• ক্রিকেট

মুলতান টেস্ট : কাঁদেন মাহমুদ, আক্ষেপে পোড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম

পোস্টটি ১৭৫৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আপনার স্বপ্নের পরিধি হয়তো অনেক বিস্তৃত। মনে হয়তো অনেক সুপ্ত ইচ্ছা। আপনি হয়তো হারতে হারতে বিধ্বস্ত, আপনার আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি একটা ম্যাচ জিততে চান, একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে চান।

আপনার দেশ অনেক কষ্টে সাদা পোশাকটা গায়ে তুলেছে। তা নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠছে প্রতিনিয়ত। আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিচ্ছেন, পারছেন না। বুঝতে পারছেন না কী করবেন।

আপনি একটা ম্যাচ হারেন, দুইটা, তিনটা...২৩ ম্যাচের ২২টাই। বাকিটাও জেতেন না, বৃষ্টির কল্যানে ড্র করেন। এরপর আপনি একদিন জয়ের খুব কাছে পৌঁছে যান, আক্ষরিক অর্থেই হাতছোঁয়া দূরত্বে। তবুও আপনি পারেন না, রুমালে মুছেন চোখের জল, মাঠ থেকে যেন বের হতে চান না। তবুও বের হতে হয়। সে ছবিটা আপনার দেশের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, যুগ থেকে যুগে কেবল কাঁদিয়ে যায়, আক্ষেপে পোড়ায়।

আপনি তাহলে বাংলাদেশ টেস্ট দল। খালেদ মাহমুদ সুজন। আপনি ২০০৩-এ নিশ্চয়ই ফিরে গেছেন এতক্ষণে। মুলতানে। একটুর জন্য, 'একটা বল'-এর জন্য; সত্যিই, একটি উইকেটের জন্যই প্রথম টেস্ট জয়টা পাওয়া হলো না যেখানে।
***

'পরাজয়েও ডরে না বীর' প্রবাদটা হয়তো আপনি জানেন। অনেকবার শুনিয়েছেন, নানা জায়গায়। জানেন খালেদ মাহমুদও। তবুও তিন কাঁদেন মুলতানে। আপনি হয়তো বাংলাদেশে, সবার আড়ালে কিংবা সম্মুখে।

মোহাম্মদ রফিকও হয়তো জানতেন এসব হবে। অবশ্যম্ভাবী সব। তিনি উমর গুলকে সাদা দাগটার বাইরে পেয়েছিলেন। স্ট্যাম্পটা ভেঙে দিতে পারতেন, গুল আউট হয়ে যেতেন। হোক সেটা বল করার আগে, তবুও ক্রিকেটীয় আইনে আউটই হতো সেটা। পরিভাষায় মানক্যাড আউট যেটা।

রফিক জানতেন স্টাম্পটা উপড়ে দিলে আরও কাছে চাওয়া যাবে স্বপ্ন ছোঁয়ার। দূরে ঠেলে দেয়া যাবে নানান ভর্ৎসনা। টেস্ট আঙিনায় তিন বছরের ছোট্ট শিশু, 'বাংলাদেশ' হয়তো বুকটা ফুলিয়ে বলতে পারবে 'আমরা পারি'।

এতকিছু জেনেও স্টাম্পটা উপড়াননি রফিক। আরেকপ্রান্তে যখন ইনজামাম উল হক ধীরে ধীরে নিঃশেষ করছেন জমা হওয়া স্বপ্ন, তখন গুলকে ফেরানোর পর আর লাগতো একটা বল। ঠিক তা না, একটা উইকেট। রফিক তবুও আউট করলেন না, 'জেন্টালম্যান গেম' বলে।

আপনি হয়তো বলতে পারেন, 'জয়ই তো সব'। রফিক সেটা মনে করেন না। পরে তাই বলেন, 'লাভ কী হতো? আমরা ম্যাচ জিততাম। কিন্তু মানুষ আমাদের ছোটলোক বলতো। আমরা তো ছোটলোক না। কত ম্যাচ জিতবো, ছোটলোকি করে লাভ আছে?'

***

খালেদ মাহমুদ সুজন অধিনায়ক ছিলেন দলটার। খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না। হারটা এত বেশি পরিচিত ছিল, একটা ড্রই আকাশসম খুশির তাই। টস জিতে অধিনায়ক বেছে নিয়েছিলেন ব্যাটিংটা। দলের ২৮ রানেই ফিরে গিয়েছিলেন ওপেনার হান্নান সরকার। তাতে খেই হারায়নি বাংলাদেশ। জাবেদ ওমর আর হাবিবুল বাশার মিলে হাল ধরেন, গড়েন ৭৪ রানের জুটি।

বাশারের ৭২ আর শেষদিকে, লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের নিয়ে লড়ে, রাজির সালেহর ৪৯ রান। তাতে বাংলাদেশের পুঁজি ২৮১ রানের। পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস শেষে যেখানে বাংলাদেশ এগিয়ে ১০৬ রানে।

মোহাম্মদ রফিকের সবচেয়ে বেশি অবদান যাতে, তার নামের পাশে ফাইফার জমা হয়েছে। আরও পরে, সংগঠক হয়ে, খেলোয়াড়ি জীবন নিয়েও ট্রলের শিকার হয়েছেন যে খালেদ মাহমুদ, তিনি পেয়েছিলেন ৪ উইকেট। পাকিস্তান তাতে গুঁটিয়ে গিয়েছিল ১৭৫ রান।

***

বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হতেই যেন 'পুনর্জন্ম' হলো ব্যাটিংয়ে। এই শব্দটা বরাবর ব্যবহার হয় ভালো অর্থে। তবে এই পুনর্জন্ম এক ইনিংস আগেই বদলে যাওয়ার খানিক আশা দেয়া থেকে চিরচেনা সেই রূপটাতে ফিরে যাওয়া। সেটা কী? একটার পর একটা উইকেট আর ব্যাটিংয়ের নাজেহাল অবস্থা।

৭৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুকছে বাংলাদেশ। তাতেও আশা দেখাচ্ছেন অলক, অলরাউন্ডার অলক কাপালি। সাব্বির আহমেদের বাউন্সারটা লেগেছে মাথায়, ব্যান্ডেজ লাগাতে হয়েছে। তবুও মনোবলে এতটুকুও ঘাটতি আসেনি যার, মাঠ ছাড়তে বাধ্য করতে পারেনি।

মাথায় ব্যান্ডেজ আছে, হয়তো যন্ত্রণাও, কিন্তু উইকেট ছেড়ে যাওয়ার তাড়না নেই, টেস্টটা জিততে হবে যে, সংগ্রহটা বড় করতে হবে, প্রতিপক্ষের লক্ষ্যটাও। পরে অবশ্য বৃদ্ধাঙ্গুলিতে আঘাত পেয়েছিলেন, মাঠও ছেড়েছিলেন কিছুক্ষণেরর জন্য। তবে বেশি দেরি করেননি। আবার নেমে গেছেন মাঠে, কিন্তু থাকতে পারেননি আর বেশিক্ষণ।

রফিকের 'জেন্টাল ম্যান গেম'টা পাকিস্তানের উইকেটরক্ষক রশিদ লতিফ ভুলে যাওয়ায়, অথবা মনে রেখে কাজ নেই ভাবায়। মাটি থেকে বলটা তুলেও তাই আবেদন করলেন রশিদ, আঙ্গুল তুলে দিলেন আশোক ডি সিলভা। আউট হলেন অলক, মাঠ ছাড়লেন। মাটি থেকে বল কুড়ানো এক ক্যাচে আউট হয়ে।

বাংলাদেশও খুব দূর যেতে পারলো না। থামলো ১৫৪ রানে। পাকিস্তানের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ালো ২৬১ রানের। এর মধ্যে পাকিস্তানকে আটকাতে পারলেই ছোঁয়া যাবে বিস্তৃত স্বপ্নের আকাশটা, বলা যাবে মনের সব সুপ্ত ইচ্ছা, মুছে দেয়া যাবে অনেক গ্লানি।

শুরুটাও হলো তেমনই। স্বপ্ন দেখানো, অথবা তা ছোঁয়ার আশাটাকে বড় করার। একটার পর একটা উইকেটেরর পতন ঘটে, বাংলাদেশের স্বপ্ন ছোঁয়ার দূরত্বটা কমে যায় আরও। দুরূ দুরূ বুকে শুরু হয় প্রহর গুনার, প্রথম টেস্ট জয়ের, মুলতানে।

স্টেডিয়াম অথবা টিভি স্ক্রিনে স্কোরকার্ডে যতক্ষণে জমা হয়েছে ৮১ রান, ততক্ষণে নাই হয়ে গেছেন টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যান। ১৬১ রানে ফিরে গেছেন সাকলায়েন মুস্তাক, স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে তখন বাকি কেবল ইনজামাম উল হক। বাংলাদেশের স্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বাধ। তার সঙ্গী চার টেল-এন্ডার।

এই সিরিজের আগে, ইনজি অবসরই নিয়ে নিয়েছিলেন ক্ষোভ আর দুঃখে। টানা অফ ফর্ম চলছিল, সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। তার ক্যারিয়ারের ইতি দেখছিলেন অনেকে, ইনজামাম নিজেও হয়তো। তবুও সব আক্ষেপের পেছনে থাকে অন্য কারো নায়ক হয়ে ওঠার গল্প, ইনজামাম হলেন সেটা।

দারুণ সব শট খেলতে শুরু করলেন, ব্যবধানটাও কমে আসতে থাকলো তাতে। সাব্বির আহমেদ ও উমর গুলকে নিয়ে ৮ম ও ৯ম উইকেটে ইনজামাম তুলে ফেললেন ৪১ ও ৫২ রান।

কী বিভীষিকার এক চিত্রনাট্য। নেহায়তই ক্রিকেটটা সিনেমা নয় বলে। তা যদি হতো- ইনজি নায়ক নাকি খলনায়ক? দুই দেশের কাছে দু'রকম। পাকিস্তানকে জয়ের যত কাছে পৌঁছে দেন 'অলস!' এই ব্যাটসম্যান, নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া এই 'অপবাদ' কে যতই ভুল প্রমান করতে থাকেন, ততই 'শত্রু' বনে যান বাংলাদেশের।

তার নেয়া একটা রানের সঙ্গে নেয়া কোটি দীর্ঘশ্বাস কি তখন টের পান ইনজি? পেলে কিভাবে খেলেন এমন অতিমানবীয় ইনিংস! কেন তিনি একটা 'শিশু' টেস্ট দলকেই বেছে নেবেন এমন ইনিংসটার জন্য।

গুল যখন রান আউট হয়ে ফিরলেন, তখন আর একটা উইকেটই বাকি পাকিস্তানের, পাঁচটা রান তখনও দরকার। বাংলাদেশের 'কাছের জয়টা দূরে'র মনে হচ্ছে তখনও। খালেদ মাহমুদ যে ওভারটা করলেন, সেখানেও তিনটা বল খেললেন শেষ ব্যাটসম্যান ১৭ বছরের ইয়াসির। চতুর্থ বলটাতে একটা সিঙ্গেল নিলেন। যেকোনো বলেই আউট হতে পারতেন ইয়াসির, হননি।

পঞ্চম বলটা ঠেকিয়েছিলেন ইনজামাম। এরপরই যেন আর তর সইলো না। মাহমুদের শেষ বলটা পুলের মতো করলেন, ফাইন লেগ দিয়ে ছুঁলো সীমানা দড়ি। অথচ বলটার লাইন মিস করতে পারতেন ইনজামাম, হতে পারতেন আউটও। সেদিন যে সবই 'পারফেক্ট' হচ্ছিল।

বলটা চার হতেই উল্লাসে মাতলেন ইনজামাম, ১৩৮ রানের ইনিংস খেলার পর, স্বপ্নের আঁকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নটাকে ধ্বংস করে দিয়ে। অথচ উল্লাসটা স্বভাবের সঙ্গে যায় না ইনজামামের, তবে তিনি জানেন কী করেছেন, কোত্থেকে নিয়ে এসেছেন ম্যাচটা। জানেন আপনিও।

ইনজামাম বের হওয়ার সময় ফুল ছিঁটানো হয় তার ওপর। খালেদ মাঠ ছাড়েন রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে। আপনিও হয়তো কাঁদেন, অনেকে মিলে টিভির সামনে বসে, অথবা একটু আড়ালে সরে গিয়ে। এরপরও অনেকবার হয়তো কেঁদেছেন আপনি, ক্রিকেটের জন্য, বাংলাদেশের হারে। তবুও কী সে চোখের জলের সঙ্গে তুলনা চলে? আপনি হয়তো কাঁদতে কাঁদতে ভাবেন, ফুলটা যদি সেদিন পড়তো মাহমুদের ওপর, ইনজামাম যদি কাঁদতেন!