আকবরদের গ্রেট হওয়ার পথটা কতটা কঠিন?
পোস্টটি ১৯৪১ বার পঠিত হয়েছেআফ্রিকার অকৃত্রিম সবুজের মধ্যে লাল-সবুজের জয়গান করে এসেছিলেন আকবর, তৌহিদরা। এই ২০২০ সালে এদেশের ক্রিকেটের একমাত্র সাফল্যগাঁথা। আর এই জয়গানের সাথে ভক্তদের মন রাঙিয়েছিলেন এক নতুন স্বপ্নের তুলিতে , যে স্বপ্ন আসলেও সমর্থকদের ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো। স্বপ্ন দেখান এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের । কিন্তু মরুভূমির উজ্জ্বলতা যত বেশি হবে তাতে মরীচিকার আশঙ্কাও সমান হারে বাড়তে থাকে । বাংলাদেশের ট্রফি ক্যাবিনেটের শূণ্যতা মরুভূমির চেয়ে কম কিছু না। সেই মরুভূমিকেই স্বর্ণোজ্জ্বল করে তুলতে যখন এই পনেরজনের দিকে তাকানো হয় তখন তা মরীচিকা হবার আশঙ্কা আসলেও ফেলে দেবার মতো নয়।
এই স্বপ্নের যৌক্তিকতারও সাক্ষী ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায়। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল পঞ্চম হয় যা পরবর্তীতে দীর্ঘদিন এ টুর্নামেন্টে আমাদের সেরা সাফল্য ছিল এবং সে দলেরই সদস্য ছিলেন তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম , ১৫ বছর পর যারা বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের তালিকার প্রথম তিনটি স্থান দখল করে নেন । শুধু তাই নয়। তাদের পজিশনে তারা বিশ্বসেরাদের একজন। আর এই তিনজনের সময়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলো আসে। এশিয়া কাপ ফাইনাল (৩ বার) , বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমি-ফাইনাল, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে টেস্টে হারানো, টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে জয় এরকম আরো অনেক।
এরপর বহু প্রতিশ্রুতি নিয়ে গেলেও ২০১৬ এর আগ পর্যন্ত প্লেট চ্যাম্পিয়নশিপই ছিল সর্বোচ্চ অর্জন। ২০০৮,২০১০,২০১২,২০১৪ বিশ্বকাপের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আসলেও তাদের কেউই জাতীয় দলকে দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকার, এনামুল হক বিজয়, তাসকিন আহমেদ, নাসির হোসেন এরকম আরো অনেক নামই বলা যাবে। ২০১৬ সালে যখন ঘরের মাঠে সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত যায় বাংলাদেশ দল তখন আবার নতুন স্বপ্নের দানা বাঁধতে থাকে। এবং ঠিকই জাতীয় দলের পঞ্চপান্ডবের পর যাদের ওপর আস্থা রাখা যায় সেই মিরাজ, সাইফুদ্দিন এ দলেরই অংশ ছিল।
তাই ইতিহাসকে সাক্ষী হিসেবে নিয়ে আকবর বাহিনীর আফ্রিকার দক্ষিণ জয় করে আসাকে নিয়ে ভক্তদের আবারও বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশ্বজয়ের আশা দেখা দোষের কিছু নয়। তার ওপর যখন দেখব তামিমের মতো একজন বিস্ফোরক ওপেনার, শরিফুলের মতো বল দুইদিকেই সমানভাবে সুইং করাতে সমর্থ্য বাঁহাতি পেসার বা আকবরের মতো পরিণত ফিনিশার ও অধিনায়ক তখন তো আর বড় কিছুর আশাকে দমিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু এই আশার উল্টো পিঠে আশঙ্কাও তো কম নয়।
জাতীয় দলে এসেই প্রত্যাশার চেয়েও বেশি হাইপ আর জনপ্রিয়তা পেয়ে ক্রিকেট থেকে মনযোগ হারিয়ে জাতীয় দলের সার্কিট থেকেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তার ওপর প্রত্যাশার চাপেও ন্যুব্জ হয়ে ভেঙে পড়ার উদাহরণও অনেক। আর এই ক্রিকেটারগুলো জাতীয় দলে আসার আগেই এ সবকিছু পেয়ে আসছে । এবং অবশ্যই তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এখন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেয়ার স্বপ্নকে তাড়া করে জাতীয় দলে আসা পর্যন্ত তারা এগুলোর সাথে মানিয়ে চলল। কিন্তু জাতীয় দলে এসে সেই চাপ , সেই হাইপ, সেই জনপ্রিয়তার হবে আরো শতগুণ। এত কিছুর বোঝা নেয়ার মতো সামর্থ্য কি ঐ তরুণ অপরিণত করোটি বয়ে নিতে পারবে?
অপরিণত শব্দটা শুনে হয়তো এখন আমার উপর অনেকটা জেঁকে বসতে পারেন। এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে আর যা-ই হোক পরিণতবোধের দিক থেকে এ টুর্নামেন্টে তাদের দ্বিতীয় কেউ ছিল না। ৩০ ম্যাচ খেলিয়ে এই টুর্নামেন্টের জন্য এই দলটিকে প্রস্তুত করেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট । পরিণতবোধের অভাব থাকার সুযোগও তাই ছিল না। কিন্তু সেই বোধ না হয় এই পর্যায়ের জন্য? জাতীয় দলের জন্য প্রয়োজনীয় পরিণত তো তারা নয়। কিন্তু চাপটা তাদের ওপর থাকবে কয়েকগুণ। সামলানোটাও তাদেরই হাতে। যদি না পারেন তাহলে আরো একবার হৃদয়ভঙ্গের সাক্ষী আমরা ।
আবার এই দলটিকে নিয়ে বিসিবিও দেয় দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা । অনূর্ধ্ব-২১ দল করা হবে, তাদেরকে আলাদা করে গড়ে তোলা হবে, আলাদা কোচিং স্টাফ থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু বিসিবির অনেক পরিকল্পনাই মেয়াদোত্তীর্ণ হতে বেশি সময় নেয় না। হয়তো এক্ষেত্রে তা হবে না। কিন্তু কথা তো এখানেই শেষ নয়। যখন ৮-১০ বছরের একটি কিশোর ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয় তখন তাকে ঠিকই এ কথা শুনতে হয় " অত ভালো তো খেল না যে ক্রিকেটের পেছনে তোমার জীবন নষ্ট করবে।" খুবই সাধারণ একটি কথা আমাদের সাধারণ মানুষদের মধ্যে । কিন্তু জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে কি এই চিন্তা-ভাবনা করা চলে? অনূর্ধ্ব-১৯ এর ক্রিকেটারদের পরিচর্যা ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম বড় দায়িত্ব । কিন্তু এত দিন এই চিন্তা-ভাবনা তাদের মাথায় আসে নি। যখন ২০১৬ তে তৃতীয় হল তখনও এত পরিকল্পনা দেখা যায়নি। প্রশ্ন থেকেই যায়। চ্যাম্পিয়ন না হলে কি এই দলও তা পেত না? উত্তর না হলে তা আবার আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসায়।
২০১৬ এর দলটিকে বিশ্বকাপের জন্য অনেক যত্ন করেই প্রস্তুত করে ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু ঠিক ততটাই অবহেলা করে ২০১৮ এর দলটির ক্ষেত্রে । ২০২০ এর দলটির দিকে যদি তারা এতটাই মনোযোগ দেয় তা আবার পরবর্তী অনূর্ধ্ব-১৯ দলটি থেকে কিছুটা মনোযোগ কেড়ে নেবে না তো? আবার কিছুক্ষণ আগেই যে মানসিকতার কথা বললাম সে মানসিকতা এক দিনেই পরিবর্তন হবার নয়। যদি এত পরিচর্যার পরে দুঃখজনকভাবে একজনও যদি জাতীয় দলের হাল ধরতে না পারে তখন নিশ্চিতভাবেই তাদের মনে হবে এত পরিচর্যার কোনো দাম নেই। ফলশ্রুতিতে পরবর্তী তৃণমূলের ক্রিকেটাররাও প্রয়োজনীয় সুবিধা পাবে না। যা হয়তো আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যতটাকেই আবার নাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রাখে।
তাই এই আফ্রিকা জয়ের পর্বই তাদের শেষ পর্ব নয়। এ দলের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই। নিজেদের সাথে নিজেদের লড়াইয়ে জয়ী হবার পর এখন তাদের লড়তে হবে পরিপার্শ্বিকের সাথে। শুধু ট্রফি জয় নয়, আরো অনেক প্রতিবন্ধকতাই তাদের জয় করতে হবে? আর এ জয়ের জন্য তাদের প্রতিশ্রুতি অজস্র। অজস্র তাদের প্রতি প্রত্যাশাও। কিন্তু যা বললাম। প্রত্যশার ভারে নুয়ে পড়বার উদাহরণও কম নয়। তাই যতই বিসিবির অধীনে থাকুক না কেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রকৃত ভবিষ্যত এই ১৫ জন তাদের নিজেদের হাতেই লিখবেন।
- 0 মন্তব্য