দ্য ব্র্যাডম্যান ফাইলসঃ সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি
পোস্টটি ১৪৪৫ বার পঠিত হয়েছেচা বিরতির মিনিট খানিক আগে। ৯৯ রানে অপরাজিত থেকে ব্যাট করছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। শুধু সেঞ্চুরি নয় 'সেঞ্চুরির' সেঞ্চুরি করার দোড়গরায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তা দেখতে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে জড়ো হয়েছেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মানুষ। অঙ্কের খাতায় বললে, ৩২ হাজার দর্শক অপেক্ষায় আছেন ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবার জন্য। কোনো প্রতিপক্ষ অধিনায়কই চান না এমন এক রেকর্ডের পাশে জড়িয়ে থাকুক তার দলের নাম। তাই ব্র্যাডম্যানকে আটকাতে ভিন্ন এক পন্থার আশ্রয় নিলেন ভারতীয় অধিনায়ক লালা অমরনাথ।
বল হাতে তুলে দিলেন এমন একজনকে যার মুখোমুখি হওয়া ত দূরের কথা, সে কিভাবে বোলিং করে সেটাও জানেন না ব্র্যাডম্যান। ভারতীয় অধিনায়কের বুদ্ধিদীপ্ত চালকে পরে 'ব্রিলিয়ান্ট মুভ' হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন তিনি। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৯৯ তম সেঞ্চুরি পূরণ করেন ব্র্যাডম্যান। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিল জনস্টন, আয়ান জনসন, স্যাম লক্সটন এবং ডগ রিংয়ের মতো বাঘা বোলারদের কচুকাটা করে আউট হন পাক্কা একশ রানে। তখন থেকে ক্রিকেট মোদিদের প্রত্যাশা আকাশ চুম্বী হয়ে পরে। কেননা মাত্র ২০৩ ম্যাচের মধ্যে ৯৯ টি সেঞ্চুরি করে ফেলা এক ব্যাটসম্যানের কাছে পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি পাওয়া এক প্রকার নিশ্চিতই বলা।
সম্ভাবনার মাত্রাটা আরো বেড়ে যায় যখন প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকে অনভিজ্ঞ ভারত। তাই যে যেখান থেকে পারছেন উড়ে আসছেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ব্র্যাডম্যানের কালজয়ী ইনিংসটি নিজের চোখে দেখার জন্য। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সফর হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে বেছে নেয় ভারত। পাঁচ টেস্টের সিরিজের সঙ্গে থাকে ৯ টি প্রস্তুতি ম্যাচ। চারটি প্রস্তুতি ম্যাচের পর ভারতের খেলা হয় অস্ট্রেলিয়ান একাদশের বিপক্ষে। শক্তির বিচারে এক প্রকার জাতীয় দলই বলা যায়। তার ওপর অধিনায়ক হিসেবে স্বয়ং ব্র্যাডম্যানই যখন দলে, তখন দলটির শক্তিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন করা বেমানান।
ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে এসসিজিতে উপস্থিত হাজার হাজার সমর্থক। অপেক্ষা সেই কাঙ্খিত মুহুর্তের। তবে ভারতীয় অধিনায়ক টস জিতে আগে ব্যাটিং নিলে বাড়তে থাকে অপেক্ষার প্রহর। ব্যাটিং ব্যর্থতায় মাত্র ২২৯ রানেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে সফরকারীরা। উল্লেখযোগ্য ইনিংস বলতে তিন নম্বরে নামা গুল মোহাম্মদের ৮৫ রান। বিকেলের খেলা তখনো পুরোটা বাকি। তাই স্বাগতিক দর্শকদের ধারণা আজই হয়তো ব্যাটিংয়ে নামবে অস্ট্রেলিয়া। এক উইকেট ফেলতে আর কতক্ষণ? কিন্তু তাদের মেজাজের চরম পরীক্ষা নেন গগুমাল কিষেনচাদ ও উইকেট কিপার জামশেদ ইরানী। শেষ উইকেট জুটিতে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে দিন শেষ করেন তারা।
প্রথম দিনের তিন গুন দর্শক হাজির দ্বিতীয় দিন। কিষেনচাদ ও ইরানী জুটিতে আরো ৩৮ মিনিট বিরক্ত হবার পর তাদের মুখে হাসি ফোটান ব্রুস ডুলেন্ড। প্রথম ইনিংসে ভারত থামে ৩২৬ রানে। অসি ওপেনার বিলি ব্রাউন ৮ রানে আউট হলে খুব দ্রুতই ডাক পরে ব্র্যাডম্যানের। সিটটা নড়েচড়ে স্থির হয়ে বসে খেলা দেখতে শুরু করলেন দর্শকরা! কল্পনায় আকা সেই ইনিংসটি যে শুরু হবে এখন। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ৭৮ মিনিটেই ফিফটি পূরণ করে ফেলেন ব্র্যাডম্যান। ভারতের বোলিং যে খারাপ হচ্ছে তা বলা যাবে না। কিন্তু ব্যাডম্যানের নান্দনিক সব শটের কাছে সেসব কি আর পাত্তা পায়!
তবে ৮০ রানের মাথায় প্রায় বিপদেই পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আম্পায়ারের কাছে লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন তুলে ভারত। মাঠে থাকা ৩২ হাজার দর্শকের হার্টবিট তখন উচ্চ পর্যায়ে, এই বুঝি আঙুল তুলে সব আশা মাটি করে দিবেন আম্পায়ার। কিন্তু সাদা হ্যাট পরে থাকা ঐ লোকটি মাথা নাড়াচাড়া করলে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তারা।
সময় গড়াতে গড়াতে শেষের পথে আরো একটি সেশন। ১১ রান নিয়ে লাঞ্চে যাওয়া ব্র্যাডম্যান অপরাজিত ৯৯ রানে। তার সেঞ্চুরি ঠেকাতে ভারতীয় অধিনায়ক বল তুলে দেন কিষেনচাদের হাতে। মূলত ব্যাটিং অলরাউন্ডার হলেও লেগ স্পিনটা চালিয়ে নিতেন ঠিকঠাক । ব্যাট হাতে ৭৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে খাদের কিনারা থেকে তোলায় আত্মবিশ্বাসে ভরপুর তিনি।
আগে কখনো খেলেননি বলে তাকে সম্মান দিয়ে মোকাবিলা করাটাই উচিত সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে করলেন ব্র্যাডম্যান। অবশ্য সব বোলারদের ক্ষেত্রেই সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন তিনি। কিষেনচাদের প্রথম কয়েকটি বল ঠেকিয়ে দিলেন বেশ দক্ষতার সঙ্গেই। মাঝে দিয়ে ফুলটস বল পেলে হাত খোলার সুযোগ পান ব্র্যাডম্যান। তবে আক্রমণাত্মক না হয়ে, বলটিকে সোজা ঠেলে দিলেন মিড অনের দিকে। দৌড়ে এক রান স্পর্শ করার পর করতালির কম্পনে মুখরিত এসসিজি। ব্র্যাডম্যান ব্যাট উচিয়ে ধরার আগেই হাতটা এগিয়ে দিলেন লালা অমরনাথ। পরিকল্পনাটা কাজে দিল না এমনটা ভেবেই হয়তো ফিরে যান।
অ্যাডিলেড থেকে শুরু হওয়া জার্নি খানিকক্ষণের জন্য সিডনিতে থামল অনন্য এক মাইলফলকের জন্য। এই ১ থেকে ১০০তে পৌঁছানোর সময় লেগেছে ২০ বছর। কাকতালীয় ভাবে ঐ ১ আর ১০০'র মাঝে মিলও রয়েছে একটি। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১ রানের হারে ভেস্তে যায় নিজের প্রথম সেঞ্চুরি (প্রথম ম্যাচ)। ঠিক একই চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে ১০০ তম সেঞ্চুরির ম্যাচেও।
সেঞ্চুরির পর আরো ৭২ রান যোগ করে বিদায় নেন ব্র্যাডম্যান। মিডল অর্ডারদের ব্যর্থতায় প্রথম ইনিংসে ৩৮০ রানেই অলআউট অস্ট্রেলিয়া একাদশ। ৫৬ রানে পিছিয়ে থাকার পর আবারো কিষেনচাদের ৬৩ রানের দৃঢ়তায় অসিদের ২৫১ রানের লক্ষ্য দেয় ভারত। জবাবে ভিনু মানকাডের স্পিন বিষের কাছে দুমড়ে মুচড়ে যায় স্বাগতিকদের ব্যাটিং লাইনআপ। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা ব্র্যাডম্যান এই ইনিংসে করেন মাত্র ২৬ রান। নেইল হার্ভে একা লড়াই করলেও ৪৭ রানের হার মানতে হয় তার দলকে। ৮৪ রান খরচ করে ৮ উইকেট নেন বাঁহাতি স্পিনার ভিনু মানকাড।
- 0 মন্তব্য