• ক্রিকেট

এক নীলের আকাশ ছোঁয় আরেক নীলের স্বপ্ন ক্ষয়

পোস্টটি ২২৬২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ক্রিকেটের দুই গ্রেট, শুধু গ্রেট নয়। পরিসংখ্যানের হিসেবে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা বোলারকে ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চ শেষ সংবর্ধনা দেবে। তারাও প্রস্তুত সে মঞ্চটাকে নিজের মতো রাঙিয়ে হাসিমুখে বিদায় নেবে। কিন্তু হাসিটা যে যেকোনো একজনের মুখেই থাকবে তা সমস্ত বিশ্বই জানত। জানত তাঁরা দুজনও। তারা একে অপরকেও খুবই ভালো জানত। আর তাই সেদিন তাদের প্রথম প্রতিপক্ষ তারা নিজেরাই ছিলেন। মুরালিধরনের হয়তো তত দুঃখ থাকত না। বিশ্বকাপ একবার তার দু'হাতে ঠিকই আসে। কিন্তু শচীনের আক্ষেপের কমতি থাকত না। ৩৪ হাজার রান আর ১০০ সেঞ্চুরির চেয়ে এটাই তার পরম আরাধ্য ছিল।


শ্রীলঙ্কাও আরো একবার বেদনার বিষে নীল হতে চায় নি। তাই ২০০৭ এর বারবাডোজের সমস্ত ভুলগুলোই তারা শুধরে নিতে চাইল। সে ভাবনাতেই হয়তো টসে জিতে লঙ্কান সেনাপতি কুমার সাঙ্গাকারা প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। ভারতীয় দল ফিল্ডিংয়ে নামল। ম্যাচের আগেই তারা ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল ট্রফিটা তারা শচীনের জন্যই জিতবে। নিজের ঘরের মাঠে শচীনও ঐ স্বপ্নই ঐদিন চোখে নিয়ে মাঠে নামলেন, যে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিলেন বাকিদের চোখেও।

জহির খান তখন পর্যন্ত তর্কাতীতভাবে টুর্নামেন্টের সেরা বোলার। শুরু করলেন সেরকমই । প্রথম স্পেলে এসে টানা তিনটি মেইডেন। সাথে উপুল থারাঙ্গার উইকেট। প্রথম স্পেল শেষে তার পরিসংখ্যান ৫-৩-৬-১ । সেরার সেরাটা যেন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্যই রেখে দিয়েছিলেন । ১৭ ওভার পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে চেপেই ধরেছিল। ১৭তম ওভারে দিলশান আউট হওয়ার পর নামলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। ক্রিজে তখন তার সাথে কুমার সাঙ্গাকারা। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসের দুই গ্রেট। গ্রেটরা সবসময়ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূহুর্তে নিজের সেরাটা সামনে আনেন। ইনারাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। দুজনে মিলে গড়লেন ৬২ রানের জুটি। দিলেন শ্রীলঙ্কাকে একটি শক্ত ভিত। সাঙ্গাকারা ফিরে গেলেন হাফসেঞ্চুরি হতে দুই রান দূরে থেকে। জয়াবর্ধনে তখনও অটল। বদ্ধ পরিকর চার বছর আগের আক্ষেপের পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে। অপর প্রান্তে সঙ্গীদের আসা যাওয়ার নমনীয়তার মাঝেও তার মধ্যে দেখা যায় অজস্র দৃঢ়তা। শেষ দিকে তবুও থিসারা পেরেরার সহায়তা পেলেন। গড়লেন ৬৬ রানের জুটি। খেললেন ৮৮ বলে ১০৩ রানের কাব্যিক এক ইনিংস । বিশ্বকাপ ফাইনালের অন্যতম সেরা ইনিংসগুলোর একটি। উপসর্গ করলেন প্রিয় প্রেয়সীকে, যিনি ওয়াংখেড়েতে ঐদিন উপস্থিত ৪৩০০০ দর্শকের মধ্যে তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন। তার সাথে শেষ দিকে কুলাসেকারার ৩০ বলে ৩২ এবং থিসারা পেরেরার ৯ বলে ২২ রানের ক্যামিওতে শ্রীলঙ্কা করল ২৭৪ রান। জহির খানের প্রথম স্পেল যত দুর্দান্ত ছিল পরেরগুলো ঠিক ততটাই হতশ্রী । তাই ইনিংস শেষে তার পরিসংখ্যান ১০-৩-৬০-২ । যুবরাজ সিংও নেন ২ উইকেট। যার একটি তার দুর্দান্ত ক্রিকেট মস্তিষ্কের বদৌলতে পাওয়া । সামারাবীরার প্যাডে যখন তার স্ট্রেইটার ধরনের বলটি আঘাত হানে তা সবার চোখ ফাঁকি দিলেও তিনি ঠিকই কাপ্তানকে বলে রিভিউ নিয়ে উইকেটটি আদায় করেন।


২৭৫ রানের টার্গেট তখন যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। তার ওপর প্রতিপক্ষে থাকে যখন মালিঙ্গার মতো একজন, যিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এই ২৭৪ কে তিনি ৩৭৪ করেই ছাড়বেন তখন তা ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস ছুটিয়ে দেয়। জহির খানের মতো তিনিও প্রথম স্পেলে চালালেন তান্ডব । দ্বিতীয় বলেই শেওয়াগকে ফেরালেন লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে। ইনিংসের সপ্তম এবং নিজের চতুর্থ ওভারের প্রথম বলেই ফেরালেন শচীন টেন্ডুলকারকে। নায়কের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। শুরুটাও করলেন নায়কের মতোই। কিন্তু বুনো মালিঙ্গার লঙ্কান তান্ডবে তার সেই মঞ্চ মূহুর্তেই তছনছ হয়ে গেল। আগের ম্যাচে মোহালিতে জীবন পেয়েছিলেন চারবার। তার একটিও এবার তার কাছে আসল না ।১৪ বলে ১৮ রান করে ফেরার পথে তার ক্যারিয়ারের একমাত্র অধরা স্বপ্ন পূরণের জন্য সতীর্থদের দিকে তাকিয়েই সৃষ্টিকর্তার কাছে, যিনি তাকে এতকিছু দিয়েছেন, প্রার্থনা করতে হল। কিন্তু এরকম ম্যাচ জিততে হলে পুরো টিমের ভালো খেলা চাই। যেটা সেদিন শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে অপ্রতুল ছিল। তাই মালিঙ্গা প্রথম স্পেল শেষে চলে যাওয়ার পরই ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের উপর পরানো ফাঁসটা আলগা হতে লাগল। টেন্ডুলকারের আউট হওয়ার পর ক্রিজে আসলেন বিরাট কোহলি যিনি পরবর্তীতে ভারতের ক্রিকেটে তাঁরই উত্তরসূরি হবেন। গৌতম গাম্ভীরের সাথে মিলে করলেন ৮৩ রানের জুটি। শচীন টেন্ডুলকারের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় তাঁর শেষ ম্যাচে ভিরাট কোহলি এসে তাঁর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে ছিলেন। সেই শ্রদ্ধার তাড়নাতেই ভিরাট কোহলি তার এই পিতৃতুল্য ব্যক্তির জন্য লড়ে গেলেন। কিন্তু তিনিও বেশিক্ষণ পারলেন না। ৩৫ রান করে দিলশানের হাতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে সাজ ঘরে ফিরলেন। তবে পারলেন ঠিকই গৌতম গাম্ভীর ও কাপ্তান মাহেন্দ্র সিং ধোনি। দুজনের ১০৯ রানের জুটি ভারতকে আবার পথ চেনাল। গাম্ভীর বাউন্ডারি মেরে নিজের সেঞ্চুরি পূরণ করার আশায় বোল্ড হলেন পেরেরার বলে। তিন রানের আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছাড়লেন। আশায় তার দেশের ২৮ বছরের আক্ষেপটা যেন ঘুচে যায়। তখনো দরকার ৫২ বলে ৫২। কঠিন। কিন্তু ধোনির ক্যারিশমার জন্য তা যথেষ্ট না। নিজেকে প্রমোট করে পাঁচে নেমে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর আগেও একবার এক বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভারে যোগিন্দর শর্মাকে বোলিংয়ে এনে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অযৌক্তিক জুয়া তিনি খেলেন না। যুবরাজের সাথে মিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েই কাজটা শেষ করলেন তিনি। ১১ বলে দরকার ৪ রান। সবাই নিশ্চিত কে জয়ী হতে যাচ্ছে। কিন্তু ধোনির ক্যারিশমা এখনো বাকি। নুয়ান কুলাসেকারার অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল টেনে এনে শপাং করে লং অনের উপর দিয়ে আছড়ে ফেলে দলকে বিশ্বকাপ না জিতালে তিনি মাহেন্দ্র সিং ধোনি কেন হবেন। শেষ করলেন অপরাজিত ৭৯ বলে ৯১ রানের আরেক কাব্যিক ইনিংস। ২৮ বছর পর ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বসেরার মুকুট।

২ রা এপ্রিল, ২০১১। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ধোনির ঐ ছয়ে সেদিন অনেক কিছুই ভাঙল। ভাঙল ভারতীয়দের ২৮ বছরের বিশ্বকাপের অপেক্ষা । ভাঙল শচীন টেন্ডুলকারের অধরা আক্ষেপ। ভাঙল বিশ্ব ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার এক যুগেরও বেশি সময়ের দাপট, বিশ্বকাপ আবার ফিরে এল এশিয়াতে। আর ভাঙল দুই কোটি শ্রীলঙ্কান মন। আরো একবার। চার বছর আগে ঠিক এই মূহুর্তটাই তারা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করে। চার বছর পর স্থান এবং প্রতিপক্ষই শুধু পরিবর্তন হল। আর সবকিছু যেন তাদের কাছে ঠিক একই বিন্দুতে ফিরে এল। একদিকে যখন আকাশি নীলদের আকাশ ছোঁয়া উচ্ছ্বাস, আরেকদিকে বেদনার বিষাদের নীলে নত শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের মুখ। মুরালিধরন বিশ্বকাপ জিতে ক্রিকেটকে গুডবাই বলতে পারলেন না। দিলশানের টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়া সেদিন বৃথা মনে হল। বিফলে গেল মাহেলা জয়াবর্ধনের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি এবং কুমার সাঙ্গাকারার ক্ষুরধার ক্যাপ্টেনসি। বিরাট কোহলির কাঁধে করে যখন পুরো ভারতীয় দল শচীন টেন্ডুলকারকে সম্মাননা দিচ্ছিল তখন হয়তো দূর আকাশে তাকিয়ে তাদের এই ভাবনাই হচ্ছিল " আমাদের এই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে কি? "