ফিরে দেখা সেই কান্না
পোস্টটি ৩৭১০ বার পঠিত হয়েছেবলটা লেগ সাইডে ঠেলে দিয়েই দৌঁড়। অর্ধেক ক্রিজ পেরোনোর পর সেই শক্তিটুকুও বোধহয় আর পেলেন না। হতাশার ভারে দুই পা অবশ হয়ে আসছে। তামিম ইকবাল শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে, যে দৃষ্টিতে ছিল সবকিছু হারিয়ে ফেলার চাহনি। মুশফিকুর রহিম আর আটকাতে পারলেন না। সাকিবকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে শুরু করলেন। সাকিব আল হাসান নিজের চেহারাটা লুকানোকেও ঐ সময় তুচ্ছ মনে করলেন। তিনি সকলের সামনেই শিশুর মতো চোখের পানি ফেললেন। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আবার পড়লেন আরেক বিপাকে। ক্রিজের মাঝখানে তিনি। দৌঁড়ে চলেও আসতে পারছেন না আবার নিজের আবেগটাকেও ধরে রাখতে পারছেন না। অন্যদিকে গাঢ় সবুজের জার্সিতে এগারোজনের চলছে উন্মত্ত উদযাপন । সবুজ মাঠের উপর সবুজ জার্সি পরা দুই দলেরই খেলা । কিন্তু দিনশেষে প্রতিটি সবুজই যেন কত আলাদা মনে হচ্ছে । আইজাজ চিমার নিখুঁত ইয়র্কারটি শাহাদাত হোসেন ডিগআউট করার পর এই দৃশ্যটিই মিরপুর স্টেডিয়ামে দেখা যায়।
মিরপুরে ২০১২ এর এই দিনে টসে জিতে পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। শুরু থেকেই রাজ্জাক, সাকিব, মাশরাফি আর নাজমুলের দুর্দান্ত বোলিংয়ে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখলেও শেষ দিকে আফ্রিদী আর সরফরাজের দুর্দান্ত দুই ক্যামিওতে ঠিকই ২৩৬ রানের সংগ্রহ দাঁড়ায় পাকিস্তানের । যার ১৯ রানই আসে শাহাদাত হোসেনের করা শেষ ওভারে । কিন্তু তবুও বর্তমান সময়ের ক্রিকেটে এসে এই রান তাড়া করা একটা ছেলেখেলাই মনে হবে। আর তার উপর ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে আত্ববিশ্বাসে টগবগ বাংলাদেশ দল। আশাবাদী না হয়ে উপায় তো ছিল না।
জবাবের শুরুটাও হল আশানুরূপ । তামিম ইকবালের টানা চার ম্যাচে ফিফটির পর ঐ চার আঙুল দেখিয়ে উদযাপনটাই দর্শকদের মন রাঙিয়ে দেয়। সাকিব আল হাসান ৭২ বলে ৬৮ রানের ইনিংস দিয়ে ম্যাচটাকে নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে দেন, যেটা তিনি পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই করে এসেছেন। কিন্তু তারপরেও কোথাও যেন কিছু একটা ঠিক হচ্ছিল না। নাহলে তামিম ইকবালের রানের অর্ধশতক হওয়ার সাথে নাজিমুদ্দিনের বলের অর্ধশতক পূরণ করার পাল্লা দেওয়ার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে বলকে চাবুকের মতো করে শাসন করা নাসির হোসেনের ৬৩ বলে ২৮ রানের ইনিংস দেখেও হতভম্ব না হয়ে উপায় ছিল না। মুশফিক এসে রানরেট বাড়ানোর চিন্তায় প্যাভিলিয়নে চলে গেলেন। মাশরাফি এসে ঠিকই চেষ্টা করলেন। এক বছর আগে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার আক্ষেপ ঘুচানোর সেরা এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাননি । কিন্তু, দিনটি তো আর তার হাতে ছিল না।
শেষ ওভারে দরকার ৬ বলে ৯ রান। ক্রিজে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ । পরবর্তীতে যিনি বাংলাদেশের সাইলেন্ট কিলার নামে পরিচিত হন। ও প্রান্তে আব্দুর রাজ্জাক , বল হাতে নিজের দায়িত্বটা অতিরিক্ত নিষ্ঠার সাথে পালনের পর ম্যাচের নায়ক বনে যাওয়ার অপেক্ষায়। বোলার আইজাজ চিমা, সময়ের অন্যতম সেরা ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট। আর গ্যালারী ও টিভির সামনে কোটি দর্শক, যাদের অধিকাংশেরই হৃৎপিণ্ড হাতে এসে পড়ার জোগাড়। প্রথম বলে একটি সিঙ্গেল। রাজ্জাক স্ট্রাইকে। পরের বলে একটি লেগ বাই। আবার মাহমুদুল্লাহ স্ট্রাইকে। পরের বল ডট। ৩ বলে দরকার সাত। পরের বলে ওভার-থ্রো এর সুবাদে তিন রান। দরকার দুই বলে চার। এর পরের বলে বোল্ড! আব্দুর রাজ্জাকের স্ট্যাম্প ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে কোটি ভক্তদের হৃদয়ও যেন ভেঙে গেল। দরকার চার রান। হাতে এক বল। স্ট্রাইক নেবেন শাহাদাত হোসেন । ব্যাটিংয়ে যার কোনো সুনাম নেই। কিন্ত তার ঐ দুঃস্বপ্নময় শেষ ওভারের জন্যই যে ম্যাচটা এতদূর আসল সে ম্যাচটা শেষ করার দায়িত্বও যেন তার হাতেই লেখা। সে আশাতেই কিছুক্ষণ আগে ভেঙে যাওয়া হৃদয় কোনোমতে জোড়া লাগিয়ে আবার মিরপুরের ২২ গজে চোখ রাখল সবাই । কিন্তু আইজাজ চিমার এই বলটি থেকে বাউন্ডারি আদায় করা হয়তো বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের জন্যেও দুঃসাধ্য ছিল। একজন টেল-এন্ডারের কথা না হয় বাদই দিলাম। দু'রান। মাত্র দুটো রানই যেন দুশো ক্রোশের ব্যবধান হয়ে দাঁড়াল তখন বাংলাদেশ দল আর এশিয়া কাপ ট্রফির মাঝে ।
শাহাদাত হোসেন তার শেষ ওভারে একটা নো-বল কম করতে পারতেন। ১৯ রানের জায়গায় ১৭ রানও দিতে পারতেন। নাসির হোসেন ৬৩ বলে ৩০ রানও করতে পারতেন অথবা নাজিমুদ্দিন ৫২ বলে ১৮। মাশরাফি বিন মুর্তজা যে শটে আউট হলেন সেটাও হয়তো অন্য একদিন চার হতে পারত। একটু এদিক ওদিক হলেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস ভিন্ন করে লেখা থাকত। কিন্তু ১৬ কোটি হৃদয় ভাঙা যেদিনটার নিয়তি ছিল সে দিন এগুলোর কোনোটাই না হওয়াই যেন প্রকৃতির নিয়ম ছিল।
না। সাকিব, তামিম, মাশরাফি, রাজ্জাক; যাদের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের জয়ের আশা ছিল তারা কেউ হতাশ করেননি । কিন্তু তবুও দিনশেষে একরাশ হতাশাই তাদের সঙ্গী । তামিম হতাশ কারণ চার আঙ্গুল দেখিয়ে সমালোচনার জবাব দিলেও ক্যারিয়ার শেষে নিজের প্রাপ্তির প্রশ্নের জবাব যা দিয়ে দিতে পারতেন সেই ট্রফিটা দশ আঙ্গুল দিয়ে তোলা হল না। সাকিব হতাশ পুরো টুর্নামেন্টটা নিজের মতো করে সাজালেও প্রাপ্তি খাতায় শূণ্যতা দেখে, যে অভিজ্ঞতা সাত বছর পর বিলেত গিয়ে তাকে আবার পেতে হবে। মাশরাফি হয়তো এখন খুঁজছেন কোনটা বেশি কষ্টের। নিজের মাঠে বিশ্বকাপ খেলতে না পারা নাকি এই মূহুর্তটা। মাহমুদুল্লাহ হতাশ কেন তাকেই এই সবকিছু সবচেয়ে কাছ থেকে দেখতে হল । আর মুশফিক । তিনি সাকিবকে জড়িয়ে কাঁদছেন আর সাকিব তার মাথায় হাত দিয়ে । পুরো বিশ্ব এ দৃশ্যে হতবাক। কিন্তু তারা কি করে বুঝবে যে ১৬ কোটি চোখের পানি এ দুজোড়া চোখ দিয়ে আটকে রাখা সম্ভব ছিল না।
কথায় বলে কিছু প্রথম প্রথমবারেই হয় না। তাই হয়তো আমাদের প্রথম এশিয়া কাপ ট্রফিটা প্রথম ফাইনালে হল না। যেটা পরে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ফাইনালেও হয়নি।
আবার বলা হয় প্রথম কোনোকিছুরই তুলনা হয় না। সে হৃদয়ভঙ্গেরও কোনো দ্বিতীয় ছিল না। তাই আট বছর পর যখন পৃথিবীর থমকে যাওয়ার অবস্থায় স্মৃতিচারণই একমাত্র সম্বল তখন এই মূহুর্তটার কথাই সবার আগে স্মৃতিতে ভেসে উঠল।
- 0 মন্তব্য