামারিতে। এরপর তারা দৌড়ে পালায়। তার আগে মোহাবিষ্ট হয়ে দেখে 'সত্যিকারে'র ক্রিকেটে।

যেখানে গোল করে চারপাশেই বাউন্ডারি আছে গ্রাম সমান ওই মিরপুরের স্টেডিয়ামটার মতোই। বলটা তাদের মতোই, ব্যাটটা একটু দামি। নিয়মকানুনেও একটু ফাড়াক আছে তাদের সঙ্গে। এটা যে সত্যিকারের ক্রিকেটেরও সিরিয়াস কিছু।

এখানে বল হারালে জরিমানা নেই। দুই পাশে অসংখ্য দর্শক। তাদের আগ্রহী চোখের মণিকোঠায় ভর করে থাকে উত্তেজনা। তাতে আম্পায়ার হওয়ার শক্ত কাজটা হয়ে যায় আরও কঠিন। একটু এদিক-সেদিক হলেই, সে সত্যি খবর হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকে।

এই সত্যিকারের ক্রিকেটে সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধ হয় বোলিং করা। হাত তো ঘুরানো যাবেই না, কান বরাবরের বেশি গেলেই নো, স্টাম্পের উপরে বল বাউন্স করলেও। সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে; সবদিকেই দাগ কাটা। একটু ছুঁলেই নো বল। এমন বোলিংকে নাম দেয়া হয়, 'ইডা বোলিং'।

ফিল্ডারদের জন্যও কঠিন সত্যিকারের ক্রিকেট। কাঠের বল নেই হয়তো। এ বল ছুঁড়ে নেয়া যায় অনেকদূর। তবে শীতের উষ্ণতায় কসটেপে মোড়ানো টেপ টেনিসের বলটা জোরে এসে আঘাত খেলে টের পাওয়া যায় যন্ত্রনা। দাঁড়াতেও তো হয় ব্যাটসম্যানদের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে।

সত্যিকারের ক্রিকেটে ধারাভাষ্যটা কঠিন-নাকি সহজ তা ভেবে পায় না তারা। বার কয়েক মাইক্রোফোন হাতে নিয়েও। তারা ততদিনে একটু-আধটু ইংরেজি বুঝে। বাংলা কমেন্ট্রিও শুনেছে অনেক। আসলেই কেউ বলেছিল কি না জানে না তারা, তবে তখন ‘মাঠ চলে গেল বলের বাইরে’ ধারাভাষ্যের খুবই জনপ্রিয় বাক্যে। চারপাশ হাসির হিড়িক পড়ে এ কথায়। তবে তারা বুঝতে পারে টিভির ওই ক্রিকেটের সঙ্গে তাদের ধারাভাষ্যের ব্যবধানটা আকাশ-পাতাল। মাঠের জায়গাগুলোর নামই তো জানা নেই ঠিকঠাক।

জানলেই বা কী! এইটুকু মাঠের কী আর থার্ডম্যান কিংবা গালি বলে কিছু আছে। সে খালি চারের বর্ণনা দেয়। মাঝেমধ্যে ভালো ফিল্ডারকে জন্টি রোডসের তুলনা করে ধারাভাষ্য চালিয়ে যায়। মানুষ হাততালি দেয়, বাহ! বাহ! করে। সে হাসিমুখে বাড়ি ফেরে।

তারা আরও বড় হয়। ক্রিকেট দেখে, সব দেশের। বাংলাদেশ আড়াইশ করার খুশির দিন ততদিনে আর থাকে না। রূপান্তরিত হয় জয়ে। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়, সব পরাশক্তিরা ধরাশায়ী হয় নিজের দেশের কাছে।

তারা বুঝতে পারে সত্যিকারের ক্রিকেট আসলে টিভিরটাই। তাদেরটা নকল, জোড়াতালি দেয়া। বুঝেও বুঝতে ইচ্ছে করে না তাদের। তারা মনে জপে রাখে সত্যিকারের ক্রিকেট। ওই সময়, এই সময়, সব সময়; আমৃত্যু।