• ক্রিকেট

এক প্যাকেট টি-ব্যাগ, ‘ম্যাড়ম্যাড়ে টেস্ট’, রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চের সেই দুই ম্যাচ

পোস্টটি ১৪৪৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

22nd September 1986: India and Australia Play Out the Second-Ever ...

আপনার ধৈর্যের ইতি কোথায়? আপনার ফল পাওয়ার অপেক্ষার সময় হবে কতক্ষণ? আপনি হয়তো একটা টি-ব্যাগের প্যাকেট কিনলেন, গরম পানি আছে হিটারে, একটা কাপও। আপনি পানি ঢালছেন গরম, একটা করে টি ব্যাগ দিচ্ছেন তাতে।


এরপর আপনি আবিষ্কার করলেন আপনার টি-ব্যাগটা খালি হয়ে গেছে, গরম পানিটাও শেষ। তবুও কোনো এক খেলার ফল বেরোয়নি। আপনি যদি একটু বেশিই চা খান, 'চা খোর' হন, তাহলে হয়তো তখনও একটা দলের ম্যাচে দুবার ব্যাটিংয়ের প্রথমটিই শেষ হয়নি। আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন আমি টেস্ট ম্যাচের কথাই বলছি।


একটা টেস্ট ম্যাচ। পাঁচটা দিন, সাদা পোশাক। কতটুকু রোমাঞ্চ ঠিক ঠাঁয় দিতে পারে এসব? কত টিকে থাকার সংগ্রাম জানান দিতে পারে টেস্টের আত্মপরিচয়?

এই ব্যস্ত শহর, পথ-ঘাট আর জীবনে আপনার ঘণ্টার পর ঘণ্টা টুকটুক ব্যাটিং-বোলিং দেখার ফুরসত নেই। আপনার কাছে হয়তো ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হয়, অথবা লাগে 'হুদাই এসব।'


যতবারই এসব দেখেন, আপনার হিটলার ও টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে প্রচলিত সেই গল্পটা মনে পড়ে। ওই যে, হিটলার উদ্বোধন করতে এসেছেন একটা টেস্ট, প্রথম দিন তিনি চলে গেছেন, ফল বের হয়নি।


এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ...পঞ্চম দিন। হিটলার ফল জানতে চান, তা আর আসে না। খেলা শেষ হয়ে গেলেও না। হিটলার রেগে যান ভীষণ, ধ্বংস করে দেন জার্মানির ক্রিকেট।


কিন্তু টেস্ট ম্যাচও যে রোমাঞ্চের সবটা উজার করে দিতে পারে, ঠিকঠাক নজর দিলে আপনার হয়তো জানার কথা। কেবল জয়, পরাজয়, হারের বৃত্ত টপকে এ যে আরও বড় কিছু কারো কারো কাছে, তাও কী অজানা!


কিন্তু দুইটা ম্যাচ একটু আলাদাই। টেস্টে 'টাই'; না হয়েই বা থাকে কেমন করে। আজ থেকে ৬০ বছর আগে, কোনো এক গোধূলি লগ্নে জন্ম প্রথমটার, ব্রিজবেনে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া লড়েছিল যেখানে। দ্বিতীয়টা চেন্নাইতে, ১৯৮৬তে।


দ্বিতীয়টার কথাই ধরুণ, ম্যাচের তিন দিন পেরোনোর পরও তো এটি এগিয়েছিল ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র অথবা একপেশে জয়ের পথে। অ্যালান বোর্ডারের হাতে তখন অজিদের নেতৃত্বের ভার। টস জিতে ব্যাটটা বেছে নিয়েছিলেন যিনি।


ব্যাটিংয়ে নেমে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকালেন ডিন জোন্স, উত্তাপে ইনিংস শেষেই তাকে ছুঁটতে হলো হাসপাতালে। সেঞ্চুরি হাঁকালেন ডেভিড বুন আর অধিনায়ক অ্যালেন বর্ডার। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসটা থামলো তৃতীয় দিন সকালে এসে, ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরকার্ডে জমা পড়েছে ৫৭৪ রান। তখনও কী কেউ ভেবেছিল এই টেস্ট ইতিহাসে অমর হয়ে যাবে, 'টাই' বনে গিয়ে! অস্ট্রেলিয়ান কোচ বব সিম্পসন তো বলেও গেছেন, তার চোখে অন্যতম সেরা অজি ইনিংস এটা।


এমন কিছুর পর তো অজিদের দাপটই প্রত্যাশিত, প্রথম ইনিংসে ২৭০ রানেই ভারত সাত উইকেট হারিয়ে ফেলার পর আরও। শেষে কপিল দেবে রক্ষা! তার সেঞ্চুরিতে ভারত থামে ৩৯৩ রানে।


দ্বিতীয় বার ব্যাটিংয়ে নামে অস্ট্রেলিয়া, ইনিংস ডিক্লেয়ারের ঘোষণা আসে ১৭০ রানে, ভারতীয়দের ৩৪৮ রানের লক্ষ্য দিয়ে। জবাবটা ভালোই দেয় স্বাগতিকরা, ২০৪ রান তুলে ৩ উইকেট হারিয়ে, সুনীল গাভাস্কারের ৯০ রান অবদান তাতে।

তবে ৩০০ পেরোনোর আগেই হারায় আরও ৩ উইকেট। অফ স্পিনার গ্রেগ ম্যাথিউজ যখন শেষ ওভারটা করতে এলেন, তখন প্রতিপক্ষের আর একটাই উইকেট বাকি। ৬ টা বল, ৪টা রান। মনিনন্দর সিং আর রবি শাস্ত্রী। অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন একটা বল (উইকেট), ভারতের এক বাউন্ডারি।


আচ্ছা, তখনও কি টি-ব্যাগের প্রচলন ছিল? বাহারি রঙের প্যাকেট থেকে একটা করে টি-ব্যাগ কি তখন কেউ ঢেলেছেন গরম পানিতে? উত্তেজনায় কি সেসবের ইচ্ছে ছিল আদৌ!


ওভারটা শুরু হলো ডট দিয়ে। শেষ দিনের একেবারে শেষ ওভারটা। দ্বিতীয় বলটা গেল ফিল্ডারের হাত ফসকে, সুবিধা নিতে ভুল নেই শাস্ত্রীর, দুই রান দৌড়েই। সমীকরণ তখন ৪ বলে ২ রান। এরপর আরও এক রান শাস্ত্রীর ব্যাটে, স্কোরটা সমান।


তারপরই আগে-পরে অসংখ্যবার আঙ্গুল তুলে ব্যাটসম্যানের সাজঘরের পথ দেখানো ভি বিক্রমরাজু ঐতিহাসিক সেই আউটটা দিলেন। মনিন্দর সিংকে সাজঘরের পথ দেখিয়ে কি ডেকে আনলেন নিজের সাদা পোশাকের ক্রিকেটে আম্পায়ারিংয়ের সমাপ্তিও? কে জানে, মাত্র দ্বিতীয় টেস্টে আম্পায়ারিং করা ভি তো তা আর কখনোই করেননি!

প্রথম আর দ্বিতীয় টেস্ট 'টাই'-এর একটা সংযোগ আছে, সেটা 'অস্ট্রেলিয়া'। পরেরটায় টস জিতলেও আগেরটায় টস হার, দ্বিতীয়টায় আগে ব্যাটিংয়ে নামে নিজেরা, দ্বিতীয়টায় প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারিখের হিসাবে ৯ ডিসেম্বর, ১৯৬০ সাল তখন।

ব্যাটিংয়ে নেমে স্যার গ্যারি সোবার্স হাঁকালেন সেঞ্চুরি, প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সব উইকেট হারিয়ে ফেলার আগে করলো ৪৫৩ রান। তাদের জবাব দিতে নামা অস্ট্রেলিয়ার সব ব্যাটসম্যানকে যতক্ষণে আউট করতে পারলো ক্যারিবীয় বোলাররা, ততক্ষণে অজিরা করে ফেলেছে ৫০৫ রান। ১৮১ রান করে ডাবল সেঞ্চুরির আক্ষেপ বাড়িয়েছেন নর্ম ও' নীল, ৯২ রান করে সিমন্স সেঞ্চুরির।

দ্বিতীয় ইনিংসটাতে সুবিধা করতে পারেনি উইন্ডিজরা। আগের ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়া ডেভিডসনের বোলিং বিষে নীল হয় তারা, করতে পারে কেবল ২৮৮ রান। ৮৭ রানে ৬ উইকেট নেন অ্যালান ডেভিডসন।

অস্ট্রেলিয়ার জিততে তখন প্রয়োজন ২২৮ রান। ব্যাটিং বিপর্যয় হয়েছিল তাদেরও। তবে বল হাতে সামনে থাকা অ্যালান ডেভিডসন লড়লেন ব্যাট হাতেও, অধিনায়ক রিচি বেনো সঙ্গী হলেন তাতে। দুজন মিলে গড়লেন ১৩৪ রানের জুটি।

তখনো ৮ বলে ওভার, ৬ বলে ওভারের শুরু আরও পরে। ম্যাচের শেষ দিনের শেষ ওভারটা শুরু হলো যখন, তখনো ঘড়ির কাঁটায় ছ'টা বাজেনি, চার মিনিট বাকি। ম্যাচটা শেষ হতে হতে ঘড়ির মিনিটের কাটাটা হয়তো ১২ পেরিয়ে এগিয়েছিল আরেকটু, অজিদের ইনিংস পারেনি। থেমেছে একেবারে ২৮৮ রানে, টেস্ট প্রথম 'টাই' দেখেছে তাতে।

একেবারে শেষ ওভার খেলা শুরুর আগে অজিদের দরকার ৬ রান, তিন উইকেট হাতে নিয়ে। একেবারে প্রথম বলটাতেই এক রান নিয়ে নেন ব্যাটসম্যান ওয়েলেই, সাত বলে তখন দরকার পাঁচ রানের। দ্বিতীয় বলে আউট বেনো। ম্যাচটা তখনো হয়তো জমেনি ভালোভাবে। কিন্তু 'জমে ক্ষীর' হয়ে যায় চতুর্থ বলটাতে এসে। আগের বল ডট দেয়া নতুন ব্যাটসম্যান ইয়ান ম্যাকিফ নিজের নার্ভের কাছে হার মেনে দৌড় দেন বল উইকেট কিপারের হাতে রেখেই। যা হওয়ার হয় তাই, আউট।

পঞ্চম বলটা আরও নাটকীয়। উড়িয়ে খেলেছিলেন ব্যাটসম্যান গ্রাউট, বলটা স্কয়ার লেগে তখন, বোলার ছুঁটেন ক্যাচ নিতে, জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার কানাহাইয়েরও একই চেষ্টা। দুজনের ধাক্কা, ক্যাচ মিস, তারপর এক রান।

এই ম্যাচটা যখন চলছে, তখন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। শেষ দিন টি এর সময়টাতে অধিনায়ক রিচি বেনোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'হোয়াট আর ইউ গোয়িং টু ডু?', রিচির জবাবটা ছিল, ‘উই আর গোয়িং টু হ্যাভ অ্যা গো।’

ওই ম্যাচ ব্যাট আর বল দুই জায়গাতেই দারুণ পারফর্ম করা অ্যালান ডেভিডসন পরে ক্রিকইনফোতে লিখেছিলেন, আপনার হাতে যখন শেষ সেশনে চার উইকেট হাতে থাকবে, জিততে দরকার হবে ১৩০ রান। তখন ৯০ শতাংশ সময়ই ড্রয়ের জন্য খেলা উচিত। কিন্তু আমরা জিততেই খেলতে নেমেছি, আর এটাই আমরা।

জেতাটা হয়তো হতো ডেভিডসনদের, তবুও যা হয়েছে কম কী! ষষ্ঠ বলটাতে গ্রাউট যদি আরেকটু জোরে দৌড়াতেন অথবা ফিল্ডার থ্রোটা এত ভালো না করতেন। তাহলে সপ্তম বলে ২ বলে ১ উইকেট হাতে রেখে ১ রানের সমীকরণ দাঁড়াতো না।

অথবা যদি সপ্তম বলেও স্কয়ার লেগে বলটা ঠেলে আরেকটু জোরে দৌড়াতেন লিন্ডসে ক্লাইন, কয়েক ইঞ্চির জন্য সাদা দাগটা ছুঁতে পারতেন, রানটা হয়ে যেত। তাহলে হয়তো রিচি বেনোরা জয়টা পেয়ে যেতেনন, তবে লেখা হতো না অসংখ্য উপাখ্যান, স্মৃতি হাতড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করে পড়া হতো না ম্যাচটা। লেখা হতো না, "এক প্যাকেট টি-ব্যাগ, 'ম্যাড়ম্যাড়ে টেস্ট', রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চের সেই দুই ম্যাচ।"