• ক্রিকেট

বরাবর, রূপকথার বাস্তব রূপ দেয়া নায়কগণ

পোস্টটি ২৩২৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

Young Tigers become World Champions | Dhaka Tribune

বিশ্বজয়ীর দল,

আজ আমি আপনাদের একটি চিঠি লিখতে বসেছি। কাগজ-কলমেই লিখতাম, কিন্তু সে যুগ নাকি ফুরিয়ে গেছে। তাই একরকম অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিখতে বসেছি ভার্চুয়াল সাদা কাগজ খুলে।

আপনাদেরকে যখন চিঠি লিখতে বসেছি, তখন ঝিঁরিঝিঁরি বৃষ্টি পড়ছে আকাশ থেকে। টিনের চালের টুপটুপ শব্দের নিচে বসে আছি আমি একা। কানে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে অবিরত। আমি মুগ্ধতা ভরে দেখছি বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য।

আপনাদের চিঠি লিখবো ভাবতেই আমি হারিয়ে গিয়েছি মাস ছয়েক পেছনে। চারদিকে যখন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার যাত্রা আরম্ভ হচ্ছে চেনা গণ্ডিতে। মৃত্যুটা খুব কাছে মনে হচ্ছে বারবার। সে সময় ওই সুখস্মৃতি মনে করে আপন মনে হেসেছি কিছুক্ষণ। আপনাদের তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নেই আগে। নয়তো বড় অন্যায় হয়ে যাবে।

প্রিয় আকবর আলী,

গত ফুটবল বিশ্বকাপের একটা স্মৃতি শুনুন। কিলিয়ান এমবাপ্পেকে তো আপনার চেনার কথা। কোন সুদূরের ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জিতলেন তিনি। এদেশে তখন রব উঠলো 'এমবাপে ১৯ বছরে বিশ্বকাপে জিতে গেলো আর বাংলাদেশের ছেলেরা কি করছে' ইত্যাদি ইত্যাদি।

আপনিও হয়তো দেখে থাকবেন সেসব। জানেন, আমার বয়সও ঊনিশ তখন, খুব গায়ে লেগেছিল সেসব। আপনারও কি? সে জন্যই কি এভাবে বুক চিতিয়ে লড়লেন ফাইনালে? ভারতজুজু কাটিয়ে দিলেন। আরও পরে, আপনারা যখন দেশে এলেন। আপনি সংবাদ সম্মেলন করলেন, আমি আপনার সামনে বসে তখন। ইচ্ছে করছিল আপনাকে জাপটে ধরে ধন্যবাদটা দিয়ে দিই। আপনাকে ঘিরে এমন ভিড়, পারিনি তখন। এ চিঠি থেকেই ধন্যবাদটা নিয়ে নেন না হয়।

অধিনায়ক,

এক অদ্ভুত অসহায়ত্বের গল্পটা জেনে নিন। সাদা কালো টিভি আছে তখনো। রঙিনও চলে এসেছে ততদিনে। একটার পর একটা ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। আমি দেখি তবুও ক্লান্তিহীনভাবে। কতই বা বয়স তখন! সর্বোচ্চ দশ। আপনারও তো তেমনই হওয়ার কথা। চারদিক থেকে প্রশ্ন ধেয়ে আসে, 'এসব দেখে কী লাভ হয়! বাংলাদেশ কোনোদিন কি বিশ্বকাপ জিতবে?'

এই ক'দিন আগেও। সব পর্যায়ে, ভারতকে হারানো যায় না কিছুতেই। চারপাশে কেবল অসহায় মুখের দেখা মিলে। আপনারা খেলতে নামার আগেও, কত ভয়। অথচ আপনারা সব কেমন উড়িয়ে দিলেন এক ফুৎকারে। সে জন্য তো ধন্যবাদও যথেষ্ট নয়।

শরিফুল আর সাকিব। আপনাদের কি কখনো বড্ড অবহেলা সইতে হয়েছে? নয়তো এমন আগ্রাসী কেন হলেন সেদিন? পরে অবশ্য বলেছেন, 'ভারতকে চাপে রাখতে'। শুধুই কি তাই? এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ? জার্সিতে তো বুক পকেট নেই, ট্রাউজারে অবশ্য আছে। সেখানে কি লুকিয়ে রেখেছিলেন আসলে? স্বপ্ন? ভারতকে ধরাশায়ী করে বিশ্বজয়ের আকাঙ্খা? কখন সেটা বুকে পাঠিয়ে দিলেন বলুন তো! তা না হলে এভাবে লড়বেন কোন শক্তিতে?

পারভেজ হোসেন ইমন। আপনার কি কখনো বড্ড একলা লেগেছিল? বিষণ্নতা জাপটে ধরেছিল হৃদয়টা? কখনো একা কেঁদেছিলেন আড়ালে? সেসবের শোধ তুললেন চোট নিয়ে খেলে? আপনি কি জানেন কতজনের বুকটা সে সময় দুরূদুরূ করে কেঁপে ওঠেছে? আপনাকে কীভাবে জানাবো কৃতজ্ঞতা!

জানেন, বরাবরই আমার মনে হয় এ এক রূপকথা। এই সেদিন, আপনাদের বিশ্বজয় পরও বলেছি, 'আমরা বিশ্বকাপ জিতেছি আর আমি বেঁচে আছি। অবিশ্বাস্য!'

কল্পনা করুন। একটা ক্রিকেট পরিবার। আক্ষরিক অর্থেই তাই। মা-বা সবাই ক্রিকেট দেখেন, সন্তানও। এই ক বছর আগেও। ছেলের নির্ঘুম রাত্রিতে। মা পাশে শুয়ে হয়তো গল্প করতে করতে বলছিল, 'তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে।' তখন কি সত্যি মনে হতো কারো? আপনারাই বলুন?

কোনো এক সন্ধ্যা বেলা। একটা বিশাল বিলের সামনে বসে আছে কেউ। রাস্তার মাথায়। দু ধারে পানিগুলো ছুঁয়ে দিতে চাইছে মাটি, পারছে না। আকাশটার রঙ অদ্ভুতভাবে লাল হয়ে আসছে। সূর্য তখন ডুবেছে ঠিকই, তবে নিজের ছাপটা যেন রেখে গেছে।

আলো আর আঁধারের সেই খেলার মাঝখানে একজন কল্পনা করছে নিজেদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে। বাংলাদেশের কেউ। বিশ্বের যেকোনো একটা পর্যায়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে। এমন কল্পনা অতিরঞ্জিত মনে হওয়াটা কি বাড়াবাড়ি হতো তখন? অথচ আপনারা তো সত্যিই করে দেখালেন।

কোথায় পচেফস্ট্রুম। দূর দেশের দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানেও যে আপনারা 'বাংলাদেশ', 'বাংলাদেশ' চিৎকার শুনলেন। পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচে খেই হারালেন না। ইমন, আপনি যে নেমে গেলেন চোট নিয়ে। রকিবুল, আপনি যে চারটা হাঁকিয়ে আবেগ সংবরণ করতে পারলেন না অথবা পারলেন। অধিনায়ক, আপনি যে 'আকবর দ্য গ্রেট' হয়ে দাঁড়িয়ে জয়টা নিশ্চিত করলেন। এসবের ফলটা কি দেখেছিলেন পরে? বোকা বাক্সের ভিডিও অথবা কোনো ছবিতে?

রকিবুল যখন চারটা হাঁকালেন। বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়ে পতাকা হাতে তখন শরিফুলরা। উইনিং শটটা হওয়ার পরই ভোঁ দৌড়। রকিবুলের...শরিফুলের... আকবরের... আপনাদের সবার। এরপরের ছবিগুলো তো আরও পরিষ্কার। আকবর দাঁড়িয়ে আছেন ট্রফি হাতে, আপনাদের নেতা সে। চারপাশে আপনারা সবাই। সামনে বহু কাঙ্খিত সেই 'চ্যাম্পিয়ন' লেখা প্ল্যাকার্ড। বৈশ্বিক কোনো আসরের শিরোপা জেতার অদৃশ্য মুকুট মাথায়।

অথবা আরেকটা ছবি। আকবর দাঁড়িয়ে আছেন ট্রফি হাতে, একা। তার পেছনে আকাশটা। তিনি কত বড় কীর্তিটা গড়ে ফেলেছেন তার প্রমান দিতেই কী ছুঁয়ে দেখতে না পারা নীল সেই ব্যাকগ্রাউন্ড!

আমি একটা বাস্তব হওয়ার মতো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি এরপর থেকে। সেদিন যে একটা ট্রেনের সামনে এসে চিৎকার করেছিলাম। কেউ শুনতে না পায় যাতে। 'বাংলাদেশ ; চ্যাম্পিয়ন' বলে। একেবারে বৃদ্ধ বয়সে, যখন লাঠি থাকবে হাতে। সেসময়টাতেও আমার অমন করার খুব যে ইচ্ছে।

কিংবা চোখে যখন চশমা লাগিয়েও দেখবো অথবা দেখবো না। সেসময়টাতে, যখন কেবল অবসরই থাকবে। তখন ঝাঁপসা চোখে আপনাদের ট্রফি নিয়ে সেই গ্রুপ ছবিটা দেখতে চাই। নয়তো আকবরের নীল আকাশের সামনে ট্রফি হাতের সেই ছবিটা। অথবা এই চিঠিটা!

ইতি, আপনাদের পথ চেয়ে থাকা কেউ