আকাশি-সাদার সঙ্গে বিশ্বকাপ
পোস্টটি ২৫৪৭ বার পঠিত হয়েছেআচ্ছা, আকাশি রঙ কেমন? আকাশের মতো? একেবারে উপরে, যেখানটা ছুঁয়ে দেখা যায় না প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও, সেটার রঙে তো মাঝেমধ্যে দেখা মেলে কালো আর সাদারও। তাহলে? আকাশের রং কেমন?
তখন হয়তো এসব বুঝে ওঠার বয়সটাও হয়নি, অথবা হয়েছে। কোনো একটা উপলক্ষে সারি সারি পতাকা দেখা গেছে আকাশে। অথবা তারও কিছুদিন বাদে আব্বুকে আনতে ঢাকায় আসা হয়েছে। এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর পথে উঁচু উঁচু দালানের উপর দেখা গেছে রঙ-বেরঙের পতাকা।
লাল, হলুদ, সবুজ কিংবা অন্য কোনো রং। তবে চোখ আটকেছে একটাতে, আকাশের রঙ আছে যেটাতে। স্মৃতি যতটুকু মনে করায় এমন সুন্দর জার্সির প্রেমেই মন প্রথম পড়েছে।
আকাশের মতো এই জার্সিতে খেলা একেকজনও কি আকাশের মতো বিশাল আর বিস্তৃত? কে জানে। এই দলে নাকি এক রাজপুত্র খেলে, যার দৈহিক গড়ন ক্ষুদ্রকায়, সুন্দর আর খুব বেশি স্বাস্থ্যবানও না। কিন্তু তাও সে আকাশের মতো বিশাল ফুটবল পায়ে। তার নাম কি? তার নামও তখনো জানা হয়নি ভালো করে।
ঝাঁপসা করে স্মৃতি যতটুকু মনে করাচ্ছে সেবার কোনো রকমে একটা জার্সি পাওয়া গিয়েছিল আকাশি-সাদার। তখন হয়তো ক্লাস ফোর-ফাইভ। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হচ্ছে হচ্ছে এমন সময় হয়তো। তখন ডাক আসে খেলা দেখতে যাওয়ার, আর্জেন্টিনার।
সেই বোধ হয় প্রথম। বিদ্যুত নেই, আছে জেনারেটর। অন্য পাড়ার এক দোকানে। বড়দের হাত ধরে যেতে যেতেই একটা চ্যালেঞ্জ আসে। আর্জেন্টিনা হেরে গেলেই আর কখনো গায়ে জড়ানো যাবে না প্রথম পাওয়া সেই আকাশি সাদা জার্সিটা। তাতে রাজি হওয়া।
আর্জেন্টিনা সত্যিই হেরে যায়, জার্মানির কাছে, ‘এক হালি’ গোল খেয়ে। ভীষণ মন খারাপ হয় তাতে, এত কিছু না বুঝেই। খাওয়া-দাওয়া হয় না আর সে রাতে। কেউ কেউ বলে রাজপুত্রের আজ জ্বর ছিল অনেক, তাই ঠিকঠাক খেলতে পারেনি। তাতে খানিক স্বান্তনা পাওয়া যায়। বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করা যায়, আজ অসুস্থ ছিল বলে, নয়তো...!
ডটগুলো পূরণের সময় আসে আবার চার বছর পর। যার জন্য কত প্রতীক্ষা। গেল বিশ্বকাপের সময় হিসাব কষা হয়েছে, তখন বয়স কত হবে, কোন ক্লাসে থাকবে। সে প্রতীক্ষা ফুরোয়। আবার বিশ্বকাপ আসে। এবারও রঙিন সব পতাকা উড়ে গাছে গাছে।
একটা পতাকা উড়ে কাঠাল গাছটাতে। আকাশি-সাদার মিশেলের। ভাইয়ের সঙ্গে যে রুমটাতে ঘুমায়, ঠিক তার সামনেই। বড় একটা গাছেই লাগানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু গাছে উঠতেই পারে না বলে।
বিশাল এক পতাকা টানানো হয় গ্রামে, তাতে নিজেরও থাকে অবদান। খোঁচাখুঁচিও শেখা হয়ে গেছে ততদিনে প্রতিপক্ষকে। বাড়ির পাশের দোকানটায় গেলে তাই তর্কও চলে। নামও জানা অনেক। রাজপুত্রের নাম জানা গেছে আগেই, লিওনেল মেসি, বার্সেলোনায় খেলে। এই ক্লাবটার নাম প্রতিদিনই টিভির নিচের শিরোনামে থাকে।
সকাল সাড়ে আটটার স্পোর্টস টুয়েন্টি ফোরেও। সেখানে খবর পড়ে, রেজওয়ান উজ জামান। বিশ্বকাপ কাভার করতে সে পাড়ি দেয় দূর দেশেও। আম্মু এই ভদ্রলোককে দেখতে দেখতে এতই বিরক্ত হয়, বলে ফেলে 'উনার কী অসুখও হয় না নাকি?'
একই চ্যানেলে আরও একটা শো হয়। সাইফুল বারি টিটু নামে একজন বিশেষজ্ঞ থাকেন, প্রচণ্ড ফুটবল বুঝেন। এটাও তাই দেখা হয় রোজ।
সবমিলিয়ে প্রায় পুরো স্কোয়াডই চেনা হয়ে যায় বিশ্বকাপের আগে। মার্কোস রুহো, মাশ্চেরানো, ডি মারিয়া, আগুয়েরো, আর? বিগলিয়া আরও কে কে।
খেলা শুরু হয়। প্রথম খেলাটা খুব ভোরে, ছয়টা হয়তো। তাতে কী! খেলা কি আর না দেখা চলে। খেলা শুরুর অনেক আগেই ঘুম যায় ভেঙে। বিদ্যুত যাওয়ার শঙ্কায় এবারও পাড়ি দিতে হয় অনেকটা পথ, গ্রামের বাজারে।
টাক মাথার এক কোচ, সাবেলা নাম। খুব নামিদামী কোচ ছিলেন নাকি জানা হয় না। তবে তিনি তুলতে তুলতে আকাশি সাদাদের নিয়ে যান ফাইনালে। ওই পর্যায়ে যাওয়ার ঠিক আগের ম্যাচটা, সেমিফাইনাল। তার স্মৃতিটা এখনো জ্বলজ্বলে।
চিরপ্রতিদ্বন্দী ব্রাজিল বাদ পড়ে গেছে আগের রাতে, ৭ গোল খেয়ে। এই খেলাটা দেখার ইচ্ছে ছিল ভীষণ, তিনটার দিকে বোধ হয় ম্যাচ। তার ঘণ্টাখানেক আগে ঘুম গেছে ভেঙে।
আরেকটু ঘুমিয়ে নেই বলে প্রথমার্ধোই কেটে গেছে চোখ বন্ধ করে। টিভিটা এক মাসের জন্য আম্মুর সঙ্গে একরকম জোর করেই নিয়ে আসা হয়েছে সামনের রুমটাতে। ঘুম ভাঙতেই দেখা যায় রুমভর্তি মানুষ।
তার চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষায়, চোখ কপালে উঠার উপক্রম। এ কী! এতো চার গোল! আমি কী আসলেই সত্যি দেখছি! ভাই জবাব দেন, চোখ ধুয়ে আয়। এসে দেখা যায় স্কোরটা আরও বেড়ে গেছে, ম্যাচ শেষে সেটা ৭-১!
তখনও ফেসবুক একাউন্ট নেই। 'ট্রল' শব্দটার সঙ্গে পরিচয়ও। তবুও চাপা আনন্দ তো কাজ করছেই, খোঁচানো যাবে খুব করে। এই 'আনন্দ' চাপা থাকার কারণ দিন পেরিয়ে রাতেই খেলা আকাশি সাদাদের। আগের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে।
একটা বড় 'পর্দা' আনা হয়েছে। বাজারে সবার খেলা দেখা হবে একসঙ্গে। তাতেও উৎকণ্ঠা আছে। কখন না নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লেগে যায় মারামারি। তবুও, বড় পর্দা বলে কথা, আমার চেয়েও বিশাল।
খেলা শুরু হয়, সময় গড়ায়। একটু একটু করে বাড়ে শঙ্কা। আর্জেন্টিনা পাস খেলতে খেলতে গোলকিপারকেও কাটাতে চায় বলে অভিযোগ উঠে। সুদূর ব্রাজিলে যে কোনো পরামর্শ পৌঁছানোর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই, এটাও মাথায় থাকে না কারো।
কেউ কেউ চান মাঠে নেমে পড়তে, কেউবা হয়ে যান বিশেষজ্ঞ। তাতে কাজের কাজ হয় না। আর্জেন্টিনা গোল করে না, নেদারল্যান্ডসও। তাহলে? ট্রাইবেকার। রোমেরো কি পারবে ঠেকাতে?
ভাবতে ভাবতেই শুরু হয় ট্রাইবেকার। রোমেরো ঠেকিয়ে দেন। ব্যবধান মনে নেই, 'আর জিতে না' জিতলে তার প্রয়োজনও। নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে তাহলে আকাশি-সাদারা পৌঁছালো কোথায়?
আরে! ফাইনাল! ফাইনাল! বিশ্বকাপের! আর্জেন্টিনার! নাহ। তখনো বাকি, তবে আর একটা ম্যাচ। আর মাত্র দেড় ঘণ্টার লড়াই। রাজপুত্রের জাদুতে নাকি কতকিছুই ধুলিস্মাৎ হয় নিমিষে! জার্মানিও কি তেমন হবে?
অবশেষে সেই দিন আসে। খুশিতে বোধ হয় কাঁদে আকাশও। টুপটুপ পানির ফোঁটা জানান দেয় নিজের আনন্দ। তাতে অবশ্য মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকাদের বাড়ে দুশ্চিন্তা। বিদ্যুৎের জনযাট পোহাতে হবে যে!
জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টিতে তাহলে করা যায় কী! আইপিএস! পাশের বাড়িতেই। টিভি কার? আম্মু রাজি হতে চায় না কিছুতেই। না হলেই বা কী! আজ কি কিছু মানার সুযোগ আছে।
খেলা শুরু হয়। বিদ্যুত না থাকলে নেই ডিসলাইন। বিটিভি, এন্টেনার, টিভি অবশ্য রঙিন। অন্য কোনো দিন হলে হয়তো নস্টালজিক হওয়া যেত, ভাসা যেত অতীত স্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার আনন্দে। আজ আর সে সুযোগ কই! বরং এ তো যন্ত্রণার নাম।
সব উপেক্ষা করে শুরু হয় লড়াই। শ'দুয়েক মানুষের দেখা মেলে। আকাশি-সাদা রঙ আর আজ থাকে না, পরে অবশ্য বারবার মনে হয়েছে এটাই বুঝি হারিয়েছে। আর্জেন্টিনা আজ নেমেছে একেবারে নীল রঙের এক জার্সি গায়ে।
তাতে ফুটবলারদের সুন্দর লাগছে, কিন্তু মাঠে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না একটুও। রাজপুত্র আজ নিষ্প্রভ, বেশির ভাগ সময়ই নেমে আসছেন মাঝমাঠে। অন্যরাও কেমন যেন আজ, গোল দেয়ার চেয়ে ঠেকানোও মনোযোগী।
সময় গড়ায়, বাড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। গোল হবে হবে করেও হয় না। খেলা গড়িয়ে চলে যায় অতিরিক্ত সময়ে। ততক্ষণ একইভাবে বসে থাকে একটা ছেলে। একটা লুঙ্গি আর আকাশি সাদাদের জার্সিটা গায়ে।
সেটা বোধ হয় নজরে লাগে পেছনে বসে থাকা কারো। 'একটু নেড়েচড়ে বস' বলে। নিজেরও ইচ্ছে হয়, কতক্ষণ আর বসে থাকা যায় একইভাবে! কিন্তু স্থির হতেই উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে। গোল! গোল! বলে যখন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠার কথা, তখনই খেয়ালে আসে চারপাশটায় কেমন নীরব নিস্তব্ধ। কার জালে বল জড়িয়েছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টের পাওয়া যায় সেটিও।
এরপরের মুহূর্তটাই জীবনের সবচেয়ে দুঃখের একটি হয়ে থাকে, হয়তো থাকবে আমৃত্যু। ক্ষতকিক্ষত হৃদয়ের কষ্টটা তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চোখের জল হয়ে। মনটা হয়ে যায় বিমূর্ষ, পৃথিবীটা যেন হতে থাকে সংকীর্ণ। বারবার মনে হয় এত কাছে তবুও কত দূরে।
সে ঘোর কাটার আগেই শুরু হয় হই-হুল্লোড়। প্রতিপক্ষের 'ট্রল' সহ্য করতে না পারায় যা গড়ায় হাতাহাতিতে। তবুও একটা ছেলের ভাঙে না নীরবতা। লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করে চারপাশ, অথচ সে আবিষ্কার করে তার নড়ার শক্তিটাও অবশিষ্ঠ নেই আর।
আকাশের মতো বিশাল হয়ে ওঠা হয়নি আর্জেন্টিনার, বিশ্বকাপ জিতেনি বলে! না জিতুক। এরপরও তো কয়েকবার ফিরেছে শিরোপা জেতার দোরগোড়া থেকে। তাতে কিছু যায় আসেনি। বরং ফের অপেক্ষায় বসা হয়েছে শিরোপা উঁচিয়ে ধরার, রাত জাগা হয়েছে এই দলের দারুণ ফুটবল দেখার। একবার না, বারবার।
- 0 মন্তব্য